তীর্থঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
(জীবন আর বহমান নদীকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার সময়ে সাহিত্য আর বিজ্ঞানের কথাও আনলেন প্রবাসী একদা বিবিসি-র সাংবাদিক তীর্থঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন তিনি লন্ডন প্রবাসী। এই অসাধারণ মননশীল প্রবন্ধটি লিখেছেন শুধুমাত্র এই পোর্টালের জন্যই।)
Technopoly শব্দটা সবে শুনেছি। অভিধান ঘেঁটে দেখলাম, অর্থ প্রযুক্তির পূজন। জেনেই প্রথম মনে হলো বিশ্বকর্মার কথা। দেবতাদের মধ্যে উনি কি টেকনোক্র্যাট?
আমার কাজের জায়গায় Edward Wells-কে সবাই Eddie বলে ডাকেন। আমি বলি বিশ্বকর্মা। হেন কাজ নেই যা ওর আয়ত্তে নেই। বোর্ড লাগাতে হবে। ফার্নিচার সরাতে হবে। প্রিন্টারে গোলমাল। স্মার্টবোর্ড কাজ করছে না। আমার বিশ্বকর্মা সবেতেই সিদ্ধহস্ত। এবং হাসিমুখে। দরকার পড়লে বাড়িতে এসেও লাইট লাগিয়ে দিতে পারেন।
বিশ্বকর্মার সবচেয়ে বড় গুণ হাসিমুখ আর ওর humility। বিনয় শব্দ দিয়ে বোধহয় ওর humility বোঝানো সম্ভব নয়। প্রিন্টারের কাগজ দিতে এলে একটা বাড়তি রিম চুপিসারে আমার ডেস্কের তলায় রেখে যায়। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যায়, “কাজে লাগবে”।
Technopoly শব্দটা জেনেছি E M Forster-এর বিখ্যাত নভেলা The Machine Stops পড়তে গিয়ে। ২০১৮ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে লন্ডন ফেরার সময় এক মার্কিন সহযাত্রী নভেলার নামটা পরোক্ষে কর্ণগোচর করিয়ে দিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে লন্ডন ফেরার ফ্লাইটে নিজের উইন্ডো সিটটা আমাকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, “বাইরে তাকিয়ে দেখুন, আপনার একটু ভালো লাগতে পারে।” কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার সময় উনি লক্ষ্য করেছেন, আমি সারাটা সময় চোখ বন্ধ করে ঘাড় এলিয়ে বসেছিলাম। তার সাথে আমার মন্ডিত মস্তক – সবমিলিয়ে গুরুদশার ইঙ্গিতটা বোধহয় তখনই পেয়েছিলেন।
The Machine Stops ভাস্তি আর কুনোর কাহিনী। আমার সহযাত্রী Liam Smith, Forster-এর লেখা গল্পটা বলতে চাননি। শুধু উল্লেখ করেছিলেন মাত্র। বলেছিলেন, শরীরটাও একটা যন্ত্র যা কালের নিয়মেই একদিন স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মানে জীবন শেষ হয়ে যায় না। জীবন চলতে থাকে তার নিজের নিয়মে।
জগদীশ বোস-এর লেখা “ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে” রচনাটিতে রয়েছে “নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ, কোথায় বহিয়া যাও।” জীবনও বোধহয় তেমনই। জাগতিক মৃত্যু তাকে বশ করতে পারে না।
Wye নদীর পাশে Tintern Abbey-তে গিয়ে আমার নালন্দার কথা মনে হলো। দুটো জায়গার মধ্যে খুব মিল। আশপাশের কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় Wye তার গৌরবের দিন হারিয়েছে। তাও বহতা নদী অক্লান্ত। গায়ে কাশফুলের মতো বড় বড় ঘাস যেন তার একান্তের অলঙ্কার। নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জনৈক সহযাত্রী William Wordsworth- এর লেখা “Lines composed a few miles above Tintern Abbey”-র কথা বললেন। আগে শুনিনি কবিতাটা। পরে পড়তে গিয়ে দেখলাম, ১৭৯৮ সালের জুলাই মাসে লেখা অথচ চিরন্তন।
জুলাই-আগস্ট মাসে লন্ডনে থাকলে আমরা টেমস‘র পাড় ঘেঁষে হাঁটতে যাই। ব্রেন্টফোর্ড, আইসেলওয়ার্থ,
টুইকেনহ্যাম, হ্যাম্পটন, কিংস্টন। সর্বত্রই নদী নিজের মর্জিমতো পথ করে নেয়। কে কী বললো, কী করলো, কোনোকিছু নিয়েই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একবার ইচ্ছে আছে টেমস-হেড যাওয়ার। টেমস নদীর উৎসমুখ। গঙ্গোত্রী বা যমুনোত্রীর মতো adventurous নয়। শুনেছি একগুচ্ছ ঝর্ণা। এর মধ্যে এক বা একাধিক জলস্রোত থেকেই টেমস নদীর সূত্রপাত।
কেদারনাথ যাওয়ার সময় গৌরীকুন্ড থেকে হাঁটাপথ। অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল গৌরীকুন্ডের কথা ভাবলে এখন মনে হয়, নদীর কোনো অন্ত বা মৃত্যু নেই। সে শুধুই বয়ে চলেছে অনন্তের উদ্দেশ্যে।
Thomas Alva Edison আধুনিক বিশ্বে technopoly-র অন্যতম প্রধান ঋত্বিক। আমাদের জীবনে যা কিছু স্বাভাবিক এবং given বলে মনে হয়, তার অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছে টমাস এডিসনের বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, উদ্যোগ এবং দূরদর্শিতায়।
Edison: Inventing the Century-র লেখক Niel Baldwin লিখেছেন, “Hours before his death, Edison emerged from a coma, opened his eyes, looked upwards and said: “It is very beautiful over there.”
ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের শোকস্তব্ধ পরিবারগুলোর অবস্থা দেখে এডিশন Spirit Phone নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন। প্রয়াতদের সাথে কথা বলার জন্যই এই দূরভাষের কল্পনা। মৃত্যুর পরে টমাস আলভা এডিসনের সেই উদ্যোগ সফল হয়েছে কিনা জানা নেই।