সংযুক্তা সরকার
‘আইডিয়াটা প্রথম মাথায় আসে শ্রীপর্ণা দির। বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী শান্তিনিকেতনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত এবং গল্ফগ্রিনের বাসিন্দা শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য। বললেন, চল আমরা এই গল্ফগ্রিনের সবুজের মাঝেই একটা শান্তিনিকেতন নিয়ে আসি। সালটা ছিল ২০০২। যেমন বলা, তেমন কাজ। শুরু হয়ে গেলো প্রস্তুতি।’ সেদিনের সেইসব গল্প বলছিলেন “গল্ফগ্রিন বসন্তোৎসবের” অন্যতম কান্ডারী, ওড়িশি নৃত্যশিল্পী উর্মিলা ভৌমিক। সেইসময় উর্মিলা ডান্স ট্রুপের ছাত্রী সংখ্যা মাত্র পঁচিশ। তাই নিয়ে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য অনুসরণ করে একটি বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন নেহাতই সহজ ছিল না। চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু ইচ্ছে আর উপায়ের মধ্যে দূরত্ব কমাতে পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন সুদেষ্ণা স্যান্যাল-সহ বিশ্বভারতীর বেশ কয়েকজন শিল্পীকে। তাঁদের অভিজ্ঞতার হাত ধরে তাঁদের দেখানো পথেই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই শুরু। আর আজ উনিশে পা।
ভাবনা ছিল, কবির অনুপ্রেরণায়, তাঁর দেখানো পথে বসন্তের উৎসবে যোগ দিতে বছর বছর কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে পাড়ি জমান যাঁরা, তাঁদের এই শহরের বুকেই একই রকম আমেজ, একই আঙ্গিকে একটি বসন্ত উৎসব উপহার দেওয়া। নৃত্যশিল্পী এবং দূরদর্শনের ঘোষিকা উর্মিলা তখন বেসরকারি চ্যানেলের সংবাদ পাঠিকাও বটে। বছর দুয়েকের মধ্যেই সরকারি-বেসরকারি মিডিয়ার সহযোগিতায় জনপ্রিয় হয়ে উঠলো অনুষ্ঠান।তাতে সবসময় পাশে থেকেছে গল্ফগ্রীণ কোঅর্ডিনেশন কমিটি। প্রভাতফেরি, খোলা আকাশের নীচে শিল্পীদের কণ্ঠে রবি-গান, নাচ, কবিতাপাঠ মানুষের মন টানলো। আর সেই থেকেই প্রতি বছর পলাশে, আবিরে, অশোকে আর কিংশুকে দোল উৎসবে মেতে ওঠে এই গল্ফগ্রিন সেন্ট্রাল পার্ক।
মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। ছাত্রীদের সাজগোজ, পোশাক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নাচের তালিম চলে জোর কদমে। ছাত্রীদের পাশাপাশি উৎসাহের কমতি থাকে না অভিভাবক মহলেও।প্রতি বছরেই রঙিন এই উৎসবকে নতুন মাত্রা দিতে কিছু নতুন রং যোগ করে “উর্মিলা”। অনুপ্রেরণা যোগাতে ফি বছর পাশে থাকেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট শিল্পী ও কলাকূশলীরাও। অতিথি বাচিক শিল্পী সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তিতে “হোরিখেলা” এবং তার নৃত্যরূপ ছিল এ বছরের বিশেষ আকর্ষণ। এই ভাবেই পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নতুন কিছু করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন উর্মিলা।
কিন্তু নতুন রঙে রং মেলাতে গিয়ে প্রথাগত শান্তিনিকেতনী বসন্ত উৎসবের চেনা রং হারিয়ে ফেলতে মোটেই রাজি নন শিল্পী ও নৃত্যগুরু, উর্মিলা। কোনওভাবেই প্রথা ও পরম্পরা থেকে সরে আসতে নারাজ তিনি। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে উগরে দিলেন নিজের ক্ষোভ। বললেন , এটা খুবই বেদনার জায়গা যে, যে কোনও কারণবশত আমরা বাঙালিরা যেন আজ আর নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারছি না। তাঁর মতে, যে কোনও জাতির উচিত তার ঐতিহ্যকে বহন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কবিগুরুর দেখানো পথে, তাঁর অনুপ্রেরণায় শান্তিনিকেতনে যে দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে , তা বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়ে এসেছে চিরকাল। ‘অথচ আজ দেখি ব্যাঙের ছাতার মতো জায়গায় জায়গায় বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যের নাম করে। নামেই বলা হচ্ছে শান্তিনিকেতনের আঙ্গিকে বসন্ত উৎসব অথচ আদতে যা হচ্ছে তা বোধহয় আমাদের কারোরই অজানা নয়। আমার কাছে যা অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যদি কবিগুরুর ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেই না পারি, তাহলে তা নষ্ট করার অধিকারও কিন্তু আমাদের নেই। বসন্তকে সবাই সেলিব্রেট করছেন, খুব ভালো কথা কিন্তু শান্তিনিকেতনী ঘরানায় বসন্ত উৎসব বলে রেকর্ডারে দু কলি রবীন্দ্রসংগীত এবং অন্যান্য গান বাজিয়ে অনুষ্ঠান করলে তাকে বসন্তের উদযাপন বলাই বোধহয় ভালো। তাকে শান্তিনিকেতনী ঘরানা বলা বোধহয় একেবারেই অনুচিত। কবিগুরুর দেখানো পথে না হাঁটতে পারলে অসুবিধে নেই , কিন্তু তাঁর নামকে কলুষিত করার কোনও অধিকার কি আমাদের আছে?
রবীন্দ্রভারতীর ঘটনাকে অবশ্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করছেন শিল্পী। বললেন, ‘এটা অপসংস্কৃতির একটা শেষ সীমা। যাঁরা করেছে কেন করেছে জানি না। অত্যন্ত দীনতার পরিচয় দিয়েছে, সেকথা বলাই বাহুল্য। বসন্ত উৎসবের সঙ্গে এর কোনও যোগ আছে বলেও মনে করি না। সম্ভবত সস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার একটা প্রয়াস ছাড়া এটা আর কিছুই নয়।’