নীলার্ণব চক্রবর্তী
ব্যক্তি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আলগা বাতাসের মতো। ফোনেই। সংবাদ মাধ্যমে কাজ করার স্বার্থে। রিঅ্যাকশনের তাগিদে। এডিটরের চাপে। কিন্তু ফোন করলে আমার মতো একজন পিগমিকে গুরুত্ব দেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কথা বলেন। ভারী ভারী কথাও বলেন কখনও। সোমবার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন, তাঁকে ফোন করে উইশ করলাম যেমন, তেমনই অনেক দিন ধরে ঘুণপোকার মতো মাথা-কুড়ে খাওয়া দুটি প্রশ্ন করে বসলাম তাঁকে। শীর্ষেন্দুদা বললেন। বলে গেলেন। কথার সুর, কথার জাদু আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল কিছুটা সময়।
শীর্ষেন্দুদা, আধ্যাত্মিকতাকে আপনি কী ভাবে ব্যাখ্যা করেন। আপনার লেখায় কী ভাবে অনুরণন তোলে এই বিষয়টা?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : আধ্যাত্মিকতা মানে হচ্ছে অনুসন্ধিৎসা। ক্রম-কারণকে জেনে, সৃ্ষ্টি-স্থিতি-লয় যা কিছু ঘটেছে, তার পিছনে যে পরম কারণ তাকে জানার চেষ্টাই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। অ্যাধ্যাত্মিকতা মানে হচ্ছে অর্ডার অফ লাইফ। তোমার জীবন হবে জীবনমুখী অস্তিত্বমুখী। তুমি যেমন বেঁচে আছ, তেমনই তোমার চারদিকে যারা বেঁচে আছে তার দিকে নজর রাখা, বিইং অ্যান্ড বিকামিং, এ দুটি জিনিসই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার মূল বিষয়।
সব ধর্মেরই কিন্তু একই কথা, আমাদের অস্তিত্বটা কী ভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, কী করে বিকশিত হওয়া যায়, কী করে সার্থক হওয়া যায়, এটাই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা মূল বিষয়। নামধ্যান করাটা কিন্তু আসল কথা নয়… এটা করা হয় একটাই কারণে, যাতে নিজের ভিতরে যে ঘুমন্ত শক্তি আছে তাকে জাগিয়ে তোলা যায়, অনুসন্ধিৎসাকে জাগিয়ে তোলা যায়, প্রেম বা ভালবাসাকে জাগিয়ে তোলা যায়, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম মানে সৃষ্টির প্রতি প্রেম, জগৎ-জীবনের প্রতি প্রেম, মানুষজনকে ভালবাসা, জীবজন্তুকে ভালবাসা, প্রাণের সমস্ত বিকাশকে ভালবাসা, এই ভালবাসার চেষ্টাই হচ্ছে নিরন্তর আধ্যাত্মিকতার প্রয়াস।
শুধু সাধু হয়ে গেলাম, সংসারত্যাগী হয়ে গেলাম, উদাসী বিবাগী হয়ে গেলাম, গেরুয়া ধারণ করলাম, সেটা বড় কথা নয়। তবে জীবনের একটা কেন্দ্র থাকা দরকার। একজন গুরু বা নির্দেশক, বা অবলম্বন থাকতে হয়, তারপর জীবনকে তৈরি করতে হয়। অস্তিবাচক যত কিছু সব কিছু গ্রহণ করতে হয়, এটাই আধ্যাত্মিকতার মূল কথা, জীবন যাপনই হল আধ্যাত্মিকতা।
আচ্ছা আপনার লেখার মধ্যে অলৌকিকতা মিশে থাকে। আধ্যাত্মিকতা আর অলৌকিতার মধ্যে সূক্ষ্ণ যোগাযোগ আছে কি?
শীর্ষেন্দু: ঠাকুরকে (অনুকূল ঠাকুর) অনেকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে অলৌকিকতা নিয়ে, এগুলি কি ম্যাজিক না অন্য কিছু? ঠাকুর বলেছেন, তুমি কারণটা জানো না বলেই তোমার কাছে মনে হচ্ছে অলৌকিক। ওটা কিন্তু কোনও কারণ অনুযায়ীই ঘটছে, ক্রম-কারণ অনুসরণ করে ঘটছে। ওটার মধ্যেও বিজ্ঞান আছে। সেই বিজ্ঞানকে আমরা জানি না। যদি ঠিক মতো অনুশীলন করা হয়, তা হলে এই কারণটাকে জানাও যেতে পারে। আধ্যাত্মিকতা এই কারণকে অনুসরণ করে। আসলে, আমরা যে জীবন যাপন করছি, তার বাইরেও জীবন আছে। সূক্ষ্ম স্তরের জীবন। সেই জীবনের বিচ্ছুরণ আমরা টের পাই কখনও কখনও, ওই সূক্ষ্ম-বিজ্ঞান আমাদের অধিগত নয় বলেই আমাদের কিছু ঘটনাকে অলৌকিক মনে হয়।
ফোন রাখার পর, কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ছোটবেলা থেকে কঠোর বামপন্থী আমি। তার মানে এই নয় ধর্মগ্রন্থ পড়িনি, ধর্মের বইপত্র পড়িনি যে তা নয়। কিন্তু শীর্ষেন্দুদা আমায় এক লহমায় বুঝিয়ে দিলেন আমার দেখার দুনিয়াটা কতটা অপূর্ণ হয়ে ছিল এতদিন। একটা মানুষ সাহিত্যিক খ্যাতির শীর্ষে। এত উপন্যাস, গল্প, ছোটদের জন্য এত লেখা যে, নাম বলতে গিয়ে ফুসফুসের শ্বাসে হয় না, অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন নয়। এর মধ্যে বড় অংশের লেখাই আবার এখনই কালের সাগর পেরিয়ে মহাকালের মহাসাগরে। তাঁকে এত মৃত্তিকাভিমুখী করে রাখে ওই আধ্যাত্মিকতার মন্ত্র, এই মন্ত্রই তাঁর শীর্ষে কোনও গৃধিণীকে ছায়া ফেলতে দেয়নি, দেয় না।
বুঝতে পারলাম মুহূর্তেই। আমরা যারা জলের উপর দাগ কাটছি মাত্র, যাদের মাটিতে পা পড়ে না অহঙ্কারে, তাদের বেলুনটা নিমেষে চুপষে দিতে পারেন শীর্ষেন্দুদা এবং তাঁর এই বৌদ্ধিক তলোয়ার। কে এক জন বলেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘুণপোকা’ ‘দূরবীন’ দিয়ে দেখলে ‘মানবজমিন’-এ দাঁড়ানোর শিক্ষা মেলে। অধ্যাত্মবোধ যে জীবনসম্পৃক্ত এক শিক্ষা এর ফলে বোঝা যায়, পর্যায় পরম্পরাক্রমে, আদি থেকে উপান্তে একইভাবে– আজও।
পঁচাশি বছরের জীবন। ১৯৩৫ সালে ২ নভেম্বর তাঁর জন্ম। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। সেখানে তাঁর জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে। তারপর কত গতিপ্রকৃতির মধ্য দিয়ে সহিত্যের চুড়োয় ওঠা। সুনীল শক্তি সহ কত বন্ধু। সাহিত্য অকাদেমি, বঙ্গবিভূষণ সহ কত পুরস্কার। আমি বলি, সূর্য তো অনেকে অনেকে আছেন, সকালে যারা চাবুক দিকে আলোকিত করে রাখেন, শীর্ষেন্দুদা রাতের আলো, কোজাগরির আকাশের ফুটফুটে।
ফোনটা রেখে ব্যালকনিতে হাঁটছিলাম আবছা ঘোরের মধ্যে। আমার পিছনে পিছনে হাঁটছিল আমার সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়ে। তার পিছনে ড্রপ খাচ্ছিল একটা বল। মেয়েটা বলটা ধরে আমায় হঠাৎই বলল, বাবা, তোমাকে এতটা ম্যাজিক দেখাবো? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আচ্ছা দেখা তো? মেয়ে বলে উঠল, গিলি গিলি হে (আমার মেয়ে গ ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারে না, হ শোনায়)। বলার সঙ্গে সঙ্গে বলটা একটা বই হয়ে গেল, দেখলাম মলাটে লেখা– ছোটদের অমনিবাস। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। মেয়ে সূচিপত্রটা খুলে বসল, দেখলাম– মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাই বাগানের ভূত, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নৃসিংহ রহস্য, বক্সার রতন…
জানি এই লেখাগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে পড়তে পড়তে আমার মেয়ে তার ‘শিশু’কে সারা জীবন তার মনের মধ্যে রেখে দিতে শিখে যাবে।