ড. বিকাশ পাল, লন্ডন প্রবাসী অধ্যাপক-গবেষক
(অসাধারণ এই ছোট্ট লেখাটি লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট অধ্যাপক গবেষক ড. বিকাশ পালের।মেদিনীপুরের সন্তান, তাঁর প্রাণ জুড়ে রয়েছে এই বাংলা। দুনিয়ার যেখানেই তিনি থাকুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সঙ্গী। সেই আন্তরিক, নিখাদ ভালোবাসা ফুটে উঠেছে এই রচনায়।)
“প্রভাত আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে। এই তোমারি প্রেমের বাণী,
প্রাণে এসেছে।
তোমারি মুখ ওই নুয়েছে,
মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে
তোমারি চরণ।
এই তো তোমার প্রেম ওগো
হৃদয় হরণ।” – গীতাঞ্জলি
সন্দেহ নেই, রবিঠাকুর গীতাঞ্জলির এই কবিতাটি কোনও এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালেই লিখেছিলেন।আমাদের বাড়ির পাশের মাঠে হাঁটতে বেরিয়ে এটি মনে এল। কালকের বিদায়ী সূর্য একটা আভাস দিয়েছিল আজ সে আবার অনেক আলো, প্রেম আর গান নিয়ে পৃথিবীতে আসবে। তবে মনের প্রত্যাশাকে প্রশয় দিইনি, লন্ডন তো। হয়তো সেজন্যই আজ দিনের অমলিন আলো আর আকাশের এত নীল মনকে এক বিশেষ মুগ্ধতায় ভরে দিয়েছে।
মাঝে মাঝে ভাবি, সূর্যের আলো শত সহস্র বছর ধরে মানুষকে এত মুগ্ধ করে কেন? সে কি সূর্যের থেকে এটা আমাদের পাওনা নয়, দান বলে? হ্যাঁ, সত্যিই নিঃশর্ত দান, তাই বোধ হয় এত ভালো লাগে। এসব ভাবতে ভাবতে আর হাঁটতে হাঁটতে আমার ২০১৫ সালের জুন মাসের কথা মনে এল। আমি তখন ইরানে, এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলাম। ওই দেশের সেরা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শরিফ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি আর অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রকের আমন্ত্রণে প্রথমে মনে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল।
ইরানের ওপর কত দেশের কত নিষেধাজ্ঞা। তারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একেবারে একঘরে। কিন্তু জেনেছি, ইরানের আগের নাম ছিল পারস্য। ওমর খৈয়াম, মৌলানা রুমি, হাফেজ, সাদি, ফেরদৌসি – এঁরা সবাই পারস্যের কেন, বিশ্ব সাহিত্যের বীজপুরুষ। যতটা পড়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শুনেছি। তা ছাড়া শরিফের প্রেসিডেন্ট মামুদ ফিরুজাবাদ, আর অধ্যাপক হাসেম ওরাই আমার বন্ধু। এঁরা দুজনেই Power engineer, তাই এঁদের আমি চিনি। এঁদের আমন্ত্রণ আমার পক্ষে অস্বীকার করা সত্যিই অকর্তব্য হবে, তাই রাজি হয়ে গেলাম।
ঠিক হল তিনদিনের আন্তর্জাতিক কর্মশালার প্রধান অতিথি বক্তার ভাষণ দিয়ে, শক্তি মন্ত্রকের সচিবের সাথে সৌজন্য বিনিময় করলেই হবে। বাকি সময় এঁদের ব্যবস্থাপনায় ইরান ঘুরে বেড়ানো। কুশল বিনিময়, আর প্রধান অতিথির ভাষণ শেষ করে শক্তি মন্ত্রকের সচিব, আরও কিছু পদস্থ সদরওয়ালা আর হাসেমের সাথে মধ্যাহ্নভোজ সেরে কর্মশালা থেকে বেরিয়ে গেলাম।
ফার্সিতে Faranghi va tarikhe man Kheli dush daram-এর মানে আমি ইরানের সংস্কৃতি আর ইতিহাসকে ভালোবাসি। এটি আর একটু আধটু ফার্সি শিখলাম সারার কাছে। কাজ চালানোর মত। সারা তখন আমার কাছে PhD করত। ইরান এক অসাধারণ দেশ। বেশ উপভোগ করেছি। মরু শহর সিরাজে গেলাম। শহর জুড়ে বাগানের পর বাগান। ফার্সিতে বলে বাগিচে। যেদিকে তাকাই শুধু ফুল আর ফুল। সত্যি যেন অসীম তার সব সৌন্দর্য, ওই ফুলের মধ্যে দিয়ে সীমার কাছে ধরা দিয়েছে।
রবিঠাকুর বলতেন, সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর। তাই যেন ঘটে চলেছে, সেখানে গিয়ে অনুভব করলাম। একেবারে মরুভুমিতে মরুদ্যান। সিরাজ দার্শনিক কবি হাফেজ আর সাদির শহর । এরকম এক বাগিচেতে বসেই সাদি লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী গদ্য আর কবিতার “গোলেস্তান” (gol means flower, স্তান means place)। গেলাম তাঁদের সমাধিক্ষেত্রে আমার বিনম্র প্রণতি জানাতে।
হাফেজ যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত সেটা একটা বিরাট বাগিচের মাঝে। অনেক কিছু ফার্সিতে লেখা। আমার পুরো সফরের সঙ্গী ছিলেন নেগর জাহাদি। তিনি মধ্য তিরিশের এক অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা আর মার্জিত রুচির মহিলা। ব্রিটেনে পড়াশোনা শেষ করে ইরানের একটি সংস্থায় কাজ করেন, যারা এই কর্মশালার Gold sponsor। সব কিছুই তিনি ফার্সিতে পড়ে ইংরেজীতে তর্জমা করে দিচ্ছিলেন, পুরো সফরটাতেই। হাফেজের জায়গায় যখন গেলাম, নেগর বললেন উস্তাদ বিকাশ (এঁরা শিক্ষককে উস্তাদ বলে সম্বোধন করেন) , to Hafez the concept of love is unconditional . The meaning of the script engraved in stone here is the relation between the aftab ( sun) and the zamin ( earth) : তারপর তিনি যা বললেন, তা ঠিক এই রকম: Hafez er quote (in english ) এই achhe. Even after all this time , the sun never says to the earth , you owe me . Look what happens with a love like that – It lights the whole sky .
আজ এই সুন্দর আলো ঝলমল দিনে আমার সিরাজ শহরের কথা মনে আসছে। ইরানের মরমি মানুষগুলিরও কথা মনে আসছে। নেগর, হাসেমের সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। আবার ইরান যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এবার আমার অন্য কাজে যেতে হবে। Every one enjoys the rest of the weekend.