হোমPlot1রাসমণির ঐতিহাসিক সৃষ্টি দক্ষিণেশ্বর মন্দির

রাসমণির ঐতিহাসিক সৃষ্টি দক্ষিণেশ্বর মন্দির

রাসমণির ঐতিহাসিক সৃষ্টি দক্ষিণেশ্বর মন্দির

শুভদীপ রায় চৌধুরী
রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় দীপাবলিতে। রাসমণির জন্ম ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি জন্মেছিলেন হালিসহরে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী এক কৈবর্ত পরিবারে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ রাসমণি সম্পর্কে বলেছিলেন, “রানি রাসমণি জগদম্বার অষ্টনায়িকার একজন। ধরাধামে তাঁহার পূজার জন্যই আসিয়াছিলেন।”

নোবেল পুরস্কারজয়ী ফরাসী ঐতিহাসিক ও জীবনীকার মঁসিয়ে রোমাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪) বলেছিলেন, “ঐ সময়ে নিম্ন শ্রেণির একজন ধনী মহিলা ছিলেন, তাঁর নাম রানি রাসমণি। কলিকাতা হইতে প্রায় চার মাইল দূরে গঙ্গার পূর্বতীরে দক্ষিণেশ্বরে তিনি কালীর একটি মন্দির স্থাপন করেন। সেখানে পুরোহিতের কাজ করিবার জন্য একজন ব্রাহ্মণ সংগ্রহ করিতে তাঁহাকে অত্যন্ত বেগ পাইতে হইতেছিল। তাছাড়া, এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী ছিলেন শূদ্রাণী। অবশেষে ১৮৫৫ সালে ঐ পদ গ্রহণ করিতে রামকৃষ্ণ মনস্থ করিলেন … ১৮৬১ সালে রাসমণির মৃত্যু হয়। রাসমণি ছিলেন “নয়া বড়লোক” এবং জাতিতে নিম্নশ্রেণীর। তাই তিনি এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় তাঁহার মহানুভবতা ও উদারতার ফলে সকল ধর্মের অতিথিদের থাকার জন্য এখানে কয়েকটি কামরা ছাড়িয়া দেন।”

দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার আগেই রাসমণি জমির খোঁজ করছিলেন। আর তাঁর জন্মস্থান কুমারহট্ট হালিসহর ছিল প্রসিদ্ধ শাক্তভূমি। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রধান এই হালিসহরের গোঁড়া সমাজপতিরা তাঁর ইচ্ছের মূল্য দেননি। রানির অনুরোধ শুনে তাঁরা সদর্পে বলেন, জেলের মেয়ের মন্দির তৈরির অধিকার নেই। আর  বর্ণশ্রেষ্ঠরা বাধা দেওয়ার কেউ হালিসহরে জমি দিতে চাননি। 
রাসমণি দেবী তাঁর স্বামীর স্মৃতিতে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির তৈরি করেন, যা তাঁর জীবনের সবথেকে বড় কাজ। বাংলার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারক বাহক এই মন্দির। রানি রাসমণি মন্দির স্থাপনের জন্য বারাণসীর তুল্য গঙ্গার পশ্চিমদিকে বালি, উত্তরপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে জমি সংগ্রহের চেষ্টা করেন, কিন্তু ঐ অঞ্চলের “দম আনি”, “ছয় আনি” জমিদাররা রানিকে প্রচুর অর্থের বিনিময়েও কোনও জমি বিক্রি করতে চাননি।

রাসমণি বৈষ্ণব বংশে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর ধর্মমত ছিল উদার এবং তিনি ছিলেন একাধারে বৈষ্ণব, শৈব এবং শাক্তমতের অনুসারিণী।  বাড়িতে গৃহদেবতা রঘুনাথ প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তিনি কালীঘাটে বাগানবাড়ি, পুষ্করিণী এবং আদিগঙ্গার পাকাঘর নির্মাণ করেন এবং সেখানে তিনি ব্রাহ্মণভোজন অনুষ্ঠান করতেন। রাসমণি দেবী অন্নপূর্ণা দর্শনে কাশীযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। সেই রাতেই তিনি স্বপ্নাদেশ পান – কাশী যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, ভাগীরথীর তীরে মনোরম স্থানে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা ও ভোগের ব্যবস্থা করো। আমি ঐ মূর্তিতেই আবির্ভৃতা হয়ে তোমার নিত্যপূজা গ্রহণ করবো।”

দক্ষিশ্বেরের নবরত্ন মন্দিরের গঠনশৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল বাওয়ালীর মন্ডল প্রতিষ্ঠিত টালিগঞ্জের রাধাকান্ত মন্দির (১৮০৯ সালে), পাথুরিয়াঘাটার ধনপতি দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত মূলাজোড়-শ্যামনগর ব্রহ্মময়ী মন্দির (১৮০৮ সালে) ও লোকগাথা এবং প্রচলিত কথার সূত্রধরে টালিগঞ্জের পশ্চিম পুঁটিয়ারীতে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের নন্দদুলাল রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী কালীমন্দিরের (১৭৬০ সালে)।

কলকাতা থেকে ৫ মাইল উত্তরে গঙ্গার পূর্বকূলে উত্তর চব্বিশ পরগনায় এই দক্ষিণেশ্বর গ্রাম। “দক্ষিণেশ্বর” নামটির সঙ্গে তখনকার জনসাধারণের বিশেষ পরিচয় ছিল না। মাঝে  মাঝে জঙ্গল, বাগান, পুষ্করিণী, কবরস্থানে ঘেরা ছিল গ্রামটি। হিন্দুদের সঙ্গে কিছু মুসলমানের এবং ইংরেজের বসতিও ছিল। ইংরেজদের গির্জা না থাকলেও মুসলমানদের মাজার, দরগা ছিল। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছেই মোল্লাপাড়ায় একটি মসজিদও ছিল। সেখানে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম সাধনের সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নমাজ পড়তে যেতেন।

বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপ্রসাদ রায় চৌধুরী যখন বড়িশা থেকে দক্ষিণেশ্বরে এসে বসবাস শুরু করেন, তখন তাঁরাই এখানকার বনজঙ্গল পরিষ্কার করে গ্রামটির উন্নতি সাধন করেন এবং বহু লোক এনে বসতি স্থাপন করেন। এই বংশেরই যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী পরবর্তীকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপালাভ করেন এবং ত্যাগী সন্তানরূপে “স্বামী যোগানন্দ” নামে পরিচিত হন।

দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দির বাংলার শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন।। মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুট। গর্ভগৃহে কালো পাথরের বেদির ওপর রুপোর প্রস্ফুটিত শতদল। চারকোণে রুপোর স্তম্ভ। মা এখানে বেনারসী শাড়ি পরিহিতা, ত্রিনয়নী শ্যামাকালী। তাঁর অঙ্গে অসংখ্য স্বর্ণরৌপ্য অলংকার। বামদিকের একটি হাতে নৃমণ্ড ও অপরটিতে অসি। ডানদিকের দুটি হাতে বরাভয় মুদ্রা পদতলে শ্বেতপাথরের শিব।  বছরে তিনদিন বড় পূজা হয় দক্ষিণেশ্বরে। দীপান্বিতা, রটন্তী  ফলহারিণী কালীপুজো।

মায়ের মন্দিরের উত্তরে রাধাকৃষ্ণদেবের মন্দির। উল্টোদিকে সারি দিয়ে বারোটি শিব মন্দির। তিন মন্দিরে তিন ধরনের স্থাপত্য। ভবতারিণীর নবরত্ন মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির আটচালা মন্দির এবং রাধাকান্তের মন্দির ইউরোপীয় ধাঁচের।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে রানি রাসমণি সফল করেন তাঁর সর্বধর্ম-সমন্বয়ের স্বপ্ন। শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের এক মহামিলন তীর্থ। ধর্মের এই তিন ধারাকে একসঙ্গে করা, এমন দুঃসাহসের কাজ সম্ভব হয়েছিল রাসমণির  জন্যই।

রাসমণির দলিল থেকে জানা যায়, এখানকার মোট সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা স্থানটি ৪২ হাজার ৫০০ টাকায় কিনেছিলেন কুঠিবাড়িসমেত। এই কুঠিবাড়িটিই এই উদ্যানের আদি বাড়ি, যা সামান্য সংস্কারের পর এখনো অপরিবর্তিত আছে। গাজি সাহেবের পীরের স্থানটিও আদি। বাকিঘর বাড়ি-মন্দির-ঘাট ইত্যাদি রানির আমলে তৈরি।

১৮৪৭ সালে ৬ সেপ্টেম্বর “বিল অফ সেল” এর মাধ্যমে জমিটি কেনা হলেও সেটি তখন রেজিস্ট্রি করা যায়নি কারণ, তখন রেজিস্ট্রেশন আইন চালু ছিল না। পরে আইন বলবৎ হলে ১৮৬১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রানি রাসমণি সম্পাদিত আরেকটি দেবোত্তর দলিলের মধ্যে ঐ “বিল অফ সেল”-এর কথা উল্লেখ্য করে, সেই দলিলটি ১৮৬১ সালের ২৭ আগস্ট আলিপুরের রেজিস্ট্রি করা হয়।

দক্ষিণেশ্বরে জমি কেনার সঙ্গে সঙ্গেই ১৮৪৭-৪৮ সাল থেকেই এখানকার যাবতীয় নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং সেই কাজ প্রথম দিকে রানির প্রধান সহায়ক ছিলেন জ্যেষ্ঠ জামাতা রামচন্দ্র দাস। পরে রানির তৃতীয় জামাতা মথুরমোহন বিশ্বাসের ওপরই এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়, রানি মাঝে মাঝে তাঁর কাছ থেকেই খোঁজ নিতেন।

রাসমণি তৎকালীন খুব নামি বিলিতি ঠিকাদারি সংস্থা “ম্যাকিনটস অ্যান্ড বার্ন” কোম্পানিকে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার চুক্তিতে মন্দিরের পোস্তা ও ঘাট তৈরির কাজের ভার দেন। পোস্তা, বাঁধের কাজ শেষ হলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর গঙ্গার দিকে একই নকসা অনুযায়ী একই ধাঁচের ১২টি শিবমন্দির ও চাঁদনি এবং এই মন্দিরগুলির পূর্বদিকে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত মাটির টালি বাঁধানো একটি বিরাট চতুষ্কোণ প্রাঙ্গন তৈরি করা হয়, যার আয়তন ৪৪০ ফুট লম্বা এবং ২২০ ফুট চওড়া।

মন্দিরটি তৈরি করতে প্রায় ৯ বছর সময় লেগেছিল। এখানে মা-কালী, শিব, রাধাকৃষ্ণের মন্দির স্থাপিত হলেও এটি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির নামেই প্রসিদ্ধ মন্দির। নির্মাণ শুরু হয় ১৮৪৭-৪৮ সালে এবং সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। প্রতিষ্ঠার দিন অপরূপ সাজে সাজানো হল মন্দির চত্বর।

রাসমনি যখন মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং দেবীকে অন্নভোগ দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হন, তিনি জাতিতে শূদ্র হওয়ায় প্রথা অনুযায়ী তখন কোনও ব্রাহ্মণই এমনকি রানির নিজের গুরুদেবও মন্দির প্রতিষ্ঠা ও দেবীকে ভোগ দিতে রাজি হলেন না। একমাত্র কলকাতার ঝামাপুকুর চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন,  প্রতিষ্ঠার আগে যদি কোন ব্রাহ্মণকে ঐ মন্দির দান করা যায় এবং সেই ব্রাহ্মণ যদি ঐ মন্দিরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন তবে তা অশাস্ত্রীয় হবে না। এই বিধান দেওয়ায় রামকুমারকে বহু গোঁড়া ব্রাহ্মণ অভিযোগ করতে শুরু করেন, সেই কথা তিনি গ্রাহ্য করতে রাজি ছিলেন না। সেই সময় রাসমণি রামকুমারকেই এই কাজ করার জন্য আহ্বান করেন, রামকুমারও সেই কাজে ব্রতী হন এবং অপরিণত কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদাধরকে নিয়ে রাসমণির ইচ্ছানুয়ায়ী ১২৬২ বঙ্গাব্দের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার, স্নানযাত্রার দিন (১৮৫৫ সালে) মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।

দক্ষিণেশ্বরের মায়ের নাম “জগদীশ্বরী”। দেবোত্তর দলিলেও এই নামেই রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য়ের বিষয় সর্বত্র মা ভবতারিণীর নামেই উল্লিখিত। বেদীর উত্তর-পূর্ব কোণে মায়ের রৌপ্য নির্মিত পালঙ্ক। পালঙ্কের  ওপর রয়েছে শয়নের যাবতীয় উপকরণ। এদিকে মায়ের সংসার, তৈজসপত্র। সেখানে রয়েছে রুপোর কলস, হাঁড়ি, থালা-বাটি, চামচ, পানের বাটা ইত্যাদি।

প্রতিদিন ভোর ৪টের সময় মায়ের সকালের আরতি হয়। সেই সময়ে মায়ের বাল্যভোগ মাখন ও মিছরি। এরপর মন্দির বন্ধ থাকে, ফের খোলা হয় সকাল ৬টায়। তারপর মায়ের স্নান আরতি। সকাল ৯টায় নৈবেদ্য ভোগ। বেলা ১২টায় অন্নভোগ। অন্নভোগে থাকে দুটি তরকারি, তিন রকমের ভাজা, ডাল, চাটনি, পায়েস এবং মাছ। এরপর মন্দির বন্ধ। আবার মন্দির খোলে বিকেল সাড়ে ৩টেয়। তখন ফল, ছানা সহযোগে বৈকালি দেওয়া হয় ও রাত্রি ৮টায় হয় শীতল ভোগ।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img