হোমরাজ্যএকটানা বেশিক্ষণ সানগ্লাস ব্যবহার, চোখের ক্ষতি করছেন না তো?

একটানা বেশিক্ষণ সানগ্লাস ব্যবহার, চোখের ক্ষতি করছেন না তো?

একটানা বেশিক্ষণ সানগ্লাস ব্যবহার, চোখের ক্ষতি করছেন না তো?

purnendu vikas sarkarডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

কল্যাণ একজন সফল মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। তবে পরিশ্রমও করতে হয় প্রচুর। প্রায় সারাদিনই বিভিন্ন ডাক্তারের চেম্বারে ঘোরাঘুরির কাজ। দুপুর রোদে বাইক চালানোর সময়ে চোখের বেশ অসুবিধা হচ্ছিল কিছুদিন যাবৎ। সম্প্রতি সল্টলেক সিটি সেন্টারের দোকান থেকে একটা সানগ্লাস কিনেছে। দেখতেও সুন্দর, চোখের ঝামেলাটাও মিটেছে।

রোদচশমা বা সানগ্লাস কেবলমাত্র ফ্যাশনই নয়, এটা এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। সানগ্লাস সূর্যের প্রখর তাপ ও নানা রকম ক্ষতিকারক আলোকরশ্মির প্রভাব থেকে চোখকে যেমন রক্ষা করে, তেমনি কলকারখানার দুর্ঘটনা থেকে চোখের সুরক্ষাতেও এর ভূমিকা অপরিসীম। চোখের চিকিৎসাতেও সানগ্লাসের ব্যবহার দেখা যায়। তাছাড়া ফ্যাশানে দুনিয়ায় সানগ্লাসের ভূমিকা তো অনস্বীকার্য।

দ্বাদশ শতাব্দীর আগে লোকেরা আড়াআড়িভাবে চেরা হাতির দাঁতের পাতলা টুকরোকে সানগ্লাস হিসাবে ব্যবহার করত। এতে কেবলমাত্র প্রখর রোদের ঝলকানি বা গ্লেয়ার একটু কমত। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চিন দেশের বিচারকেরা ধূসর রঙের কোয়ার্জ ক্রিস্টালের (Quartz Crystal) চশমা পরে মুখের অভিব্যক্তিকে আড়াল করতেন।

ব্রিটিশ চিকিৎসক James Ayscough 1752 সালে চশমায় বিভিন্ন রঙের কাঁচের ব্যবহার শুরু করে আধুনিক সানগ্লাসের দিগন্ত খুলে দিলেন। 1920 সাল থেকে সানগ্লাসের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, বিশেষ করে চিত্রতারকাদের মধ্যে। এই সানগ্লাসগুলি ছিলো বহুমূল্যের। কেবলমাত্র সমাজের উচ্চবিত্তরাই এগুলি সংগ্রহ করতে পারতেন। 1929 সালে অপেক্ষাকৃত কম দামের হালকা আর টেঁকসই প্লাস্টিকের সানগ্লাস বাজার দখল করে নিল।

1936 সালে আবিষ্কৃত হল পোলার‍য়েড লেন্সের সানগ্লাস। বর্তমানে আমেরিকার প্রায় 31% লোক সানগ্লাস ব্যবহার করেন। ভারতে এখনও এই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও, অনুমান করা যায় এখানেও অসংখ্য মানুষ নানা প্রয়োজনে সানগ্লাস বা রোদ চশমা ব্যবহার করে থাকেন।

সানগ্লাসের ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য
সানগ্লাসের প্রধান কাজ উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলো থেকে চোখকে বাঁচানো।
ধুলোবালি, ময়লা, তীব্র হাওয়া থেকে চোখে রক্ষা করা।
ফ্যাশান এবং নিজের সৌন্দর্য্য ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করা।
চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার।
কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের চোখের সুরক্ষায় ব্যবহার

সানগ্লাসের উপকারিতা
রোদ থেকে সুরক্ষা : সানগ্লাস চোখকে সূর্যের ক্ষতিকারক আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি চোখের ছানি, ক্যান্সার, বার্ধক্যজনিত ম্যাকুলার ক্ষয় (ARMD) ইত্যাদি নানা ধরনের চোখের অসুখের অন্যতম কারণ। এছাড়া অতিরিক্ত সূর্যের আলোতে চোখের চামড়া কুঁচকিয়ে বয়সের ছাপ পড়ে যায়। ভালো সানগ্লাস আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিকে 100% প্রতিহত করতে পারে।

গ্লেয়ার থেকে সুরক্ষা : বরফের পাহাড়, জলের উপরিতল, গাড়ির উইন্ডশিল্ড বা চকচকের রাস্তা থেকে প্রতিফলিত চোখ ঝলসানো সূর্যের আলো বা গ্লেয়ার চোখকে ঝাপসা করে দেয়। এর ফলে চোখ কুঁচকিয়ে যায়, মাথা ধরে। সানগ্লাস, বিশেষ করে পোলারাইজড সানগ্লাস এ ক্ষেত্রে খুবই উপকারী।

বাধার সুরক্ষা : সানগ্লাস চোখ এবং পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার মধ্যে প্রাচীর হিসাবে কাজ করে। অতিরিক্ত হাওয়ায় কর্নিয়া শুকিয়ে চোখের অস্বস্তি শুরু হয়। কণ্টাক্ট লেন্স ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে সানগ্লাস চোখকে অতিরিক্ত আরাম দেয়। সানগ্লাস হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ধুলোময়লা, পাথরের কুচি, ফুলের পরাগরেণু ইত্যাদির আঘাত এবং অ্যালার্জি থেকে কর্নিয়াকে রক্ষা করে।

চোখ এবং মাথাব্যথা থেকে রক্ষা : চোখের Pupil সংকুচিত-প্রসারিত হয়ে চোখের ভিতরে আলো প্রবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। তীব্র আলোয় Pupil অতিরিক্ত সংকুচিত হয়, চোখ কুঁচকিয়ে যায়। এর ফলে মাথাব্যথা ও চোখ টনটনানি শুরু হয়। সানগ্লাসের ধূসর লেন্সের জন্য চোখে বেশি আলো প্রবেশ করতে পারে না। Pupil প্রসারিত অবস্থায় থেকে দৃষ্টিকে স্নিগ্ধ রাখে।

দৃষ্টির উন্নতি : ভালো দৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার পারিপার্শ্বিক আলোর দরকার। অত্যধিক উজ্জ্বল আর চোখ ঝলসানো আলোয় রেটিনায় স্পষ্ট প্রতিবিম্ব তৈরি হতে পারে না। সানগ্লাস চোখে প্রবেশ করা আলোকে প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রণ করে আরামদায়ক আর ঝকঝকে দৃষ্টি দেয়।

চোখের চিকিৎসায় রোদ চশমা
ছানি, ল্যাসিক বা যে কোনও ধরনের চোখের অপারেশন, কনজাংটিভাইটিস, কর্নিয়ার আলসার ইত্যাদিতে সানগ্লাস ব্যবহারের দরকার হয়। কয়েক ধরনের ছানির ক্ষেত্রে কালো লেন্সের সানগ্লাস ব্যবহার করলে সাময়িকভাবে দৃষ্টির কিছুটা উন্নতি হয়। সানগ্লাস সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিকে নিয়ন্ত্রণ করে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ছানি ইত্যাদিকে প্রতিহত করে।

সানগ্লাস পরলে উজ্জ্বল আলোতে দৃশ্যবস্তুকে স্নিগ্ধ দেখায় ফলে চোখ সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে না।
সানগ্লাস আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধক না হলে চোখের ক্ষতি হয়।
সানগ্লাসের কালো লেন্সের জন্য চোখে আলো কম প্রবেশ করে, যায় ফলে Pupil প্রসারিত হয়ে থাকে। Pupil দীর্ঘক্ষণ প্রসারিত থাকলে অ্যাস্টিগমাটিজম বেড়ে যেতে পারে।
সানগ্লাস পরলে গ্লুকোমা, রাতকানা, কালারব্লাইণ্ড ইত্যাদি রোগের অবনতি হয়।
বেশিক্ষণ সানগ্লাস পরার ফলে অনেকের দৃষ্টিক্ষমতা হ্রাস পায়।

ভালো সানগ্লাস কেনার আগে
চশমার দোকানে গিয়ে যে কোনও একটা সানগ্লাস কিনলেই হবে না। প্রথমে আপনার মুখের গঠন অনুযায়ী ফ্রেমের ডিজাইন ও সাইজ পছন্দ করতে হবে। ফ্রেম একটু বড় হলে আর চোখ দুটিকে পুরোপুরি ঢেকে রাখলে, সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যায়। ফ্রেম প্লাস্টিক বা মেটালের হতে পারে। প্লাস্টিকের ফ্রেম বিভিন্ন ডিজাইন আর রঙের পাওয়া যায় বলে এগুলি বেশি জনপ্রিয়। মেটাল ফ্রেম সরু আর হালকা হয়, কিন্তু চোখকে পুরোপুরি ঢেকে রাখতে পারে না।

সানগ্লাসের ফ্রেম হালকা আর ফিটিংস সঠিক হওয়া দরকার, যেন নাক বা কানে চেপে না বসে, নাক থেকে বারবার পিছলে না যায়। আর পরাটা যেন আরামদায়ক হয়। লেন্স পছন্দের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। কাচের চাইতে প্লাস্টিকের লেন্স হালকা, মজবুত আর দেখতেও সুন্দর হয়। তবে সানগ্লাসের লেন্স অবশ্যই 100% আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধক হতে হবে। কাজের প্রয়োজন অনুসারে অ্যান্টি-স্ক্রাচ, অ্যান্টি-রিফ্লেকশান ইত্যাদি গুণগুলি যুক্ত করা যায়। গাড়ি চালানো, পর্বোতারোহন, সমুদ্র ভ্রমণ ইত্যাদির জন্য পোলারয়েড লেন্স আদর্শ।

লেন্সের রঙ নির্বাচনও সমান গুরুত্বপূর্ণ
বিভিন্ন রঙ আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে।
ধূসর ও সবুজ: দৃশ্যবস্তুর রঙের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে।
বাদামি: রঙের কিছুটা বিকৃতি ঘটায় কিন্তু কন্ট্রাস্ট বাড়িয়ে দেয়।
ফিরোজা : মাঝারি আলোয় রঙের বিকৃতি না করেও কন্ট্রাস্ট বাড়ায়।
হলুদ : দৃশ্যবস্তুকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখায়, কিন্তু আলোর উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেয়।
অ্যাম্বার: দুরের বস্তুকে আরও স্বচ্ছভাবে দেখা যায়।
নীল, বেগুনি: মুখ্যত সৌন্দর্য্যবর্ধক বা ফ্যাশান দুরস্ত সানগ্লাসে ব্যবহৃত হয়।

অর্থাৎ ফ্রেমের ডিজাইন, সাইজ, রঙ, লেন্সের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সব মিলিয়ে নির্বাচিত সানগ্লাসটি যেন আপনার সৌন্দর্য্য আর ব্যক্তিত্বে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে। একইসঙ্গে সানগ্লাসটি পরে অত্যন্ত সহজভাবে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাওয়া আর সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি আপনার চোখের সুরক্ষাও প্রয়োজন।

যারা চশমা পরেন তাঁরা কি সানগ্লাস পরতে পারবেন না?
চশমায় পাওয়ার থাকলে সানগ্লাস পরা যায় না, এই ভেবে অনেকেই মন খারাপ করে থাকেন। কিন্তু তাদের জন্যও রয়েছে সুখবর। দোকানে যে সানগ্লাস বিক্রি হয় সেগুলিতে সাধারণত পাওয়ারবিহীন লেন্স থাকে। চশমায় পাওয়ার থাকলেও আজকাল সেই পাওয়ার অনুযায়ী পছন্দমত ফ্রেমে সানগ্লাসও করিয়ে নেওয়া যায়, যেগুলি দেখতে অবিকল দোকানের branded সানগ্লাসের মতই। যারা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন তাঁরা অবশ্য লেন্সের উপরে পাওয়ারবিহীন সানগ্লাস পরতে পারেন।

ফুটপাথ বা ছোটো দোকান থেকে কেনা সস্তা সাধারণ সানগ্লাস চোখের ক্ষতি করে।
সানগ্লাস অবশ্যই আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধক হওয়া দরকার।
ছানি বা ল্যাসিক অপারেশনের পরে কিছুদিন ভালো সানগ্লাস পরে থাকা উচিত।
সানগ্লাস একটানা বেশিক্ষণ পরে থাকবেন না।
সব ফটোক্রোম্যাটিক চশমা কিন্তু সানগ্লাস নয়।
রোদে ঘোরাঘুরির সময়ে প্রচুর জলপান করা আর চোখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দেওয়া প্রয়োজন।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img