হোমফিচারসুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে সেদিন কী হয়েছিল?

সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে সেদিন কী হয়েছিল?

সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে সেদিন কী হয়েছিল?

দীপ হালদার (Deep Halder)

দীর্ঘদিন আগে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই মরিচঝাঁপিতে বসবাসকারী পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের চিতায়ন পর্ব শুরু হয়।এই চিতায়ন পর্ব ঘিরে সারা দেশে এবং বিদেশে অনেক বিতর্ক মাথা চাড়া দেয়। মরিচঝাঁপির অপারেশনের সময় সাংবাদিকদের সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি। অভিযোগ, উদ্বাস্তুরা জঙ্গল কেটে বসতি বানিয়েছিল বেআইনিভাবে। পুলিশ সেই বসতি ভেঙ্গে দেয়, বহু মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। অজস্র মানুষ আজও নিখোঁজ । সরকারিভাবে সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো সেকথা খুব অস্পষ্টভাবে জানানো হলেও পূনাঙ্গ কোনো রিপোর্ট আজও অপ্রকাশিত। এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক দীপ হালদার। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি।

(During the first left front government thousands of Refugees from Bangladesh came there and settled in an Island surrounded by tigers and forest.It is alleged, that occupiers destroyed the forest to build up there settlement. State police was asked by the govt. to vacate the land. Police swang into action, journalists were not allowed to report or visit that place. It created massive controversy through out the country and internationally also. The writer Deep Haldar spent long years to find out what happened there. Our Correspondent Sanjukta Sarkar spoke exclusively in an interview with Mr. Halder.)

মরিচঝাঁপি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা এক নাম। অথচ শব্দটা আর সময়টা কানে এলে কিছু মানুষের চোখে আজও ভেসে ওঠে রাজনৈতিক হিংসার বীভৎস ছবি! তাঁদের বুক আজও কেঁপে ওঠে।সে সময় গোটা বাংলার কাছে মরিচঝাঁপি এক হিংশ্র অধ্যায়। এক কালো সময়। যেদিন বাংলাদেশ থেকে আসা দলিত, হিন্দু, উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদের নামে রীতিমতো সুপরিকল্পিতভাবে, সরকারি মদতে এই বাংলার বুকে সংগঠিত হয়েছিল এক তান্ডব। পুড়েছিল হাজার মানুষের ঘর! নির্বিচারে চলেছিল ধর্ষণ! নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চলেছিল অকথ্য অত্যাচার।পুলিশের গুলি থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও! সি এ এ এবং এন আর সি নিয়ে আজ যখন গোটা দেশ উত্তাল, ‘অনুপ্রবেশ’, ‘শরণার্থী’, ‘উদ্বাস্তু’ ইত্যাদি শব্দগুলো যখন বার বার কানে ধাক্কা খাচ্ছে, ঠিক সেই সময় ইতিহাসের পর্দা সরিয়ে একবার কী জানতে ইচ্ছে করে না ঠিক কতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন মরিচঝাঁপি দ্বীপে? কেনই বা এতো বছর পরেও জানা যায় না মৃতের সঠিক সংখ্যা? কেন এতো সংগঠিতভাবে, রীতিমতো অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক অবরোধ করে, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তদানীন্তন শাসকদলকে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে দমন করতে হলো কিছু খড়কুটোহীন নিরীহ মানুষকে? ঠিক কেন সেদিন নৃশংসতার চূড়ায় পৌঁছেছিল অত্যাচার? কী কারণ ছিল এর পেছনে? কী অপরাধ ছিল ওই মানুষগুলোর? । আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এক জানুয়ারী মাসেই সুন্দরবন অঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে সেদিন তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে সংঘটিত হয়েছিল যে ‘তথাকথিত’ উদ্বাস্তু উচ্ছেদ প্রক্রিয়া , সেই রহস্যময় অধ্যায়ের পর্দা কী কোনোদিনও খুলবে না? ১৯৭৯-র জানুয়ারি থেকে মে, মাত্র কয়েক মাসেই এক শ্মশানভূমি হয়ে গিয়েছিলো সুন্দরবনের “মরিচঝাঁপি”। লাশের পর লাশ সেদিন ভেসে গিয়েছিলো কোরানখালি নদীর জলে। রক্তে লাল সেই দ্বীপের যন্ত্রণার কাহিনী কী কালের অমোঘ নিয়মে তলিয়ে যাবে? আজকের প্রজন্ম কী কোনোদিনই জানবে না এই নৃশংস হত্যার উপাখ্যান।এই সব প্রশ্নই উঠে এসেছে সাংবাদিক দীপ হালদারের লেখা “ব্লাড আইল্যান্ড : আন ওরাল হিস্ট্রি অফ দ্য মরিচঝাঁপি ম্যাসাকার” বইটিতে।

Cover of the book book — Blood Island: An Oral History of the Marichjhapi Massacre.

ছেলেবেলায় রূপকথার রাজা-রানী-রাজকন্যার গল্প, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প শোনার বয়সেই সেই সব অন্ধকারের গল্প শুনে ফেলেছিলেন দীপ।আর সেই গল্পই পিছু ছাড়েনি বছর পাঁচ-ছয়ের শিশুমনকে। তাই সবটা বয়ে নিয়েই বড়ো হওয়া। আর শোনা গল্পের সত্যতা যাচাই করতে গিয়েই আরও আরও গল্প শোনা। মরিচঝাঁপির সেই অন্ধকার অধ্যায় থেকে বেঁচে ফেরা মানুষগুলোর মুখে শোনা সেসব গল্পই এক তাগিদের মতো কাজ করেছে এই বই লেখার পেছনে। জানালেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক দীপ হালদার। অন্ধকার অধ্যায়ের পাশাপাশি মরিচঝাঁপি দ্বীপের এক অজানা আলোর গল্পও উঠে এসেছে দীপের কলমে। এক জঙ্গল ঘেরা দ্বীপ কীভাবে বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল চোখের নিমেষে তার দস্তাবেজও চোখ টানে বই কী!

ঠিক কীভাবে দীপের ছেলেবেলার অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছিল এই “মরিচঝাঁপি” ?

দীপ : আমি তখন পাঁচ কী ছয়। ঘুমপাড়ানি গল্পের মতোই আমার জীবনে ঢুকে পড়েছিল “মরিচঝাঁপি”। ওখান থেকে পালিয়ে আসা মনা গোলদার ও তার
পরিবার সেই সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে। কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না তখন। আমাকে বলা হয়েছিল, মানা আমার দূরসম্পর্কের দিদি। আমিও সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম। মানার বাবা, রঙ্গলাল গোলদার আমার বাবার পরিচিত ছিলেন। সেই সময় যে সব বুদ্ধিজীবী , কবি, সাহিত্যিক মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন , আমার বাবা ছিলেন তাঁদের একজন। সেই সুবাদেই মানা ও তার পরিবার বিপদের দিনে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের বাড়িতে। এই মানার মুখেই আমি শুনেছিলাম মরিচঝাঁপির সেই সব রোমাঞ্চকর গল্প। যার পরতে পরতে ছিলো অ্যাডভেঞ্চার আর উত্তেজনা। বহু প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে সাহস আর দৃঢ়তাকে সঙ্গী করে গড়ে তোলা এক সমাজ আর তার নির্মমভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার গল্প। মৃত্যু মিছিলের আর ধর্ষণের গল্প, রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার আর পুলিশি অত্যাচারের গল্প। কী বুঝেছিলাম, কতটা বুঝেছিলাম জানি না। কিন্তু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলো এই গল্পগুলো। আর এতটাই যে বড়ো হয়েও আমায় তাড়া করে বেড়াতো সেইসব ‘বেড-টাইম স্টোরিজ’।

Jyotirmoy Mandal, a survivor of Marichjhapi.

ঘটনার শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের মতে, শুধু পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখাটাই আসল কারণ নয়। আসলে মরিচঝাঁপির মরিয়া মানুষগুলোর সাহস ও সংঘবদ্ধ হয়ে যাওয়াটাই তদানীন্তন সরকারের ভয়ের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল। আপনি কী মনে করেন?

দীপ : হ্যাঁ , একথা সত্যি। আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি এই বই লেখার সূত্রে , তাঁদের সবার
মতে, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তাঁর দলের সদস্যরা এইভাবে কতগুলো বাস্তুহারা মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোটা মেনে নিতে পারেননি। রাজ্য সরকারের সাহায্য ছাড়াই এভাবে ভৌগোলিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রতিকূলতাকে হেলায় হারিয়ে ঘরছাড়া মানুষগুলোর জিতে যাওয়াটা একেবারে সহ্য হয়নি তাঁদের। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো সেদিনের সেই নৃশংস গণহত্যায়। মরিচঝাঁপির মানুষগুলো স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছিল। আর তাতেই চরম আঘাতের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁদের। রাজ্য বামফ্রন্ট রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েছিল বাংলাদেশী, দলিত, ভিটেহীন, চালচুলোহীই এই মানুষগুলোর সাহসে।

আপনি কী মনে করেন সেই সময়কার শিক্ষিত বাঙালি সমাজের নীরবতাও কোনোভাবে এই গণহত্যার অধ্যায়ের পেছনে পরোক্ষভাবে দায়ী?

দীপ: অবশ্যই। ‘মরিচঝাঁপি’ বাঙালি তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের স্বরূপ দেখিয়ে দিয়েছিলো। যে ঘটনা, যে গণহত্যা সম্ভবত স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো গণহত্যা, তাতেও বর্ণ, শ্রেণী সচেতন বাঙালি সেদিন মুখ বুজে দর্শকের আসন নিয়েছিল। যে বাংলার গর্ব ছিল সত্যের পথে চলার, ন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর, যে অহংকার ছিল, বাঙালির সেই অহংকার সেদিন অন্ধকার, লজ্জার এক অধ্যায় দেখেছিলো। চুপচাপ। ভুলে গেলে চলবে না আর্থিকভাবে শূন্য তো বটেই, এই মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগই ছিলেন নমশূদ্র ও অন্যান্য তথাকথিত নিচু তলার মানুষ।হয়তো সেই জন্য তাঁদের জীবনের দাম ঠিক ততটা মূল্যবান ছিল না সেদিন এই বাংলার ‘শিক্ষিত’, ‘সৎ’, বাঙালির কাছে।

আপনি বলেছেন প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছে বইটি শেষ করতে।এতটা সময় লাগার পেছনে ঠিক কারণটা কী? ঠিক কী কী সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে আপনাকে?

দীপ :
বড় হয়ে যখন কলকাতায় এসে সাংবাদিকতা করছি, তখনই মরিচঝাঁপির ঘটনায় বেঁচে ফেরা মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাঁদের কাছ থেকে ছোটবেলায় শোনা গল্পগুলোর সত্যতা যাচাই করার নেশা চেপে বসেছিল মাথায়।আর সেখান থেকেই বই লেখার সূত্রপাত। তবে প্রায় চল্লিশ বছর আগে তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই চরম দুর্ঘটনা, স্বজন হারানোর সেই যন্ত্রণাময় অধ্যায়ের ওপরে অনেক কষ্টে রাখা পর্দা সরানোর কাজটা একেবারেই সহজ ছিল না।প্রথমতঃ তাঁদের খুঁজে বের করাটা সহজ ছিল না। আর দ্বিতীয়ত তাঁরা কেনই বা আমাকে বিশ্বাস করে বলবেন , সেদিনের সেই রাজনৈতিক হিংশ্রতার কাহিনী। সেই বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি করতেও সময় লেগেছিলো বেশ।

এই বইতে পাওয়া যায় সেদিন রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল মরিচঝাঁপি নিয়ে, যাতে সংবাদপত্রে কোনোভাবেই কোনও সহানুভূতিশীল খবর প্রকাশিত না হয়। প্রভাব পড়েছিল জাতীয় সংবাদ মাধ্যমেও।বইটি আলো ফেলেছে সেই দিকেও। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

দীপ :
বইটি লেখার সময় দুজন নামী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় আমার। তাঁরা দুজনেই নিজেদের মতো করে মরিচঝাঁপি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরা হলেন, নিরঞ্জন হালদার ও সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত। সুখরঞ্জনবাবু আনন্দবাজার পত্রিকায় এই নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখাও বের করেছিলেন। যদিও তাঁদের এইসমস্ত লেখালেখি বন্ধ করতে কাল বিলম্ব হয়নি।এমনকি মরিচঝাঁপি বিট থেকে সরিয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয় নিরঞ্জনবাবুকে। জাতীয় সংবাদমাধ্যম ও আশ্চর্যজনকভাবে উদাসীন ছিল এই খবরে। যদিও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও মরিচঝাঁপির উল্লেখ হয়।

এমন কোনও অভিজ্ঞতা যা এই বইটি লিখতে গিয়ে আপনাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলো?
দীপ :
বহুবছর পরে মানার সঙ্গে দেখা করা এবং সেই ছোটবেলার গল্পগুলো আবার নতুন করে শোনা এবং ঠিক কীভাবে কতটা ভয়াবহ আর কতটা নৃশংস ছিল , তাঁর রক্তাক্ত স্মৃতি, তা বোঝাটাই ছিল একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আর সুন্দরবনের সেই valoই দ্বীপ, মরিচঝাঁপির মাটিতে পা রাখাটাও ছিল এক হাড়হিম করা মুহূর্ত, যেখানে আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘন জঙ্গল আর সেই অন্ধকার জঙ্গলের মাঝে এক ফরেস্ট অফিস আর শূন্যতা ছাড়া। অথচ আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, গল্পে শোনা সেই পথ ঘাট, স্কুল, বাড়িঘর আর কুয়োতলা। দেখতে পাচ্ছিলাম সেই মানুষগুলোকেও, যাঁরা এক আলোর ছবি আঁকার চেষ্টা করেছিল অন্ধকার অরণ্যের বুকে। ঘরছাড়া মানুষ স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছিলো। আর শাসকগোষ্ঠী তথা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যে স্বপ্নের গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল।

সাক্ষাৎকার ভিত্তিতে লিখেছেন সংযুক্তা সরকার।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img