হীরক কর : সারদা (Sarada), রোজভ্যালি (Rose Valley), আইকোর (Icore) সহ প্রায় ৫০টি চিটফান্ড সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই (CBI) তদন্ত যখন ঢিমেতালে, তখনই কলকাতার বুকে বড়সড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে এল। চিটফান্ড কেলেঙ্কারির চেয়ে এটি কোনও অংশে কম নয়। এই নিয়ে কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন থানায় একাধিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তদন্ত সেভাবে এগোয়নি বলে সূত্রে খবর।
এই মুহূর্তে জেলে বন্দি অনেক চিটফান্ড সংস্থার কর্তা। এর মধ্যেই গত পাঁচ বছরে নিঃশব্দে বাজার থেকে প্রায় একই কায়দায় প্রায় ১৯০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কলকাতার একটি সংস্থা। ওই সংস্থার কর্তাদের বিরুদ্ধে কলকাতার বিভিন্ন থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রতারিতরা।
প্রতারিতদের অভিযোগ, কোনও মামলার তদন্ত হয়নি। গ্রেফতার হননি একজনও প্রতারক। শেষে প্রতারিতরা দিল্লিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের দ্বারস্থ হয়েছেন। ইডি মামলা শুরু করেছে ইডি ।
পেশায় ব্যবসায়ী বিশাল আগরওয়াল। সল্টলেকের বাসিন্দা বিশাল ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে বড়বাজার থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন সুরানা গোষ্ঠীর সিইও শান্তি সুরানা, তাঁর স্ত্রী প্রভা এবং সংস্থার একাধিক কর্তার বিরুদ্ধে। অভিযোগে তিনি জানিয়েছিলেন, ওই গোষ্ঠী “সুরানা গ্রুপ ফান্ড স্কিম” নামে একটি স্কিম বাজারে আনে। সেখানে বলা হয়, ৪ বছরে টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে এবং সেই সঙ্গে ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড। মোটা টাকা লাভের আশায় তিনি দু’দফায় প্রায় ৫ কোটি টাকা লগ্নি করেন ওই সংস্থায়। কিন্তু ৪ বছর পর ২০১৮ সালে যখন পুরো টাকা দ্বিগুণ হয়ে ফেরত পাওয়ার কথা, তখনই বন্ধ হয়ে যায় সংস্থার বিবাদী বাগের অফিস।
শেক্সপিয়ার সরণিতে সংস্থার সদর দফতরে বার বার দরবার করেও টাকা ফেরত পাননি। এরপর বিশাল তপসিয়া থানাতেও একটি অভিযোগ দায়ের করেন। তপসিয়া থানায় এফ আই আর নম্বর ১৯৪। তারিখ ৫/১২/২০১৯।
এরপর একে একে অনেক প্রতারিত অভিযোগ দায়ের করেন। একইভাবে ভাবেই বড়বাজার থানায় এফ আই আর হয়েছে তিনটি। যথাক্রমে,৩১৫/২০১৯, ২৩/২০২০,২৪/২০২০। তালতলা থানায় ১৫/২০২০। বউবাজার থানায় ৪১/২০২০। কড়েয়া থানায়, ৩৮, তারিখ,২৮/১/২০২০। ভবানীপুর থানায় ৭/০৩/২০২০ তারিখে হয়েছে ৭৬ নম্বর এফ আই আর। এছাড়াও ওই একই থানায় এফ আই আর রয়েছে নম্বর ২৬,২৮/০১/২০২০। প্রগতি ময়দান থানায়,১৩২, তারিখ ২৯/০৭/২০২০।
অর্থাৎ বড়বাজার, কড়েয়া, তপসিয়া-সহ কলকাতার একাধিক থানায় গত এক বছরে প্রায় এক ডজন অভিযোগ জমা পড়েছে সুরানা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনও মামলাতেই কোনও অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ প্রতারিতদের। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে ১৩ জন। এরা হল প্রভা সুরানা, শান্তি সুরানা, পবন সুরানা, শুভম সুরানা, শুবিকা সুরানা, অশোক চৌধুরী, পল্লভী চৌধুরী, জয়দীপ নাথ, সৌমেন দাস, নরন্তন মূল সুরানা (Norantan Mull Surana), ঊষা আগরওয়াল, শুভা কাঙ্কারিয়া, রাজীব কাঙ্কারিয়া। এফ আই আর আছে সুরানা মার্কেন্টাইল প্রাইভেট লিমিটেডের নামেও। গ্রেফতারও হননি সুরানা গোষ্ঠীর কোনও কর্তা। পুলিশের খাতায় সকলেই ফেরার। একমাত্র বালিগঞ্জের কুইন পার্কের বাড়িতে রয়েছেন ৭০ বছরের নরন্তন মূল সুরানা।
অভিযোগ আনা হয়েছে ২০টি সংস্থার বিরুদ্ধে। এগুলো হলো শুভম ইম্পেক্স প্রাইভেট লিমিটেড, এভার স্মাইল ডিস্ট্রিবিউটর প্রাইভেট লিমিটেড, এস এ সাপ্লায়ার্স প্রাইভেট লিমিটেড, গোল্ড টাউন মার্কেটিং প্রাইভেট লিমিটেড, মুকেশ ইনভেস্টর প্রাইভেট লিমিটেড, রিওয়ার্ড ভানিজা প্রাইভেট লিমিটেড, বজরংবলী কম্পিউটার্স প্রাইভেট লিমিটেড, মিডলট্রন হোটেল প্রাইভেট লিমিটেড, সার্দান অ্যাভিনিউ ইন প্রাইভেট লিমিটেড, সানফোর্ড মার্কেটিং প্রাইভেট লিমিটেড, বুলেট প্রোপাইটর প্রাইভেট লিমিটেড, কমার্শিয়াল প্যারাডাইস প্রাইভেট লিমিটেড, সুমন এওয়াস প্রাইভেট লিমিটেড, সি এ রিয়েলিটি প্রাইভেট লিমিটেড, তিলজালা রিয়েলটি প্রাইভেট লিমিটেড, সঞ্জনা রিয়ালটি প্রাইভেট লিমিটেড, চন্দ্রকলা রিয়েলিটি প্রাইভেট লিমিটেড, মুকেশ কমার্শিয়াল কর্পোরেশন ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/৪৬৮/৪৭১/১২০বি এবং ৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হাওয়ালা কাণ্ডে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।
প্রতারিতদের দাবি, সুরানা গোষ্ঠী তাঁদের জানিয়েছিল, নির্মাণ ক্ষেত্রে সংস্থা বিনিয়োগ করে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সুরানা গোষ্ঠীর নির্মাণ চলছে এবং সেই ব্যবসারই একটা লভ্যাংশ তাঁরা লগ্নিকারীদের দেয় লগ্নির বিনিময়ে। সুরানা গোষ্ঠীর এই ফান্ড স্কিমের একটি নথি আছে আমাদের কাছে। ২০১৭ সালের ওই নথিতে দেখা যাচ্ছে, ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ৪ বছরে ২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হবে লগ্নিকারীকে। ওই নথিতে সংস্থা নিজেই জানাচ্ছে, তাঁরা বাজার থেকে ১৯০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ তুলেছে।
সাধারণভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমোদিত কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে, দ্বিগুণ টাকা ফেরত পেতে সময় লাগে অন্তত ৮ বছর। সেখানে তার অর্ধেক সময়ে টাকা দ্বিগুণ করার টোপ দিয়ে এ রাজ্যের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টাকা তুলেছে সুরানা গোষ্ঠী। প্রতারিতদের একটা বড় অংশ সিনিয়র সিটিজেন। অনেকেই তাঁদের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় বিনিয়োগ করে কার্যত কপর্দকশূন্য। থানায় অভিযোগ জানানোর পর কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় প্রতারিতদের অনেকেই কলকাতা পুলিশের ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের কাছেও অভিযোগ জানান। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হয়নি বলে অভিযোগ।
এরপরই প্রতারিতদের একটি অংশ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের সদর দফতরে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ জানান। তারপরই এ বছরের অগাস্ট মাসে প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে মামলা দায়ের করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।
কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ সুরানা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁদের দাবি, ইডি তদন্তের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। যদিও ইডি কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে চিঠি দিয়ে (মেমো নম্বর- ইসিআইআর/এইচকিউ/১১/২০) বড়বাজার, কড়েয়া, ভবানীপুর, তপসিয়া থানায় ৭টি এফআইআরের কপি চেয়ে পাঠিয়েছে।
কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর, কড়েয়া এবং তপসিয়ার দুটি এফআইআরের কপি কলকাতা পুলিশ ইডিকে দিলেও, বাকিগুলো দেয়নি। সারদা বা রোজভ্যালির মতো এ ক্ষেত্রেও ইডির অভিযোগ, তদন্তে সহযোগিতা করছে না কলকাতা পুলিশ। যদিও কলকাতা পুলিসের কর্তারা সে কথা অস্বীকার করেছেন।
কিন্তু গোটা ঘটনায় প্রশ্ন তুলেছেন প্রতারিতরা। তাঁদের প্রশ্ন, কেন এ ধরনের এত বড় আর্থিক অপরাধের পরও বিশেষ তদন্ত দল তৈরি করে তদন্ত করল না কলকাতা পুলিশ। রাজ্য পুলিস ডিরেক্টরেট অফ ইকোনমিক অফেন্স বলে একটি আলাদা দফতর করেছে পনজি প্রতারণার তদন্ত করতে। তাঁদেরও লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু, তাঁরাও এই মামলার তদন্ত করলেন না কেন? প্রতারিতদের প্রশ্ন, তা হলে কি এই প্রতারণার টাকা থেকেও লাভবান হয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা? আর তাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এই মামলা! এক্ষেত্রে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নামও উঠে আসছে।