(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)
হীরক কর : তিনি কলকাতার প্রথম গোয়েন্দা। আমাদের ফেলুদা-ব্যোমকেশ নয় কিন্তু। জয়ন্ত-মানিক বা গার্গীও নন। কারণ, এই গোয়েন্দা বাঙালিই নন। তবে তাঁর অবদান কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইতিহাসে অপরিসীম। একপ্রকার বলা যায় এঁর হাত ধরেই শুরু হয় কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট বা ‘ডিডি’ । তিনি হলেন কলকাতা পুলিশের প্রথম সরকারি গোয়েন্দা। তাহলে চলুন যাওয়া যাক সেই কলোনিয়াল কলকাতার সময় কালে। তখনই কলকাতার অলিতে গলিতে ঘটছিল অপরাধ আর সেই সময়েই আবির্ভাব হয় ওই গোয়েন্দার।
১৮৬৮ সালের পয়লা এপ্রিল। তখন কলকাতার চেহারা আজকের মতো ছিল না। ইংরেজরা একটু একটু করে তৈরি করছে তাদের প্রাণের রাজধানীকে। তবুও রাতের বেলাটা শুনশান, বেরোতেও ভয় করে। এমনই এক রাতে টহল দিচ্ছে একজন পুলিশ কনস্টেবল। কাছেই আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার আলো দেখা যাচ্ছে। বসন্তের হাওয়া তখনও যায়নি। বেশ নিশ্চিন্ত মনেই হাঁটছিলেন ওই পুলিশ কর্মী। হঠাৎ টনক নড়ল তাঁর। একটু দূরে রাস্তার ধারেই কিছু একটা বস্তার মতো পড়ে আছে মনে হচ্ছে। সন্দেহ হতেই সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। বস্তা নয়, সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা। আরেকটু কাছে যেতেই চমকে উঠলেন পুলিশ কর্মীটি। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে দৌড় দিলেন থানার দিকে। তিনি দেখতে পেয়েছেন, সাদা কাপড়ের গায়ে লেগে আছে টাটকা রক্ত। আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে একটি দেহ— এক তরুণীর নিথর, গলাকাটা দেহ ।
কয়েক বছর আগেই লর্ড ডালহৌসি কলকাতা পুলিশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একটু একটু করে পুলিশি ব্যবস্থাকে গোছানোর চেষ্টা চলছে। তার মধ্যেই এমন একটি ঘটনা! পুলিশমহলে চাঞ্চল্য পড়ে গেল। শুধু পুলিশ মহলেই নয়, কলকাতার প্রতিটা জায়গায় শুরু হল জল্পনা। খবরের কাগজগুলোতে বেরিয়েছে ঘটনা ও মৃতদেহের বর্ণনা। মেয়েটির গলা কাটা, মুখ খোলা, চোখদুটো বাইরে বেরিয়ে আসছে। একটি হাত কোমরের পেছনে বেঁধে রাখা। ঘটনাস্থল ভেসে যাচ্ছে রক্তে। এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে এবং পড়ে শিউরে উঠছেন সবাই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটা খুন।
সেদিন রাত থেকেই যেন ঝড় উঠল কলকাতার অন্দরে। হত্যাকাণ্ড এই শহরে নতুন কিছুই ছিল না, তবে তাদের বেশিরভাগই ছিল নিত্যকালের ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটের ঘটনা। কোনো মাতাল হয়ে যাওয়া একদল লোকের তর্কবিতর্ক কিংবা কোনো খারাপ গ্যাঙের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল অথবা রাজনৈতিক কোনো ষড়যন্ত্রের ফলাফল। কিন্তু এমন ঘটনা যে একটি পুলিশ স্টেশনের এত কাছাকাছি একজন সুন্দরী মহিলার ভয়াবহ হত্যা, এমনটা এই প্রথম ঘটল। আর এই ঘটনাই হয়ে উঠেছিল সমগ্র কলকাতার আলোচনার কেন্দ্র। চর্চা শুরু হল প্রতিটা বাড়ির অন্দরমহলেই। সে মধ্যবিত্ত হোক কিংবা উচ্চবিত্ত। মুহূর্তে খবরটি উঠে এল প্রতিটা সংবাদপত্রের শিরোনামে। কিন্তু এভাবে কলকাতার রাস্তায় কাউকে খুন করে ফেলে রাখার ঘটনা তো সেভাবে ঘটেনি! যা হয়েছে সেসব গুন্ডা-ডাকাতদের মারামারি অথবা রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা। অনেক সময় মাতালদের দেহও এভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
কিন্তু তাই বলে এমন অল্পবয়সী মেয়েকে খুন ? ঘটনার এক সপ্তাহ পরেও আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার পুলিশ মৃত মহিলাকে শনাক্ত করতে পারেনি। তার ছবি প্রকাশিত হয় শহরের প্রতিটি বড় পত্রিকায়। তবুও লাভ বিশেষ হল না। পাবলিক-মিডিয়া উভয়েরই সমালোচনার মুখে পড়ল কলকাতার পুলিশি ব্যবস্থা। কথা উঠল নাগরিকদের সুরক্ষা নিয়ে।
এই পরিস্থিতিতে কাঁহাতক নিজেকে সামলাতে পারতেন পুলিশ কমিশনার স্যার স্টুয়ার্ট সান্ডার্স হগ? পরবর্তী সময়ে এই হগের নামেই নামকরণ হয় হগ মার্কেটের, যা আমাদের কাছে নিউ মার্কেট নামে পরিচিত।
সেই হগ সাহেবও তাঁর ধৈর্য হারিয়েছিলেন, ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন নিজের অধস্তন সেই অফিসারদের প্রতি যাঁদের তত্ত্বাবধানে ছিল এই কেস। কমিশনার হগ উপলব্ধি করলেন এই জটিল কেস সমাধানের জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কারণ হত্যার রহস্য সমাধানের ব্যর্থতা যে কেবল তাঁর নিজের নেতৃত্বের দুর্বলতাকেই প্রমাণ করবে তা নয়, সমগ্র পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠবে। অতএব এমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পুলিশ স্টেশন এবং তার এক্তিয়ারের বাইরেও কোনো প্রতিষ্ঠান, যা কোনো নির্দিষ্ট থানার উপর নির্ভর করবে না। অস্বাভাবিক ও জটিল অপরাধ সমাধান করতে যে কোনো সময়ে এগিয়ে আসবে এমন একটি দল গঠন করতে হবে। যে দল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হলেও তাদের কাজ থাকবে বিশেষভাবে জটিল কেসের জন্যই।
পুলিশ কমিশনারের স্টুয়ার্ট হগের নির্দেশে বিশেষ একটি দল গঠন করা হল। আর এই পুরো ঘটনার তদন্ত করার প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হল রিচার্ড রীডকে। ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহসী এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার জন্য হগ সাহেবের প্রিয় অফিসার ছিলেন তিনি। শুরু হল ‘আমহার্স্ট স্ট্রিট হত্যা রহস্যে’-র তদন্ত। তদন্তে এসে রীড সাহেব প্রথমেই তরুণীর পরিচয় জানার চেষ্টা শুরু করলেন। এই হত্যাকাণ্ডেই প্রথমবার এভিডেন্স ফটোগ্রাফিকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়। রিচার্ড রীড প্রথমেই বুঝলেন, এই তরুণী একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। অসম্ভব সুন্দরী, বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি-বাইশের মধ্যেই হবে। কিন্তু কে এই তরুণী ? কীভাবে মারা গেলেন ? উঠে পড়ে লাগলেন রীড।
দেহ দেখে বেশ কয়েকটি জিনিসের দিকে চোখ গেল তাঁর। প্রথমত যেভাবে গলাটা কাটা হয়েছে, তা একটি বিশেষ ধরনের ছুরির সাহায্যেই করা হয়েছে, সাধারণত যাকে ‘সেলর’স নাইফ’ বলা হয়। দ্বিতীয়ত, তরুণীর পায়ে চটি বা জুতো কিছু ছিল না। আর পায়ের পাতায় মাটি, ধুলো কিছুই লেগে ছিল না। একেবারে পরিষ্কার পা। তাহলে তো ইনি রাস্তায় হাঁটছিলেন না। তাহলে কি খুন অন্য জায়গায় হয়েছে, তারপর দেহ এনে আমহার্স্ট স্ট্রিট চত্বরে ফেলা হয়েছে? সন্দেহ সেইদিকেই জোরালো হচ্ছিল। সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিসের দিকে নজর রেখেছিলেন রিচার্ড রীড। এই হত্যাকাণ্ডের আগে, ১৮৬৮ সালেই আরও পাঁচজন মহিলাকে খুন করা হয়। তার মধ্যে তিনজন বারবণিতা। এই হত্যার সঙ্গে কি আগের খুনগুলোর কোনো যোগ আছে ? রীড ঠিক করলেন, মেয়েটির মৃতদেহের ছবি শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে দেবেন। কেউ না কেউ তো ঠিকই চিনতে পারবেন। এর আগে এমন পদ্ধতির প্রয়োগ ভারতে হয়নি।
কেটে গেল বেশ কয়েক সপ্তাহ। এখনও কেউ মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজ করতে থানায় এল না। সবাই অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। রীড সাহেব অবশ্য শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ দেখা গেল আলোর সন্ধান। একদিন মিঃ হ্যারিস বলে একজন হাজির হলেন থানায়। থাকেন বৈঠকখানা রোডে। বললেন, ছবির মেয়েটিকে চিনতে পেরেছেন তিনি। ওঁর নাম রোজ ব্রাউন। খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। বয়সের ব্যাপারটাও ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন রীড। এবং আরও আশ্চর্যের, এই মেয়েটিও বারবণিতা। তবে এখানেই থেমে থাকল না ব্যাপারটা। হ্যারিস বলে ভদ্রলোক জানালেন, মাধবচন্দ্র দত্ত বলে কোনো একজনের সঙ্গে নাকি বেশ কয়েকবার দেখেছেন রোজ ব্রাউনকে ।
এই ‘মাধবচন্দ্র দত্ত’-এর ঠিকানা বের করতে দেরি হল না বেশি। বউবাজারে তাঁর দোকান। সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হল তাঁকে। সেইসঙ্গে রীড এবং বাকি পুলিশের হাতে উঠে এল আরও একটি তথ্য। রোজ ব্রাউন নাকি প্রায়শই হাওড়ায় কারোর একটা বাড়িতে যেতেন। কার বাড়ি ? জানা গেল, কিংসলে নামের এক গুন্ডার সঙ্গে নাকি একটা সম্পর্ক ছিল রোজের। ওঁর বাড়িতেই নাকি থাকতেন একটা সময়। তবে খুন হওয়ার মাস কয়েক আগে সেখান থেকে চলে আসেন তিনি। তাঁর এও ভয় ছিল, কিংসলে তাঁকে বাঁচতে দেবে না।
যথারীতি হাওড়ায় হানা দিল কলকাতা পুলিশের একটি দল। কিংসলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, পাখি ফুড়ুৎ! ভেতরে একটি জামা, কিছু মেয়েদের জামা-কাপড় পড়ে আছে। আর সেই জামাকাপড়ে রক্তের দাগ! রহস্যের গন্ধ প্রকট হচ্ছে। আরেকটু খুঁজে দেখা যাক! শেষমেশ একটি চাবি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। কিংসলে’র ওপরেই সন্দেহ গাঢ় হল সবার। তাঁকে ধরার জন্য সব জায়গায় জাল ছড়ালেন রীড। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে, সে যেন গায়েবই হয়ে গেছে! তবে তদন্তের শেষ দেখে ছাড়লেন রিচার্ড রীড। তিনিও যে দক্ষ গোয়েন্দা ।
এই তদন্তই রিচার্ড রীডকে অন্য স্তরে নিয়ে গেল। কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ বুঝলেন, কলকাতা পুলিশের বাইরেও এই গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগাবেন। ১৮৬৮ সালেরই নভেম্বর মাসে চালু হল কলকাতা পুলিশের আলাদা একটি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট । পরবর্তীকালে যার সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্বও পেয়েছিলেন রিচার্ড রীড। একের পর এক তদন্তের সমাধান করে তিনি তখন ভারতের গোয়েন্দা সেনসেশন। বলা ভালো, রিচার্ড রীডই ছিলেন খাতায় কলমে কলকাতা শহরের প্রথম গোয়েন্দা। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটীদেরও বহু বছর আগে।
পুলিশের কাজ করতে করতে অনেক গোয়েন্দা অফিসারকেই নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এক একটা ঘটনা গায়ের রোম খাঁড়া করে দেয়। তাঁদের অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতা, তদন্ত প্রক্রিয়া লিখে রেখেছিলেন। এই কথা বলতে গিয়ে আমাদের মনে পড়বে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘দারোগার দফতর’-এর কথা। কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারের তদন্ত প্রক্রিয়াও সেখানে উঠে এসেছে। তাঁরও আগে রিচার্ড রীডও এমন কাজ করেছিলেন। নিজের গোয়েন্দা জীবনের সমস্ত ঘটনা লিখেছিলেন ‘এভরি ম্যান হিস ওন ডিটেকটিভ’ বইতে। রোজ ব্রাউনের হত্যারহস্যের উল্লেখও পাওয়া যায় সেখানে। যার পরতে পরতে হেঁটে বেড়ায় পুরনো, গা ছমছমে কলকাতা আর এক দুর্ধর্ষ ইংরেজ ডিটেকটিভ। কলকাতা শহরের প্রথম গোয়েন্দা প্রধান ।