হোমঅন্যান্যশান্তিপুরের জামাইষষ্ঠী

শান্তিপুরের জামাইষষ্ঠী

শান্তিপুরের জামাইষষ্ঠী

শুভদীপ রায় চৌধুরী

(ঐতিহ্যের শহর শান্তিপুর, যেখানে একই সঙ্গে শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈবধারার মেলবন্ধন দেখা যায়। এখানে যেমন ধুমধাম করে কালীপুজো হয়, তেমনই হয় রাসযাত্রা উৎসব। দূরদূরান্ত থেকে অগণিত ভক্তদের ভিড় দেখা যায় এই শান্তিপুরে। সবাই আসেন এই প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হতে। আজ এক বিশেষ তিথি। জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথি । অনেকে এই তিথিকে জামাইষষ্ঠী বলেই জানেন। আজকের দিনেই শান্তিপুরের বিভিন্ন বাড়িতে পালিত হয় জামাইষষ্ঠীর রীতিনীতি। আজকে এই অঞ্চলের দুই প্রাচীন পরিবারের রীতিনীতিই তুলে ধরা এল এই প্রতিবেদনে)।

শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ি : শান্তিপুর অঞ্চলের ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের কথা এলেই যাঁদের নাম সবার প্রথমে উচ্চারিত হয় তা হল বড় গোস্বামী বাড়ড়। এই বাড়ির ইতিহাস বহুপ্রাচীন। শ্রীঅদ্বৈত পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড়পুত্র রাঘবেন্দ্র থেকেই সূচনা এই বাড়ির। অদ্বৈতাচার্যের সেবিত নারায়ণ শিলা আজও নিষ্ঠার সাথে সেবিত হয় এই গোস্বামী বাটীতে।

এই বাড়ির প্রধান দেবতা হলেন শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ, কষ্টিপাথরের বিগ্রহ, যে বিগ্রহকে কেন্দ্র করে শান্তিপুরের রাস উৎসব, দোল উৎসব, ঝুলনযাত্রা থেকে শুরু করে সব উৎসবে ভক্তবৃন্দরা মেতে ওঠেন। এই বিগ্রহ অতীতে পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামেই পূজিত হতেন। এর বহু বছর পরে বসন্ত রায়ের পরিবার কৃষ্ণবিগ্রহকে তুলে দিলেন তাঁদের গুরুদেব অদ্বৈতপৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে, সেই থেকে এই রাধারমণ বিগ্রহ পূজিত হয়ে আসছেন বড় গোস্বামী বাড়িতে।

জামাইষষ্ঠীর দিন শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ’র বিশেষ পূজা হয়, বলা যেতে পারে জামাইষষ্ঠীর আদর খেতে প্রস্তুত থাকেন শান্তিপুরের ঐতিহ্য- শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ। অতীতে রাধারমণ জিউ শ্বশুরবাড়ির এক মন্দিরে যেতেন জামাইষষ্ঠীর দিন, দুপুরবেলা ভোগ নিবেদনও হত সেই মন্দিরেই। কিন্তু বর্তমানে মন্দিরের ভগ্নদশার কারণে সেই উৎসব পালিত হয় না।

তবে রীতিনীতি আজও বর্তমান। আজও শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁর জন্য নতুন ধুতি, নতুন বস্ত্র আসে। পাখার বাতাস করা হয় এই দিন তাঁকে তারপর নৈবেদ্যভোগ নিবেদন হবে। দুপুরবেলা অন্নভোগ নিবেদন করা হয়, ভোগে থাকে- সাদাভাত, শাক, শুক্তনি, ভাজা, মোচার ঘন্ট, ডাল, এঁচড়ের তরকারি, ছানার ডালনা, পোলাও, চাটনি, পায়েস, দই এবং নানান রকমের মিষ্টান্ন ইত্যাদি। রাতে ভোগে থাকে চিঁড়ে মাখা, মিষ্টি ইত্যাদি। একেবারে বলা যেতে পারে জামাইষষ্ঠীর দিনে শ্রীশ্রীরাধারমণের বিশেষ যত্ন আত্তি করা হয় রাজকীয়ভাবে।

শান্তিপুরের চাঁদুনী বাড়ি : আগেই বলেছি শান্তিপুর শাক্ত-বৈষ্ণব ও শৈবধারার একত্রিত পীঠস্থান। শান্তিপুরের কালীপুজোর কথা বললেই আগমেশ্বরী কালীপুজোর পরই যে পুজোর কথা সবার আগে মনে আসে, তা এই চাঁদুনীবাড়ির চাঁদুনীমায়ের কথা।

প্রসঙ্গত কাশীনাথ সার্বভৌমের ভাই গোপীনাথ সার্বভৌম তন্ত্রসাধনা করতেন। এই পরিবারের পদবী মুখোপাধ্যায়। তাঁরা পণ্ডিত ছিলেন। তাই তাঁরা “সার্বভৌম” উপাধি পেয়েছিলেন। গোপীনাথ সার্বভৌম একদিন স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে , তাঁর বাড়ির কাছেই এক কূর্মপীঠ রয়েছে সেখানে পঞ্চমূণ্ডির আসনে মাকে পুজো করার। সেই থেকে এই পরিবারে কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মুখোপাধ্যায় পরিবারে দুর্গাপুজোও হয় ধুমধাম করে।

জামাইষষ্ঠীর দিন মুখোপাধ্যায় পরিবারে শিলাময়ী মা ষষ্ঠী রয়েছেন যিনি নিত্যসেবিত। জামাইষষ্ঠীর দিন আলপনা দিয়ে বেড়াল এঁকে করে তার ওপর মাকে বসিয়ে পুজো করা হয়। বাড়ির পুত্রবধূরা(যাদের সন্তান আছে), তারা প্রত্যেকেই ছোট ছোট ৬টি মাটির হাঁড়িতে করে দই নিবেদন করেন মাকে। পুজোর পর তারা সবাই মা ষষ্ঠীর মাথায় জল ঢালেন, জল ঢালার পর দই’র হাঁড়িগুলি অদলবদল হবে। তারপর বাড়ির সব পুরুষ সদস্যদের পাখার হওয়া দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলুদের ফোঁটা দিয়ে ষষ্ঠীদেবীর আশীর্বাদ দেওয়া হয়। সেই দিন চাঁদুনীবাড়ির পুত্রবধূদের ফলাহার করারই বিধান। ছবিতে উল্লিখিত গোপাল মূর্তিটি আনুমানিক আড়াইশো বছরের প্রাচীন, মা শিলাময়ীও তাই। তবে মুখোপাধ্যায় পরিবারের নারায়ণ শিলাটি চাঁদুনী মায়ের সমসাময়িক কালের বলেই জানালেন পরিবারের সদস্য।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img