(কবি শঙ্খ ঘোষ। আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। জন্ম ওপার বাংলার চাঁদপুরে। ১৯৩২-এর ৫ ফেব্রুয়ারি। ৯০ বছরে পা দিলেন বাঙালির প্রিয় এই কবি। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করলেন বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার।)
শঙ্খদার সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৫ সালের প্রথমদিকে। চক্ষু-চিকিৎসক হিসাবে নিজের কর্মক্ষেত্রে তখন আমার দিনগুলি কাটছে চূড়ান্ত ব্যস্ততায়। তারই মধ্যে প্রায় আড়াই বছরের পরিশ্রমে শেষ করে ফেলেছি আমার স্বপ্নের প্রকল্প, রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গানের ডিজিটাল সঙ্কলন, গীতবিতান আর্কাইভ।
প্রথম থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল শঙ্খদাকে আমার কাজটা দেখিয়ে অনুরোধ করব একটা ভূমিকা লিখে দেবার জন্য। কিন্তু প্রথমত উনি আমাকে চেনেনই না, তাছাড়া আমার মত সামান্য মানুষের জন্য কেনই বা নষ্ট করবেন তাঁর মূল্যবান সময়। তবুও দ্বিধা আর সংশয়ের সঙ্গে একদিন ল্যাপটপ নিয়ে চলেই গেলাম ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের তিন তলার বাসাটিতে।
বলাবাহুল্য আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাই ছিল। একটু দোনামনা করে কলিংবেলের সুইচ টিপবার মিনিট দুয়েকের মধ্যে নিভাজ সাদা ধুতিপাঞ্জাবী পরা, সৌম্যদর্শন শঙ্খদা নিজেই দরজা খুলে বললেন, ‘আসুন’। কথাটার ভিতর এমন এক অকৃত্রিমতার ছোঁয়া ছিল, যা একনিমেষে আমার মনের সমস্ত সংকোচ দূর করে দিল।
প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। ভেবেছিলাম মানুষটি হয়ত অত্যন্ত গম্ভীর আর দুচার কথা বলেই আমাকে বিদায় করে দেবেন। কিন্তু না। ডানদিকের ছোট্টো ঘরটায় বসতে দিলেন, ওঁনার সামনের চেয়ারে। ঘরে আরও কয়েকজন ছিলেন। সারা দেওয়াল জোড়া আলমারিগুলো বইয়ে ঠাসা, ডিভান আর টেবিলেও অসংখ্য স্তূপাকৃত বই।
বললেন, ‘বলুন’। বলব কী ! এই বিশাল পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের সামনে ক্ষুদ্র আমি কীভাবে দেখাব আমার নিতান্ত শখের কাজটা। হয়ত উনি মনে মনে হাসবেন বা কিছু মামুলি কথা বলে আমাকে সান্ত্বনা দেবেন। তবুও ভয়ে ভয়ে ল্যাপটপ খুলে দেখালাম গীতবিতান আর্কাইভের বিষয়বস্তুগুলি। দেখলেন, যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে। জানতে চাইলাম কেমন হয়েছে। বললেন, বেশ ভালো।
শুনেছিলাম শঙ্খদা খুবই স্বল্পভাষী। বুঝলাম পাশ করে গিয়েছি। সাহস করে গীতবিতান আর্কাইভের জন্য একটা ভুমিকা লিখে দেবার আবদার জানালাম। আবার একটি মাত্র শব্দ, ‘দেখছি’। ইতিমধ্যে গৃহ-পরিচারিকা চা সহ স্ন্যাক্স পরিবেশন করে গিয়েছেন। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম। অবাক কাণ্ড, শঙ্খদা দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। বিখ্যাত এই মানুষটির এত বিনয়ী, সহজ ব্যবহার আর সৌজন্যবোধে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবার জোগাড়।
দিন কুড়ি পরে একটা ফোন এল, “আমি শঙ্খ বলছি, আপনার আর্কাইভের ভুমিকা লেখা হয়ে গিয়েছে। একদিন নিয়ে যাবেন।” আনন্দে দিশাহারা হয়ে পরের দিনেই পৌঁছে গেলাম, এবার একেবারে নির্ভয়ে।