প্রশান্ত কুমার বসু
(লেখক প্রশান্ত কুমার বসু বিশিষ্ট সাংবাদিক। অমৃতবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন। পরে যোগ দেন কলকাতায় মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে। বাগবাজারের বনেদি বাড়ির সন্তান এই সাংবাদিক মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি।)
যদি বলি ওপাড়ায় যাইনি, তাহলে সত্যের অপলাপ হবে। আর যদি জানেন কেন গিয়েছিলাম তাহলে হয়তো আতসকাঁচ খুজে আমার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে বসবেন না। অথচ আপনাদেরই অনুরোধে, বিশেষ করে যাঁরা আগের দুকিস্তি পড়েছেন, এই পর্বের অবতারণা, যদিও আমি সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। স্বীকার করছি সেটি আমার একান্ত অক্ষমতা।
এ কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতেও এক বিদেশিনী। এমনিতেই কলকাতায় বিদেশিরা কম আসেন। তার ওপর VVIP মন্ত্রীসান্ত্রি হলে তো কথাই নেই। আসবেন কেন সে প্রশ্নও তোলেন অনেকেই। সবাই জানেন ঠান্ডাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিশ্বরাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে মতাদর্শ নয়, অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে।
এখন সবাই বোঝেন বাজার, ব্যবসা। সে পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক হাতছানি একেবারেই তলানিতে। গত প্রায় ৪৪ বছর ধরেই। মানছি না, মানব না দিয়ে শুরু হয়ে হাল আমলের কেন্দ্রবিরোধিতার লম্বা কাহিনী। আমি সে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না, কারণ আমার সে যোগ্যতাও নেই। তাছাড়া অনেকেই বলবেন ছোট মুখে বড় কথা!
সেই নিরিখে হঠাৎ যদি শোনা যায় আমেরিকার high profile মন্ত্রী কলকাতায় আসছেন বিষ্ময় লাগে বৈকি। স্বভাবতই মার্কিন উপদূতাবাসে আলোড়ন, সাজো সাজো রব! দিল্লীর থেকে নির্দেশের পর নির্দেশ আসছে। এখানেও হচ্ছে একের পর এক meeting. পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রস্তুতি চাই, কোন ত্রুটিবিচ্যুতি যেন না থাকে, না ঘটে।
Donna Shallala বলে কথা যিনি President Clinton-এর very influential Health and Human Services Secretary! সাদা বাংলায় মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী! আপনারা ভাবছেন এর সঙ্গে চিৎপুরের সম্পর্ক কি? আপনাদের মনে আছে নিশ্চয় বিগত দুই পর্বে চিৎপুরের অনেক বৈশিষ্ট্যের কথা বললেও ঐ জায়গার কথা সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়েছি। কারণ, কে কি ভাববেন?
অথচ চিৎপুরের ট্রামে চড়ে ধর্মতলা বা বিবাদী বাগে যেতে গেলে বি কে পাল এভিনিউ ছাড়ালেই বাঁদিকে অমর কথাশিল্পী বিভূতিভূষণের নিশিপদ্মের নায়িকারা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় মুখে রং মেখে দাঁড়িয়ে আছেন এ দৃশ্য কি কারও চোখ এড়িয়ে গিয়েছে? ওদের নিয়ে কত গল্প, উপন্যাস, কাহিনী!
এই সোনাগাছি অনেকদিনই বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে।Donna Shallala আসবেন কলকাতায়, যাবেন ঐ সোনাগাছিতেই! সালটা সম্ভবত এই শতকের প্রথম বা বিগত শতকের শেষ বছর। সারা দুনিয়ার তখন আকর্ষণ Y2K, আর চিন্তা HIV/AIDS! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথাও তখন ঐ দুটি বিষয় নিয়েই। তখন করোনার কথা শোনা যায়নি অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এইডস অন্যতম স্বাস্থ্যসমস্যা। কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছে গবেষণায়, প্রতিষেধকের আশায়। বোঝান হচ্ছে গর্ভনিরোধক, সংযমের গুরুত্ব।
সাংবাদিকতার পাঠক্রমে একটি আপ্তবাক্য ছাত্রদের শেখানো হয় – You can hit the headlines, either by your good deeds, or bad deeds. আমাদের অর্থনীতি নেই, সোনাগাছি তো আছে। তাই সই! এমনিতেই মার্কিনিরা প্রচারের আলোয় থাকতে ভালবাসেন। একটা বিশাল সুযোগ তো পাওয়া গেল। কপালে চিন্তার ভাঁজও পড়ল। পারব তো?
মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে বিভিন্ন বিভাগ আছে। যাঁরা অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার সুত্রে একটা পর্য্যায়ে পৌঁছে যান তাঁদের মনে করা হয় বিশেষজ্ঞ। আমার ঘাড়ে বার্তা বিভাগের দায়িত্ব। সহকারি হিসেবে যাঁরা এসেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই অভিজ্ঞ সাংবাদিক। বসলাম তাঁদের সঙ্গে রণকৌশল ঠিক করতে। স্থির হল ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এবং দিল্লীস্থ মার্কিন দূতাবাসের অনুমোদিত যে সমস্ত materials আসবে তাই দিয়েই press release তৈরী হবে এবং পূর্ব ভারতের প্রধান যে ভাষাগুলি যেমন বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া, উর্দুতে অনূদিত হবে যাতে সব media houseএর কাছে সহজভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছে দেওয়া যায়। ইংরেজি, হিন্দি তো থাকবেই।
ওদিকে অনুষ্ঠান বিভাগে যিনি এই দায়িত্ব পেয়েছেন সেই সহকর্মিনীও যথেষ্ট দক্ষ এবং HIV/AIDS সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। হলিউড তারকা Richard Gereকে এই বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান করে খ্যাতিও লাভ করেছেন। সবাই যেন উত্তেজনার আগুনে ফুটছেন! ইতিমধ্যে Donna Shallalaর অনুমোদিত bio এবং ছবিও এসে গেছে। যত পড়ছি, ততই অবাক হচ্ছি। উচ্চশিক্ষিতা, কয়েকটি সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন শিক্ষাবিদ আচার্য্য হিসেবে। আবার দলীয় কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। এখনও। Google uncleও তাই বলছেন।
নাম দেখে বোঝা গেল যে ওঁর শরীরে আরবিয় রক্তও বহমান। যাইহোক D-Day তো এসে গেল। সাতসকালেই অনুষ্ঠান। আমরা তো যা করার করেইছি। সংবাদপত্রের অভিজ্ঞতায় দেখেছি সাংবাদিকরা বেশি রাত পর্যন্ত কাজে স্বচ্ছন্দ। সকালে ঘুম ভাঙতে দেরী হয়। সেজন্যই ভয় হচ্ছে ওঁরা আসবেন তো? দূর্গানাম জপতে জপতে সদলবলে বেরিয়ে পড়লাম।
Convoy অবশ্য চলল Central Avenue ধরেই। এর মধ্যেই অবশ্য ফোন আসতে শুরু করেছে – প্রশান্তদা তোমরা কোথায়? আমরা তো পৌঁছে গিয়েছি। মনে ভরসা ফিরতে শুরু করল। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে আরও বিষ্ময়ের বাকি ছিল। রাস্তার মুখেই বিশাল তোরণ, ফুলমালায় সাজানো। দুধারে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ওখানকার বাসিন্দারা। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ওপাড়ায় বিদেশী মন্ত্রী বলে কথা!
সোনাগাছির বাসিন্দাদের উন্নতিকল্পে যে অসরকারি সংস্থাটি দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছে, তার উপদেষ্টা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ওঁকে আগে থেকেই কর্মসূত্রে চিনতাম। আয়োজন ওই সমিতির অফিসঘরে। ছোট জায়গা, কয়েকটি চেয়ারপাতা, সামনের বড় টেবিলে ফুলদানি, মাইক্রোফোন। আন্তরিকতার ছোঁয়া সব জায়গায় দৃশ্যমান। এখানেও সার বেঁধে ওঁরা সাগ্রহে দাঁড়িয়ে। তবে ঘরে ওঁরা না যতজন, বাইরে তার চতুর্গুণ সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক।
এর মধ্যে মন্ত্রীর সঙ্গে আসা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। সবাইয়ের অনুরোধ মেনে আমি আর ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। ওঁদের একটাই দাবী – প্রশান্তদা, একটু আমাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দাও। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়ে গিয়েছে। মাল্যদান, পুষ্পস্তবক ইত্যাদির পরে বক্তৃতার পালা।
এরইমধ্যে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের হাতেও ওঁরা তুলে দিয়েছেন ফুল। আমার হাতেও একটি এল। একটু অন্যরকম রোমাঞ্চ, একটু বিষ্ময়! স্মৃতির ঘোর কাটতেই স্মরণে এল পরবর্তী দায়িত্বের কথা। সহকর্মীদের নিয়ে সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিলাম ঐ press releaseসহ আরও লেখার রসদ, যার মধ্যে মন্ত্রীর বক্তৃতার অনুমোদিত copyও রয়েছে। প্রায় ১০০ প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম। সব শেষ! এর পরই সশব্দে হাততালির মধ্যেই মন্ত্রী মহোদয়া ঘোষণা করলেন U.S. Agency for International Development (USAID)এর তরফে সমিতিকে আর্থিক সাহায্যদানের কথা।
সচিবের হাতে তুলে দিলেন চেক, প্রতীকি উপহারের প্যাকেট যার মধ্যে সম্ভবত গর্ভনিরোধক ছিল। এখন যেমন করোনার হাত থেকে বাঁচতে মাস্কের কথা, তখন এইডস এড়াতেও ঐ গর্ভনিরোধকই ভরসা। সেই বার্তা দিতেই সুদূর সোনাগাছিতেই এসেছেন!এরই মাঝে মন্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থার বেড়া ডিঙিয়ে ওঁর কানে পৌঁছে দেওয়া হল প্রতীক্ষমান সাংবাদিকদের আবেদন। ওঁরা একটু কথা বলতে চান।
মন্ত্রী মহোদয়া ঊচ্চতায় বেশি নয় কিন্তু সপ্রতিভতায় তাঁর কমতি নেই। কোঁকড়াচুলভর্তি মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখেই সম্মতি জানালেন। ধেয়ে এল নানা প্রশ্নের বাণ। অভিজ্ঞ রাজনীতিক। সবই সোজা ব্যাটে খেললেন। রাজ্যটা পশ্চিমবঙ্গ। মার্কিন বিনিয়োগের প্রশ্ন না এসে পারে? উত্তরে ইঙ্গিত ছিল কিন্তু সরাসরি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার উল্লেখ রইল না।
পুরোন সাংবাদিক সত্তায় গুরুদেবের গানটির কথা মনে পড়ল – মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে! হাজার হলেও রাজ্যবাসী তো! বিনিয়োগের আশ্বাস পেলে ভালো লাগত। ওঁদেরও ভাল story হোত। কি আর করা? এরই মাঝে মন্ত্রী গাড়ির দিকে রওনা হলেন। ওঠার মুখে হঠাৎ আমাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন – You people! You have done a great job!
হাসিমুখ দেখে বোঝা গেল অনুষ্ঠান এবং একই সঙ্গে এত সাংবাদিকের উপস্থিতিতে খুশী হয়েছেন। ওঁর গাড়ি ছেড়ে দিতেেই সহকর্মিণীও একগাল হেসে বললেন: প্রশান্ত্, আপনে তো আজ কামাল কর দিয়া! জীবনে বহু পরীক্ষা দিয়েছি। ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। আজকের পরীক্ষায়ও বোধহয় উৎরে গিয়েছি!
এখানেই উপসংহার টানলেই বোধহয় ভালো হোত। কিন্তু চিৎপুরের ট্রামযাত্রার গল্পকথা তো শেষ হোত না। আগেই বললাম একটু রোমাঞ্চ, একটু বিষ্ময়ের কথা। তার মুখোমুখি হতে হয়েছিল অনেক বছর আগে যখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পা দিয়েছি। গোঁফের রেখা একটু মোটা হয়ে দেখা দিয়েছে। নিজেকে একজন কেউকেটা ভাবতে আরম্ভ করেছি। মাসিমারা এসেছিলেন। তাঁদের পৌঁছতে হাওড়া ষ্টেশন যেতে হবে।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কি একা পারবি? সদর্পে উত্তর দিলাম, চিন্তা কোর না। ট্রামে, ট্রামেই তো ফিরব। ওঁদের জামশেদপুরের ট্রেনে উঠিয়ে ফিরে আসার সময় মাথায় ভুত চাপল। দেখি, বাবার মত হাঁটতে পারি কিনা? হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে, পোস্তা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম গনেশ টকিজ। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চিন্তাও হচ্ছে। মা বাড়িতে ভাবছেন।
তখন তো আর চলভাষ ছিলনা। চিৎপুর দিয়ে হাঁটছি। তখনও এ রাস্তার ওপর পাকাপাকি বাসিন্দা না হলেও এই ঐতিহাসিক রাস্তা আমায় বরাবরই টানে। চারদিক দেখছি আর নানা কথা ভাবছি। চতুর্দিক আলোয় ঝলমল করছে। অগুন্তি লোকজন। বিডন ষ্ট্রীটও পেরিয়ে গেল। তখনও মোহাবিষ্ট।
সম্বিত ফিরল হাতে এক হ্যাঁচকা টানে। টান দিয়েছেন মধ্যবয়ষ্কা এক কৃষ্ণকায়া, ক্ষীণাঙ্গী। মুখে চড়া রঙের প্রলেপ, চোখে কাতর আকুতি। নিতান্ত দুরবস্থার দ্যোতক! বুঝলাম কোথায় এসে পড়েছি। নইলে আমার মত বয়সীকে পাকড়ায়? কোথায় রোমাঞ্চ? কোথায় বিষ্ময়? আমিও ততোধিক জোরে হাত ছাড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম। নিজের বুকের ধুকপুকুনির আওয়াজ নিজেই শুনতে পাচ্ছি।
মনে একরাশ ভয়। কেউ দেখে ফেলেনি তো? সেই আমার প্রথম চিৎপুরে চলন্ত ট্রামে চড়া। উল্টোপথে দৌড়োচ্ছিল গাড়ি। কোথায় যাবে জানি না। উঠে তো পড়লাম। শীতের দিন। তাও ঘেমে স্নান করে উঠেছি। বৃদ্ধ কন্ডাক্টর লক্ষ্য করেছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা কি হয়েছে? তখনও ধুকপুক অবিরাম। ওঁকে উল্টে জিজ্ঞাসা করলাম, এ গাড়ি কোথায় যাবে? শ্যামবাজারে নেমেই বাড়ির পথে আবার হনহন হাঁটতে শুরু করলাম। গন্তব্য বাগবাজার।
বাবা তখনো অফিস থেকে ফেরেননি। মার মুখে উদ্বেগ। সবার কাছে গোপন করা যায়। মায়ের চোখ এড়ান মুস্কিল! বললাম, একগ্লাস জল দাও। বলছি। সব শুনে কিছু বললেন না। কেন বললেন না এখনো বুঝিনি। একটাই প্রশ্ন করলেন: আর এভাবে যাবি? নিয়তি কেন বাধ্যতে। তখন কি জানতাম বহুবছর পরে কর্মসুত্রে আবারও যেতে হবে। ওপাড়ায়!
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)