তীর্থঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
চলতি হাওয়ার উল্টো পথ বন্ধুর এটাই স্বাভাবিক। তবু সেই পথে হেঁটে অন্য এক দিশা মেলে। তিন দশক আগে সপরিবারে কেদারবদ্রী গিয়ে উপলবব্ধি হয়েছিল, পাহাড়ে ওঠার থেকে নীচে নেমে যাওয়া তুলনায় দ্রুত, তবে নিশ্চিতভাবে নিরাপদ এমন নয়। চলতি হাওয়ার পথ চেনা, হয়ত সহজও কিন্তু নিরাপদ এবং সর্বদা কাম্য এমন কথা জোর গলায় বলা চলে না।
গত শতাব্দীর শেষ বছরে লন্ডনে পৌছে প্রথম প্রযুক্তির ক্ষমতার উপলবব্ধি হয়। তার আগে দেশে থাকতে সেভাবে অনুভব করিনি। ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’এর ১০ নম্বর চৌরঙ্গী লেন’এর অফিস থেকে বিকে পাল এভিনিউ’র নিউস-ডেস্ক’এ রিপোর্টারদের খবর পাঠানোর ব্যবস্থা ছিলো মোডেম’এর মাধ্যমে। মোডেমটি কী বস্তু তা তখন বোধগম্য ছিলো না। আমরা ফ্লপি ডিস্ক’এ নিজেদের লেখা খবর সেভ্ করে রাখতাম। দিনের শেষে প্রকৌশলী জনৈক ঘোষবাবুকে অনুরোধ করা হতো সংযোগ দেওয়ার।
ঘোষবাবু বি কে পাল এভিনিউ-তে বসতেন। ঐ কাগজে প্রায় সাত মাসের আমার কর্মজীবনে ঘোষবাবুকে একবারও চর্মচক্ষে দেখা হয়নি যদিও প্রতিনিয়ত তার অনুগ্রহ না পেলে আমাদের দিনাতিপাত হতো না। একটি লাল রং-এর ঘোড়ানো ডায়াল’এর সুবৃহৎ টেলিফোন’এর মাধ্যমে ঘোষবাবু যখন সংযোগের ব্যবস্থা করতেন তখন ঐ বনেদি দূরভাষ যন্ত্রটি সগৌরবে গোঁ গোঁ শব্দ সহযোগে তার সবিশেষ ক্ষমতার জানান দিত। আমরা দ্রুত একটি বিশেষ কম্পিউটারে আমাদের ফ্লপি ডিস্কগুলো ঢুকিয়ে দিতাম। তারপরে কি-বোর্ডে একটি বিশেষ বোতামে হাল্কা টোকা দিতেই অ্যামাজনের স্রোতের মতো অক্ষরমালা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে পৌছে যেত বিকে পাল’-এর অফিসে।
পরে পিটিআই-তে গিয়ে পেলাম LAN । একটি সুবৃহৎ কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত শত শত মনিটর। সেগুলোকেই তখন সর্বশক্তিমান কম্পিউটার বলে মনে হলেও আদতে সেগুলো ছিলো মূল যন্ত্রটির শাখা-প্রশাখা। মাঝে মাঝে তা আবার আটকে যায়। তখন প্রকৌশলীদের সাহায্য নিয়ে হত সেগুলোর বন্ধনমুক্তি। যুগান্তর’এ ডিটিপি’র হিম-শীতল ঘরের তুলনায় LAN-এর আবাস বেশ উষ্ণ এবং সেখানে পাদুকাপুরাণের প্রবেশও নিষিদ্ধ নয়।
তিরানব্বই থেকে নিরানব্বই – এই বছর ছয়েকের মধ্যে প্রযুক্তির এতগুলো রূপ দেখে অপ্রযৌক্তিক (non-technical) ব্যক্তির বিভ্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। এর মধ্যে আবার একবার প্যারিসে লেখা পাঠাতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম এক ভিন্ন ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট’র মধ্যে সাযুজ্য এবং পার্থক্য আমার আরো গুলিয়ে গেল।
এই অবস্থায় লন্ডনে পৌছে উপলবব্ধি করলাম, কম্পিউটার হলো বাড়ি এবং ইন্টারনেট কেবল্ সংযোগ। বিলেতে ই-মেল ছাড়া আমি অথৈ জলে পড়তে পারি, এই আশঙ্কা থেকে আমার সহৃদয় বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপক সৌমানন্দ দিন্দা এক সন্ধ্যায় কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট’এ বসে আমার একটি ই-মেল’এর ব্যবস্থা করে দিলো। কলেজে সহপাঠী সৌমানন্দ এখন পরিবেশ অর্থনীতির এক দিকপাল। তখন সে লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটিতে গবেষণায় রত।
লন্ডনে এসে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট”এর মধ্যে ফারাক বুঝতে আমার বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যায়। তার পরে উপলবব্ধি হয়, ইন্টারনেট একটি প্রকান্ড বিশ্বকোষ যার মধ্যে জাগতিক এবং মহাজাগতিক সব প্রশ্নের উত্তর ভরা আছে। এবং এটি একটি খোলা বইয়ের মতো সবার সামনে উন্মুক্ত। সঠিক-বেঠিক, দরকারি-ফালতু, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের মধ্যে ঝাড়াই-বাছাই ব্যবহারকারীকেই করে নিতে হয় তার চাহিদা মতো। এ যেন এক সুবৃহৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলিত রূপ।
কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় লাইব্রেরি থেকে প্রায়শই ভগ্ন-মনোরথ হয়ে ফিরতে হতো। দরকারি বইটি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় Hal R Varian-এর বই থেকে Microeconomics পড়াতেন। অথচ বইটির পরিচয় বা সন্ধান আমাদের কাছে ছিল না। একদিন কলেজ স্ট্রিটে পুরনো বই-এর বাজারে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে বইটির সন্ধান পেলাম। হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে বুঝলাম California বিশ্ববিদ্যালয় এবং MIT-র অর্থনীতিবিদই আমাদের মতো একলব্য’র দ্রোণাচার্য। আর্কিমিডিস-এর eureka moment-এর মতো উল্লসিত হয়ে বইটি কিনে ফেললাম বটে তবে তাতে microeconomics অনুধাবনে আমার বৌদ্ধিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে এমন দাবী করতে পারি না। পরের দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ বা কাঁটাকল ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে গিয়ে সন্ধান করে জানতে পারলাম বইটির একটি মাত্র কপি আছে, এবং তা সারা বছরের জন্য আশীষবাবু নিয়ে রেখেছেন।
তথ্য এবং বৌদ্ধিক রসদের এমন অসম বিন্যাসের মধ্যে দিয়েই আমাদের ছাত্রজীবনে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করতে হয়েছে। Macroeconomics-এ জাতীয় আয় (National Income) আমি কোনো কালেই বুঝতাম না। হাতের কাছে যেসব বই ছিল তাতে চোখ রাখলেই সাগরের ঢেউ’এর মতো ঘুম ধেয়ে আসত। এখন মনে হয় তখন যদি ইউ-টিউব’এর মতো পরিষেবা হাতের কাছে থাকত তবে বিষয়টি বোঝা কিছুতেই বোঝা হয়ে উঠত না।
এখন ফিল্টার-এর কারট্রিজ বদল থেকে শুরু করে ওয়াশিং মেশিন পরিস্কার করা পর্যন্ত, সবকিছুরই ছাত্রবন্ধু ইন্টারনেট, বিশেষ করে ইউ-টিউব’এর মতো পরিষেবা। তবে জ্ঞানের এমন বাহুল্যের মধ্যে ভুসি যে নেই তা নয়। বরং ভুসিই বেশি। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে। আর ভুসি-সংকলন সামাজিক মাধ্যমকেই অনেকে সত্যনিষ্ঠ তথ্যের বাইবেল বলে মনে করে থাকেন। আমার পরিচিত অনেকেই তথ্যের মৌলিক সূত্রের পরিবর্তে ফেসবুক এবং হোয়াটস্ অ্যাপ’এর মাধ্যমে সত্য সন্ধানে বেশি আগ্রহী।
সামাজিক মাধ্যম-বাহিত এই চলতি পথের উল্টোদিকে হেঁটে, প্রায় আড়াই মাস ফেসবুক রহিত নিভৃতাবাসে কাটালাম। আড়াই মাসে একেবারে একাগ্র চিত্তে ধী-শক্তির আধার হয়ে ওঠা গেছে, এমন দাবী করি না। তবে আমাকে নিয়ে, বা আমার লেখা-ছবি এবং অন্যান্য কর্মকান্ড নিয়ে কে কী ভাবছে, তা জানার উদগ্র কৌতুহল কিঞ্চিত স্তিমিত হয়েছে।
নরেন্দ্রপুরে বাংলার শিক্ষক প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ পালধি স্কুল-জীবন শেষে মাথায় আশীর্বাদী হাত রেখে বলেছিলেন, “অহংকারের সন্ধি মনে রাখিস। জীবনে শান্তি পাবি।” অহংকার’এর সন্ধি অহম (আমি) + কার (কাহার) । অর্থাৎ আমি কাহার। রবীনদা বলতেন, “আমি কাহার তাই যদি না জানি তবে আমার এত অহংকার কীসের।”
সামাজিক মাধ্যম থেকে আড়াই মাসের এই নিভৃতাবাসের সূত্রে পাওয়া আত্ম-অনুসন্ধানের সুযোগে এটাই অনুভূত হয়েছে, ” আমি এমন কোনো কেউকেটা নই যে আমাকে নিয়ে অহর্নিশ কৌতুহল উদ্রেক হতে হবে।” এই অনুভূতি যাতে “দীনতার অভিমানে” পর্যবসিত না হয়, সেটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।