ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
১৮৯৩ সালের জুলাই মাস। ইয়াকোহামা থেকে ভ্যাঙ্কুবারের সাগর-পথে চলেছেন দুই মহান ভারতীয় যাত্রী। একজন ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী, অন্যজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পপতি। সন্ন্যাসী আগ্রহী হয়েছেন ভারতাত্মাকে পশ্চিমের কাছে উন্মোচনে, শপথ নিয়েছেন সনাতনী ধর্ম ও দর্শনের প্রসার ঘটাতে। আর উদ্যোগপতি ইস্পাত শিল্পের জন্য প্রযুক্তি-প্রকৌশল ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমেরিকা যাচ্ছেন। তাঁর লক্ষ্য ভারতকে সবল, শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। এই দুই ভারতসন্তান হলেন, স্বামী বিবেকানন্দ আর জামশেদজী নুসারওয়ানজি টাটা।
স্বামীজি টাটার চেয়ে ১৬ বছরের ছোটো, তবুও আর্শিবাদ জানিয়ে বললেন, “How wonderful it would be if we could combine the scientific and technological achievements of the West with the asceticism and humanism of India.”
এই জাহাজ-যাত্রা আর কথোপকথনের বিবরণ স্বামীজি চিঠিতে জানিয়েছিলেন ছোটোভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তকে। মহেন্দ্রনাথের মারফত আমরা জানতে পারি, স্বামীজি আর টাটা একসঙ্গে জাপানের একটি দেশলাই কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং সমসাময়িক জাপানের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। স্বামীজি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, টাটা কেন দেশলাই তৈরির কারখানা ভারতে নির্মাণ করছেন না? কেন জাপান থেকে কেবল সেই পণ্য আমদানি করে চলেছেন? কেবল একটা কমিশন বা মধ্যস্বত্ত্ব পাওয়া ছাড়া এতে তেমন লাভই বা কোথায়? তার চাইতে বরং টাটা যদি নিজেই এই শিল্প গড়তে পারতো, তবে বেশি লাভই পেত তা নয়, বহু ভারতীয় যুবকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ থাকতো।
জামশেদজি এই তরুণ যুবকের জ্বলন্ত-শক্তি অনুভব করলেন। সন্ন্যাসী যখন কথা বলছেন, তখন তাঁর চোখ প্রদীপ্ত, আবার ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পষ্ট অভিব্যক্তি। ভারতবাসীর পেটে অন্ন নেই, গায়ে বস্ত্র নেই, মাথার উপর ছাদ নেই, মগজে জ্ঞান নেই। পরিব্রাজক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন তিনি। অভুক্ত অথচ অতুল্য ভারতের কথা তুলে ধরছেন। দেখেছেন মহারাজাধিরাজ আর শিক্ষিত মানুষেরা গরিব দেশবাসী সম্পর্কে উদাসীন। তবুও ভারতের প্রকৃত আশার জায়গা কিন্তু আপামর দেশবাসী, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের শিক্ষা দিতে হবে, মুখে অন্ন তুলে দিতে হবে। সেজন্য শিল্প চাই, তবেই ভারত স্বাবলম্বী হবে।
টাটা সন্ন্যাসীর এই আকুতি মনে রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন বাদে ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে আলাপচারিতায় তা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, জাপানবাসী যখন স্বামীজিকে দেখলেন, তাঁর মধ্যে ভগবান বুদ্ধের ঐশ্বরিক মিল খুঁজে পেলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জামশেদজি টাটাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এটা লক্ষ্য করার মত বিষয় যে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রথম নির্দেশনার জন্য তিনি স্বয়ং স্বামীজিকেই প্রস্তাব পাঠান।
এ প্রসঙ্গে আমরা স্বামীজিকে লেখা টাটার চিঠি উদ্ধৃত করতে পারি। “I very much recall at this moment your views on the growth of the ascetic spirit in India and the duty, not of destroying, but of diverting it into useful channels. I recall these ideas in connection with my scheme of a Research Institute for India, of which you have doubtless heard or read. It seems to me that no better use can be made of the ascetic spirit than the establishment of monasteries or residential halls for men dominated by this spirit, where they should live with ordinary decency and devote their lives to the cultivation of sciences — natural and humanistic. I am not opinion that if such a crusade in favour of an asceticism of this kind were undertaken by a competent leader, it would greatly help asceticism, science and the good name of our common country, and I know not who would make a more fitting general of such a campaign than Vivekananda.”
যদিও স্বামীজির উত্তর সংরক্ষিত হয়নি, তবুও দেখা যায়, রামকৃষ্ণ মিশন প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-এর সম্পাদকীয় (এপ্রিল, ১৮৯৯) প্রতিবেদনের ভাষাতে এই চিঠিটিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল, “We are not aware if any project at once so opportune and so far – reaching in its beneficent effects was ever mooted in India, as that of the Post – graduate Research University of Mr. Tata. The scheme grasps the vital point of weakness in our national well-being with a clearness of vision and tightness of grip, the masterliness of which is only equalled by the munificence of the gift with which it is ushered to the public.”
স্বামীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত টাটার গবেষণা প্রকল্প ব্রিটিশ সরকার প্রথমে নাকচ করে দেয়। কিন্তু নানা মহল থেকে সরকারের উপর চাপও মন্দ ছিল না। স্বামিজি ভগিনী নিবেদিতা এবং শিষ্যা জোসেফেন ম্যাকলাউড-এর মাধ্যমে নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে গেছেন জামসেশেজিকে।
স্বামীজি দেহত্যাগ করেন ৪ জুলাই, ১৯০২ সালে। আর ১৯০৪ সালের ১৯ মে জামশেদজি টাটার মৃত্যু হয়। অবশেষে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার টাটা গবেষণা প্রকল্পে ছাড়পত্র দেয়। ১৯০৭ সালে স্বামীজির শিষ্য, মহীশূরের মহারাজ, তাঁর গুরুর স্বপ্নপূরণের জন্য বেঙ্গালুরুতে ৩৭০ একর জমি দান করেন। ১৯০৯ সালের ২৭ মে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার পর সেই জমির উপরেই গড়ে ওঠে (১৯১১) টাটা ইন্সটিটিউট, আজকের “Indian Institute of Science”।
ভারতের মৌল-বিজ্ঞান গবেষণার দুই সেরা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স’ (টাটা ইন্সটিটিউট), এবং মুম্বইয়ের ‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ তৈরি হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায়।