![](https://kolkatanewstoday.com/wp-content/uploads/2019/12/48359964_10218503097994367_8609020687929049088_o.jpg)
কী করে এত সুন্দর ছবি বানালেন , বলুন তো?
আপনার ভাল লেগেছে?
ভাল মানে? অসামান্য — মৃণালের কণ্ঠে মুগ্ধতা।
সত্যজিৎ চুপ করে রইলেন।
তবে আপনার এই বইটা চলবে না— চায়ে একটা বড় চুমুক মেরে বললেন মৃণাল ।
অ্যাঁ, চলবে না, মানে? সত্যজিৎ হতচকিত। এত কষ্ট করে বইটা বানালুম !
না, বানিয়েছেন ত ভালই। শুধু ভাল না, খুবই ভাল। ইন ফ্যাক্ট, এত ভাল বই আপনিও আর কখনো বানাতে পারবেন কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তাহলে?
আরে, মা ছেলের এরকম সম্পর্ক , যা আপনি সিনেমায় দেখিয়েছেন তা ইন্ডিয়ানদের হজম হবে না।
সে কী!
তা না তো কী! ছেলে মা-কে নিয়ে বোর হয়ে যাচ্ছে। মা মারা যেতে তার তেমন ইয়ে ত হচ্ছেই না, উল্টে সে নিজেকে স্বাধীন ভাবছে— এসব এদেশে চলবে না। বিদেশে অবশ্য লুফে নেবে।
![](https://kolkatanewstoday.com/wp-content/uploads/2019/12/1546282852-mrinal_sen-1.jpg)
বুঝতেই পারছেন- কথা হচ্ছিল দুই পরিচালকের মধ্যে। মৃণাল সেন এবং সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে।
আজকের কথা নয়। ষাট বছর আগের কথা।
সদ্য বেরিয়েছে মানিকবাবুর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র । অপরাজিত।
দেখেই এত ভাল লেগেছিল মৃণালের যে তিনি বাড়ি বয়ে চলে এসেছিলেন সত্যজিতের কাছে।
এবং মৃণালের ভবিষ্যৎ বাণী সফল হয়েছিল।
পথের পাঁচালীর তুলনায় অপরাজিত ফ্লপই করেছিল বলতে হবে।
অনেকেই জানতে চান যে সেকালের রথী মহারথী পরিচালকদের নিজেদের মধ্যেকার রিলেশান কেমন ছিল। নিশ্চই ঘাতপ্রতিঘাতপূর্ণ জেলাসির সম্পর্ক।
যেমনটা এখনকারদিনের অনেক ডিরেক্টরদের মধ্যে হয়ে থাকে।
সেরকমটা মোটেও না।
যেমন ধরুন ঋত্বিক , মানে ঋত্বিক ঘটক আর সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে।
দুজনেই দুজনার গুণমুগ্ধ ।
সেসময়কার এক বোহেমিয়ান পন্ডিত মানুষ ছিলেন কমলকুমার মজুমদার।
বিদ্বান এবং ততোধিক ক্ষ্যাপাটে। ভয়ানক অ্যাজমায় ভুগতেন, অথচ ডাক্তার দেখাতে তার বিরাট অ্যালার্জি। কেন চিকিৎসা করান না জিজ্ঞাসা করাতে উনি বলতেন — আসলে অ্যাজমায় ভোগার মধ্যে একটা দুর্দান্ত গ্র্যান্জার আছে, আমি না সেটা কিছুতেই স্যাক্রিফাইস করতে চাইছি না।
তো এই ভদ্রলোকের পথের পাঁচালীর একটা বাদে আর কোনও দৃশ্যই তেমন পছন্দ হয় নি।
কোন দৃশ্যটা পছন্দ হয়েছিল?
ওই যে চিনিবাস ময়রার সিনটা আছে না? পুকুরপার দিয়ে ছন্দে ছন্দে চিনিবাস যাচ্ছে আর পিছন পিছন যাচ্ছে তিনজন – অপু, দুর্গা আর একটা নেড়ি কুকুর।
ওই দৃশ্যটা।
তা সব শুনে টুনে সত্যজিৎ বলেছিলেন— ও গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখিয়ে কমলবাবুকে খুশি করা আমার কম্মো নয়। ও ক্ষমতা আছে কেবল ঋত্বিকবাবুর।
গল্পটার উল্টো পিঠটা এবার শুনুন।
জলসাঘরের শুটিং থেমে গেছে।
কারণ ছবি বিশ্বাস ইউরোপ গেছেন প্রাইজ আনতে। ফিরতে সময় লাগবে। ট্যুর ফুর কমপ্লিট করে আসবেন।
সত্যজিতের হাত খালি।
তো এসময় একজন সত্যজিৎ-গুণমুগ্ধ একজন প্রযোজকের কাছে গিয়ে বললেন — মানিকবাবুর মত একজন গুণী লোক বসে আছেন। ওনাকে দিয়ে এই তালে একটা সিনেমা বানিয়ে নিন না।
প্রযোজক প্রমোদবাবু হাত উল্টোলেন— অসম্ভব। আমার হাতে এখন দুটো ফিল্ম। তপন সিংহ বানাচ্ছেন লৌহকপাট, আর ঋত্বিকবাবু করছেন অযান্ত্রিক।
কথাটা কানে গেল ঋত্বিকের।
উনি প্রযোজকের কাছে গেলেন আর রীতিমত ধমক দিলেন— আপনি পাগল নাকি, মশাই? মানিরবাবুর মতন লোক হাত গুটিয়ে বসে আছেন আর আমি কিনা সিনেমা বানাচ্ছি ! আপনি আমার কাজটা বন্ধ রাখুন, ওনাকে দিয়ে কাজ শুরু করান।
তখন শুরু হল পরশপাথরের শুটিং !
![](https://kolkatanewstoday.com/wp-content/uploads/2019/12/Untitled-8-5c5c5d70548b1.jpg)
শতরঞ্জ কা খিলাড়ির জন্য ভয়েসওভার করতে হবে। কে করবেন?
সত্যজিৎ নিজেই করতে পারেন। ওরকম অসামান্য কণ্ঠস্বর।
না, উনি করবেন না। কারণ হিন্দিটা সত্যজিতের তেমন ইয়ে নয়।
তখন মৃণাল সেনই সাজেশান করলেন অমিতাভ বচ্চনের নাম। সত্যজিৎ লুফে নিলেন।
মৃণালবাবু যখন অমিতাভের কণ্ঠস্বর কাজে লাগিয়েছিলেন তার ভুবন সোম নামের অসাধারণ চলচ্চিত্র টিতে, তখন বচ্চন সাহেবকে কেউ পুঁছত না।
বোঝাই যাচ্ছে জহুরীর চোখ ( এবং কান) ছিল মৃণাল সেনের।
অমিতাভ তিনশ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন — উনি নিতে চান নি, মৃণালই ধমকধামক দিয়ে টাকাটা দিয়েছিলেন।
এক তৈলমর্দক সত্যজিৎকে বলেছিলেন— মৃণালবাবু যে কী বই বানান, কিচ্ছু বুঝতে পারি না। আপনার সিনেমাগুলো কত সুন্দর…
সত্যজিৎ অপাঙ্গে তাকিয়ে বলেছিলেন— সিনেমাটা উনি আমাদের জন্য বানান। সবার না বুঝলেও চলবে।
লেখাটা শুরু করেছিলাম সত্যজিৎ আর মৃণালের কথোপকথন দিয়ে।
এবার সেটা শেষ করি।
সত্যজিৎ খুবই হতাশ হয়েছিলেন তার অপরাজিত না চলায়। তবুও ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে তার সিনেমা( অপরাজিত) পাঠিয়েছিলেন। নিজেও গেছিলেন।
সেখানেও একই রকম অবস্থা। ঈষদুষ্ণ রেসপন্স। যেদিন রেজাল্ট বেরোবে সত্যজিৎ তখন হোটেলে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে পায়চারি করছিলেন তিনি। সেদিন আবার তার ছেলে সন্দীপের জন্মদিন।
নাহ্— মনে মনে গজগজ করছিলেন তিনি। মৃণালবাবুর কথায় বার খেয়ে এখানে আসাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হয় নি, এর থেকে কলকাতায় থাকলে সময়টা অনেক ভাল কাটত।
রুম বেল বাজল।
সত্যজিৎ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
একটি ইয়ং মেয়ে।
আমি ফেস্টিভ্যাল কমিটি থেকে আসছি— মেয়েটি জানাল।
বেশ, তা কী চান? সত্যজিৎ জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনার কোট কোথায়?
কীসের কোট? সত্যজিৎ পরম বিস্মিত।
প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনিতে কোট ত মাস্ট।
ধ্যাৎ। ওখানে কে যাবে?
কে যাবে, মানে? আপনি যাবেন।
কেন?
কেন কী? আপনার সিনেমা ত তিনটে প্রাইজ পেয়েছে।
তিনটে প্রাইজ পেয়েছে? অপরাজিত?
হ্যাঁ। ফেস্টিভ্যালের ইতিহাসে এই প্রথম তিনটে ক্যাটাগরিতেই কোনও মুভি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে।
পরে মৃণালকে ঘটনাটা জানাতে মৃণাল নিরাসক্তভাবে বলেছিলেন — আমি ত আগেই বলেছিলাম।
অন্য কেউ হলে উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে জনে জনে বলে বেড়াতেন— দেখেছ, কী বলেছিলাম !
মৃণাল বরাবরই অনাবেগী।
উনি অনেকবার ঋত্বিক ঘটককে বলেছিলেন — আপনার জায়গায় আমি হলে কখনই ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই’ এই ডায়লগটা মেঘে ডাকা তারা সিনেমায় রাখতাম না। বড্ড মেলোড্রামাটিক।
সেই লোকের যে ইচ্ছা হবে তার মৃতদেহকে যেন কোনও স্পেশাল গান
স্যালুট ট্যালুট জাতীয় সম্মান না দেওয়া হয় — এতে আর আশ্চর্য কী !