অমিত মিত্র : ছেলেবেলা হোক বা মেয়েবেলা। আসলে এ হল ছোটবেলার কথা। আমরা বড় হতে হতে ক্রমে ক্ষয় হতে থাকে জীবনের আয়ু। তবু হঠাৎ কখনও কোনও এক অবকাশে কিংবা অবসরে একান্তে মনে মনে দিব্যি চলে যাওয়া যায় ছোটবেলায়। ফিরে ফিরে আসে পুরনো মুখ, পুরনো গন্ধ, পুরনো সব সম্পর্ক। সে সম্পর্ক হয়ত সুখের, কখনও বা অসুখের। কোনওটা মন খারাপের, কোনওটা মন ভালো করার। সেই সব সম্পর্কের ধূসর পাণ্ডুলিপিরা কখনও স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে মনে।
সম্পর্কগুলো আগলে রাখা বড় জরুরি।- কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু, আমরা সম্পর্কগুলো আগলে রাখি নাকি সম্পর্কগুলোই আমাদের আগলে রাখে? এখন থেকে বছর কুড়ি আগেও এ নিয়ে বিশেষ ভাবতে হত না। সম্পর্কের সাবলীলতায় আমরা আটকে পড়তাম। সম্পর্ক গড়তে হত না, সম্পর্কই গড়ে নিত আমাদের। পাড়া-কালচারে যারা বড় হয়েছি, তারা জানি কী ভাবে পড়শির উঠোন কিংবা বাগান আশ্বস্ত করত আমাদের শৈশবকে। তামাম পাড়ার সকলেই ছিলেন আত্মীয়। ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির সৌজন্যে এখন পাড়াগুলো ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। একা হতে হতে আমরাও ঢুকে যাচ্ছি সেই ফ্ল্যাটের চার দেয়ালের চৌকো খোপে। সেটাই আমাদের দুনিয়া। কয়েকশো বর্গফুটের জায়গা ঘিরেই স্বপ্ন, হতাশা, দুঃখ-সুখের রোজনামচা।
তখন সকলের বাড়িতে টিভি ছিল না। যাদের ছিল পাড়ায় তাদের কদর ছিল আলাদা। শনি-রবির সন্ধেয় টিভিতে সিনেমা দেখার জন্য পড়শিদের ভিড় জমত সেই বাড়িতে। ছাদে ছিল কাঠি-অ্যান্টেনা, সঙ্গে সম্ভ্রান্তের তকমা জুটত বাংলাদেশের অ্যান্টেনা থাকলে।
সাদাকালোর যুগ পেরিয়ে এখন টিভি মানেই রঙিন। স্ক্রিন এলইডি। দেওয়াল জুড়ে রাখা সেই ঢাউস টিভির সামনে বসে চিপস খেতে খেতে কার্টুন দেখে আমাদের সন্তান। একা। কাল্পনিক সব চরিত্ররাই তার বন্ধু। আপনজন। কেউ তাকে বলে না, ‘জানলার বাইরে আকাশটাকে দেখো, টিভি দেখো না।’ কিংবা নেই সদলবলে বিকেলের খেলা। এভাবেই আজকের শৈশব হারিয়ে ফেলেছে আমাদের সেই ফেলে আসা শৈশবকে। তারা এখন স্মার্টফোনের আন্তর্জালে বুঁদ। চ্যাট আর গেমেই কাটে শৈশব কিংবা সদ্য কৈশোরের দিনগুলো।
পাড়ায় তখন নিয়ম করে ফেরিওয়ালা আসত। বাড়ির দরজার সামনে বসে তারা গল্প করতে করতেই জিনিসপত্র বিক্রি করত। দূর থেকে ভেসে আসত- টিন ভাঙা…লোহা ভাঙা… কিংবা শিল…কাটাউ…কাটাউ শিল… এমনই সব মন কেমন করা ডাক। শীতকালের খবর নিয়ে আসত চন্দ্রপুলির ঝাঁকি মাথায় ফেরিওয়ালা। এখন ফেরিওয়ালারা ওই দূরের রাস্তা দিয়ে চলে যায়। আবাসনের কেউ তাকে চেনে না। সে-ও চেনে না কাউকে। বহু বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সদর দরজায় লেখা থাকে- সেলসম্যানের প্রবেশ নিষেধ। এখন বাইরে বেরোনোর আগে সন্তানদের বলে দিতে হয়— ‘কেউ বেল বাজালেই দুম করে দরজা খুলে দেবে না। আই-হোলে চোখ রেখে আগে আমাদের ফোন করবে। তার পরে ফোনটা কানে ধরে রেখেই দরজা খুলবে।’ চারপাশে কত কী যে ঘটছে! শুধু ভয় করে। সকলেই যেন শত্রু। সকলেই যেন ক্ষতি করার জন্য মরিয়া। সকলের চোখেই তাই অবিশ্বাস। সকলের চোখেই সন্দেহ।
দলবেঁধে স্কুলে যাতায়াত করাটাই তখন স্বাভাবিক ছিল। শেষ বেঞ্চে বসার মধ্যেও কোনও অপরাধ ছিল না। সেই আমরাই এখন আমাদের সন্তানদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর সবথেকে দামী শব্দ— ফার্স্ট! তাকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে হবে। ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। খেলাধুলায় ফার্স্ট হতে হবে। সাঁতার, আবৃত্তি, নাচ-গান সবকিছুতেই ফার্স্ট হতে হবে। সেকেন্ড হবে অন্য কেউ। অতএব আজকের শৈশব কেবলই দৌড়চ্ছে যেন এক ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতায়। তবু এরই মধ্যে নীল আকাশের বুকে এখনও ঘুড়ি ওড়ে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এলে। আকাশেতে কাটাকুটি খেলে পেটকাটি, চাঁদিয়ালরা। ঠিক যেন আজকের সম্পর্কের কাটাকুটির মতোই। সেই সব সম্পর্কের ঘুড়িগুলোর সুতো ছিঁড়ে গিয়েছে। এদিক, ওদিক পাক খেতে খেতে ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে কখনও হঠাৎ দেখা হলে মনে পড়ে সেইসব দিন। ফিরে আসে স্মৃতি; কখনও সাদায় কালোয়, কখনও রঙিন হয়ে।
এমনিতে তো ফেরা যায় না। কিন্তু মনে লাগাম পরানোর সাধ্যি কার! মনে মনে তাই দিব্যি চলে যাওয়া যায় ছোটবেলায়। এ ভাবেই আসা-যাওয়া চলতে থাকে। ফিরে ফিরে আসে পুরনো মুখ, পুরনো গন্ধ, পুরনো সব সম্পর্ক। ক্ষয়ে যেতে যেতেও আমরা আরও একটু সবুজ হই। আরও এক বার শ্বাস নিতে পারি প্রাণ ভরে। দুম করে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে হয়ত বা আনমনেই চলে যাই ছাদে; পড়ন্ত বিকেলের আকাশটাকে দেখতে কিংবা বৃষ্টিতে হঠাৎ ভিজতে। নিজের অজান্তে এ ভাবেই হয়তো সম্পর্কগুলো ফের খুঁজে পায় অন্য মানে। বইতে থাকে জীবনও।