হোমPlot1শান্তিপুরে ৪০০ বছরের পুরনো আগমেশ্বরী কালীপুজো

শান্তিপুরে ৪০০ বছরের পুরনো আগমেশ্বরী কালীপুজো

শান্তিপুরে ৪০০ বছরের পুরনো আগমেশ্বরী কালীপুজো

শুভদীপ রায় চৌধুরী
শাক্ত-বৈষ্ণবের পীঠস্থান নদিয়ার শান্তিপুর। এখানে শক্তি উপাসনার সঙ্গে সাড়ম্বরে রাস-জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। মূলত, বৈষ্ণব ও শাক্তের বিরোধ মেটানোর জন্যই এক ঐতিহাসিক প্রয়াস শুরু হয়  কালীপুজোর সঙ্গে। সেই দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে শান্তিপুরের প্রাচীন মা আগমেশ্বরীকে দেখতে বহু ভক্ত ছুটে আসেন দীপাবলির সময়। 

প্রায় ৪০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল এই আগমেশ্বরী কালীপুজো।  শুরু করেছিলেন সার্বভৌম আগমবাগীশ।  সার্বভৌম আগমবাগীশ ছিলেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র এবং তন্ত্রসাধক। তাঁরা আগমশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন বলেই তাঁদের আগমবাগীশ উপাধি দান করা হয়। সেই সময় শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিরোধ চলায়, শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্য্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী তাঁর নিজকন্যার সঙ্গে সার্বভৌম আগমবাগীশের বিয়ে দেন।

কিন্তু জটিলতা আরও বাড়তে থাকায় মথুরেশ গোস্বামী তাঁর কন্যা ও জামাতাকে নিয়ে চলে আসেন শান্তিপুরে। সেখানে এসে মথুরেশ, তাঁর বসতবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে এক পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করেন তাঁর জামাতার সাধনার জন্য। কারণ, গোস্বামীরা প্রত্যক্ষভাবে শক্তির উপাসনা করেন না। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ। দেবীর নির্দেশে তিনি গঙ্গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে এসে মূর্তি তৈরা করেন। আর পুজোর পরই মূর্তি বিসর্জন দিয়ে দেন। সেকালের প্রাচীন প্রথা আজও বর্তমান। এখন এই পঞ্চমুণ্ডির আসন সহ স্থানটি “আগমেশ্বরীতলা” নামেই পরিচিত।

আগমেশ্বরীর পূজার সমস্ত দায়িত্ব বহন করেন বড় গোস্বামী বাড়ির  সদস্যরাই। দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিন আগমেশ্বরীর পাটে সিঁদুর দেওয়া হয় এবং বিশেষ পূজা হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন “পাটখিলান” অনুষ্ঠান পালন করা হয়, এও এক প্রাচীন রীতি। বলাবাহুল্য,  আগমেশ্বরীর উচ্চতা প্রায় ১৬-১৮ফুট, মায়ের সেই নয়নভোলানো জ্যোতি যেন বঙ্গবাসীর মন জয় করে নেয়।

পাটখিলানের পরই শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। কালীপুজোর দিন মায়ের রঙ হয় এবং রাতে চক্ষুদান। দীপান্বিতার সমস্ত নিময় মেনেই পুজো হয় মায়ের। সম্পূর্ণ তন্ত্র মতে পুজো হয় আগমেশ্বরীর। রাত ৯টার সময় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরা মাকে গয়না পরান। তারপর যিনি মৃৎশিল্পী, তিনি সারাদিন উপবাস করে শুদ্ধবস্ত্র পরে মায়ের চক্ষুদান করেন। এরপর গোস্বামী পরিবারের যিনি সম্পাদক, তিনি মাকে সিঁদুর দান করেন। গন্ধদান, আতরদান করার পরই মায়ের পুজো শুরু হয়। রাত ১১টা থেকে মায়ের পুজো শুরু হয়, আর শেষ হয় পরের দিন ভোরবেলায়।

আগমেশ্বরীর জন্য সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। তাছাড়া, মায়ের কাছে কোনও রকমের পশুবলি প্রথা নেই, শুধুমাত্র একটি আখ ও একটি চাল কুমড়ো বলিদান হয়। দেবীর জন্য ৩৬ রকমের ব্যঞ্জন ভোগ হয়। আর সমস্ত ভোগ রান্না করেন গোস্বামী বাড়ির দীক্ষিত মহিলারাই। ভোগে থাকে তিন রকমের শাক, শুক্তনি, বিভিন্ন রকমের ডাল, চাল কুমড়োর তরকারি, মিষ্টি কুমড়োর তরকারি, কচুর দম, বাঁধাকপির তরকারি, ছানার ডালনা, এঁচোড়ের তরকারি, পোলাও, চালতার চাটনি, নানান মিষ্টি। এছাড়া সেই সময় যত রকমের ফল পাওয়া যায়, সমস্ত ফল নিবেদন করা হয় আগমেশ্বরীকে।

আগমেশ্বরীর যিনি পুজো করেন, তিনি বংশপরম্পরায় করে আসছেন। তবে শুধু মায়ের ভোগই নয়, কালীপুজোর পর দিন ভক্তদের ভোগ বিতরণ করা হয়। ১৪ ক্যুইন্টাল গোবিন্দভোগ চাল, ১.৫ ক্যুইন্টাল লক্ষ্মীঘি, ১ ক্যুইন্টাল কাজু, ১কুইঃ কিসমিস এবং ১৪কেজি গরমমসলা দিয়ে তৈরি হয় পোলাও, সঙ্গে থাকে সমপরিমাণ আলুরদম ও পায়েস। নবদ্বীপ থেকে ভক্তদের জন্য ভোগ রান্না করতে আসেন।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img