তরুণ গোস্বামী, বিশিষ্ট সাংবাদিক
(আজ স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্ববিজয় দিবস। চিকাগোর ধর্ম মহাসভায় ঐতিহাসিক ভাষণের ১২৭ বছরে যুগনায়ককে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য)
মানুষকে ভালবাসলে কি এইভাবে অপমানিত হতে হয়? কি পেলো ছেলেটা? ঊনচল্লিশ বছরের ছেলের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে মার হু হু করে কান্নার আওয়াজ বেলুড় মঠ থেকে গঙ্গায় ছড়িয়ে পড়লো, “যাস না নরু যাস না, আমি কি নিয়ে থাকবো।”
এই ঘটনার পরেও আরো ৯ বছর বেঁচে ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী। কে অপমান করতে বাকি রেখেছিল। পাদ্রীরা তো অপমান করেইছিলো কিন্তু তাঁর স্বদেশের মানুষজন তাঁরাই বা কম কি। বিবেকানন্দের বন্ধু হরমোহন মিত্র আর বাবুরাম স্বামী প্রেমানন্দ তাঁরা প্যামলেট ছাপিয়ে কি অপমান করলেন নরেনকে।
প্রমোদা দাস মিত্র যাঁকে স্বামীজী এত সম্মান করতেন, তিনি তো বলেই ফেললেন, কায়স্থের সন্তান, কালা পানি পার হয়েছে, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েছে। আবার নামের আগে স্বামী ব্যবহার করছে, এ চলতে পারে না। বিবেকানন্দের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করলেন মিত্র মশাই।
উত্তরপাড়ার রাজা প্যায়ারিমোহন মুখোপাধ্যায় সম্মতি জানালেন সভাপতি হবার। কিন্তু বলেই দিলেন, ভাই বিবেকানন্দ বলবো, স্বামী বিবেকানন্দ বলবো না। তাই তিনি করেছিলেন। সভাপতির বক্তব্যে একবারের জন্যও স্বামী বলেননি।
স্বামীজিকে অপমানিত হতে দেখে Goodwin বলেছিলেন, চলুন স্বামীজি, আমরা বিদেশে ফিরে যাই। স্বামীজী হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, বলুক না। অভয়ানন্দ তুমুল সমালোচনা করলেন স্বামীজির। হেনরিয়েটা muller, শ্রীমতি থমসন, Sturdy, যাঁরা কাছে এসেছিলেন, তাঁরাও একে একে দূরে চলে গেল।
নিবেদিতাও কথা শোনাতে ছাড়েননি। নিঃসঙ্গ স্বামীজি যখন পৃথিবী ছাড়লেন তখন একা।
শিকাগো ধর্মমহাসভার 127 বছরে জানবার চেষ্টা করবো কেন স্বামীজী আমেরিকাতে গেলেন। বোম্বে থেকে জাহাজে ওঠার আগে দুই গুরুভাইয়ের সাথে দেখা। বলেছিলেন যে, কষ্ট আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের দেখেছি, তাতে চোখের জল ধরে রাখা যায় না। আমেরিকা যাচ্ছি , এঁদের উন্নতির জন্য টাকা আনতে।
স্বামীজি দেখেছিলেন, সভ্যতার নামে এদেশের শিক্ষিত মানুষ যা করছে, ওটা আসলে পরানুকরণ। ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, কৃষ্টি সম্বন্ধে বিদেশে জানানোর বড় platform ধর্ম মহাসভা। অতএব সেটিকে কাজে লাগাতে হবে।
6টি বক্তৃতা স্বামীজি শিকাগোতে দেন। 11, 15, 19, 20, 26 আর 27 সেপ্টেম্বর। 20 তারিখের বক্তৃতার বিষয় ছিল Religion not the crying need of India. এই বক্তৃতায় তিনি তুলোধুনো করেন পাদ্রীদের। বলেন, ধর্ম আমাদের দেশে অনেক আছে, প্রয়োজন রুটির। একটি অভুক্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো মানে, তাঁকে অপমান করা। হলঘরে নিস্তব্ধতা, বক্তৃতা শেষে অনেকে বললেন, এঁর দেশে আমরা missonary পাঠাই। এঁরই উচিত, আমাদের দেশে মিশনারি পাঠানো।
19 তারিখের বক্তৃতায় universal religion এর কথা বললেন স্বামীজি। দৃঢ়তার সাথে বললেন, আগামী দিনে এটি হবে ধর্ম। স্বামীজির কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রানাথ দত্ত লিখেছেন, স্বামীজীর চিন্তা তাঁর সময়ের চেয়ে এতটাই আগামীদিনের ছিল যে, তাঁর সমালোচকের অভাব হয়নি। চিন্তায় স্বামীজির ধারেকাছে কেউ পৌঁছতে পারেননি।
এত অপমান কেন হজম করলেন? শুধু এই বিশ্বাসে যে, ভারত আগামীদিনে বিশ্বকে পথ দেখাবে। ভারতবর্ষ জাগবে চৈতন্যের শক্তিতে।
2015 সালে wall street journal-এ একটি বড় লেখা বের হয়। তার বিষয়বস্তু ছিল George Harrison, Greta Garbo, JD Salinger আর Lawrence Oliver-এর মিল কোথায়? লেখক বলেছেন, এঁরা সবাই স্বামীজিকে ভালোবাসতেন।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্ৰতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস কমছে। মানুষ কি নিয়ে থাকবে? ভালোবাসা নিয়ে, মানুষ হবে দেবতা। ১১ সেপ্টেম্বর আমাদের বিবেকানন্দকে ভালোবাসতে স্নাত হবার দিন।
সাহায্য দাও, সেবা দাও, তোমার যা দেবার আছে দিয়ে দাও, সাবধান বিনিময়ে কিছু চেয়ো না। স্বামীজির আলো আমাদের অন্তরের আলো জ্বেলে দিক। মানুষের সেবা করে আমরা যেন ধন্য হতে পারি। স্বামীজিকে যে অপমান আমাদের পূর্বসূরীরা করেছেন, মানুষকে ভালোবাসাই হবে একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত।