হোমরাজ্যসারা বছর ধরে মহালয়ার প্রতীক্ষা, জানেন কি দিনটির তাৎপর্য

সারা বছর ধরে মহালয়ার প্রতীক্ষা, জানেন কি দিনটির তাৎপর্য

সারা বছর ধরে মহালয়ার প্রতীক্ষা, জানেন কি দিনটির তাৎপর্য

দেবাস্মিতা নাগ
“অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া।” নীল আকাশে সোনা রোদ আর পেঁজা মেঘ, নদী তীর কাশে সাদা…..বাঙালির খুব চেনা ছবি। বইয়ের তাকে পূজা সংখ্যা, আর তার পরেই গম গম করে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায় পুজোর ঘোষণা “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠছে ….” এই টুকুর অপেক্ষাতেই সারাটা বছর কাটে বাঙালির।

পুজোর পাঁচ দিনের মতোই “পুজো আসছে”টাকেও সমান ভাবে চেটেপুটে উপভোগ করে বাঙালি।প্রকৃতপক্ষে মহালয়া থেকেই পুজোর প্রস্তুতি শেষ ও সরাসরি পুজো শুরু হয়ে যায় বাঙালির। শুরু হয়ে যায় নতুন জামা, সাজগোজ, খাওয়াদাওয়া, ঠাকুর দেখা সব। পুজোর “স্টার্টিং পয়েন্ট” মহালয়ার প্রকৃত পরিচয় কি, সে বিষয়ে কিন্ত অনেকেই অবগত নন।

অনেকে তো মহালয়া বলতে শুধু মাত্র রেডিওর “মহিষাসুর মর্দিনী” অনুষ্ঠানটি বোঝেন। কেউবা ভাবেন মহালয়া মানে ভোর রাতে তর্পণ, আবার কারো মতে চক্ষুদান। পঞ্জিকা মতে, এই দিন পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের শুরু। মহালয়ার প্রাক্কালে মহালয়ার গোড়ার গল্পটা একটু জেনে নেওয়া ভালো।

মহালয়া কথাটির অর্থ মহৎ আলয়। সনাতনী বিশ্বাস হলো, মহালয়ার আগে সম্পূর্ণ পিতৃপক্ষকালে ব্রহ্মের নির্দেশে মর্ত্যের কাছাকাছি আসেন পারলৌকিক আত্মারা। বিশেষ করে মহালয়ার দিনে পারলৌকিক আত্মারা আলয়ে অর্থাৎ ভুবনে প্রবেশ করেন, জল ও পিন্ড লাভের আশায়। এই সময় জল ও পিন্ড দান করলে তাঁরা তৃপ্ত হয়ে পরলোকে ফিরে যান।

এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে মহাভারতের একটি কাহিনী। কর্ণ যখন পরলোকে যান, তখন খাদ্য হিসেবে তাঁকে স্বর্ণ-রত্ন খেতে দেওয়া হয়। কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞেস করায় তাঁকে জানানো হয় যে, জীবিতাবস্থায় তিনি কেবল স্বর্ণ-রত্নই দান করেছেন, অতএব পরলোকে তিনি শুধু সেটিই খাদ্য হিসেবে পাবেন। খাদ্যবস্তু পেতে গেলে তাকে মর্ত্যে নেমে আগে খাদ্যবস্তু দান করতে হবে। তখন কর্ণ মহালয়ার দিনে মর্ত্যে এসে খাদ্য দান করে তিনি নিজের পারলৌকিক ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে মহালয়ার দিনে তর্পণ করে মর্ত্যবাসী।

আরেকটি মত অনুযায়ী, মহালয়ার দিনেই ঊমা তাঁর ছেলে মেয়েদের নিয়ে কৈলাস থেকে পিত্রালয়ে যাত্রা শুরু করেন। তাই ঊমার আলয়ে ফেরার এই দিনটি মহালয়া বলে চিহ্নিত।

তবে এই প্রজন্মের বাঙালির কাছে মহালয়া ও বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের নৈসর্গিক কণ্ঠে মন্দ্রিত পৌরাণিক কাহিনীগুলি সমার্থক। ওই মহিষাসুর বধ, মধু-কৈটভ, রক্তবীজ বধের কাহিনীগুলি শারদ প্রভাতে বিছানায় শুয়ে রেডিওতে আট থেকে আশি সকল বাঙালির একযোগে একই সময়ে না শুনলে যেন পুজোটা ঠিকমত এসে পৌঁছবেই না।

রঙিন টিভিতে যতবার যত রূপেই মহালয়া আসুক না কেন, সেটা রেডিওর অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সেই সৃষ্টির আদিতে বিশাল কারণ সমুদ্রে অনন্ত শয্যায় শায়িত বিষ্ণুর কান থেকে উৎপন্ন হওয়া মধু ও কৈটভের হত্যা বর্ণনা বা সকল দেবতার নাভিকুন্ড থেকে আদ্যাশক্তি মহামায়ার জন্ম বৃত্তান্ত ও তাঁর দশ হস্ত দশপ্রহরণে সেজে ওঠার বর্ণনার সাথে কখনোই এঁটে উঠতে পারলো না।

মহালয়ার পিছনে যতই পৌরাণিক কাহিনী থাকুক না কেন বাঙালি রেডিওর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়াকেই “মহালয়া”ও পুজোর সূচনা হিসেবে মন প্রাণ দিয়ে আপন করে নিয়েছে বাকি সব কাহিনীকে ‘সংগৃহীত তথ্য’ হিসেবে পাশে সরিয়েই রেখেছে।আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে না দিলে পুজো আসে না বাঙালির।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img