বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর বর্ণাঢ্য ঠাকুর পরিবারের এক আশ্চর্য পুরুষ। উনিশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমানায় মাত্র ৫১ বছরের জীবনে বহুমুখী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন,যা তাঁর সমসময়ে বিস্ময় উদ্রেককারী ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত। কতখানি ব্যবসায়িক বুদ্ধি থাকলে ব্যাঙ্ক,কয়লা,রেল,চা, ইন্সিওরেন্স,লবণ,মদ,আফিম,জাহাজ–এতগুলো ব্যবসায় হাত দেওয়া যায়। দ্বারকানাথের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সূচনা করেন ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। আদিতে কোম্পানির সদর দপ্তর ছিল অধুনা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের কাছে রানি মুদি গলিতে। পরে তাঁর ব্যবসা বিশালাকার হয়ে যাওয়ায় কোম্পানির সদর দপ্তর নিয়ে যাওয়া হয় হেস্টিংস স্ট্রিট ধরে সোজা পশ্চিমে গঙ্গার ধারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের বাইরে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছিল ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’। ২৯ বছর বয়সে সরকারি নুনের গোলার সেরেস্তাদারের চাকরি থেকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পোদ্যোগী। কারণ, তাঁর সমসময়ে তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন ইউরোপীয় ধাঁচে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যার জন্য অনেক গবেষক দ্বারকানাথকে কমপ্রদর বা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, মূৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা ছিলেন বৈদেশিক পুঁজির উপর নির্ভরশীল।
বিগত বছর(২০১৯) দ্বারকানাথের ২২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের এই শিল্পোদ্যোগীকে নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং
দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ( সংক্ষেপে যা ইনটাক হিসেবে বহুল প্রচলিত) যৌথভাবে একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিলো। সেই আলোচনা সভাতেও পথিকৃত এই উদ্যোগপতি মানুষটিকে নিয়ে জীবনের নানা কথাও বেরিয়ে আসে।
যাই হোক, কৃষি ও ব্যবসায় সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বারকানাথ ১৮২৯ সালে ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’ নামে জয়েন্ট স্টক ব্যাঙ্কের সূচনা করেন। এটাই ছিল বৃটিশ ভারতীয় প্রথম ব্যাঙ্কিং উদ্যোগ। এই ব্যাঙ্কের অন্যতম ভারতীয় ডিরেক্টর ছিলেন দ্বারকানাথ। দুর্ভাগ্যবশত নানান দুর্নীতির কারণে ১৯৪৮ সালে ব্যাঙ্কটিতে লালবাতি জ্বলে অর্থাৎ উঠে যায়। আসাম কোম্পানি, চায়ের ব্যবসার জন্য যার সুনাম বিশ্বজোড়া, তার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং বাবু মতিলাল শীল। আসাম প্রতিষ্ঠা ১৮৩৯ সালে। গড়ে তুলেছিলেন রেল কোম্পানি ‘গ্রেট ওয়েস্টার্ন অব বেঙ্গল’। পরিচালন ব্যবস্থায় নিয়েছিলেন নরসিংহ চন্দ্র রায়, রামরতন রায়, ব্রজনাথ ধর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে। ‘গ্রেট ওয়েস্টার্ন অব বেঙ্গল’ পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে মিশে যায়। তৈরি করেছিলেন বেঙ্গল কোল কোম্পানি। রানিগঞ্জে বেঙ্গল কোল কোম্পানির খনির পাশ দিয়ে গিয়েছিল গ্রেট ওয়েস্টার্ন অব বেঙ্গল-এর রেললাইন, যার স্মৃতিচিহ্ন এখনও আছে এবং যা নিয়ে রানিগঞ্জবাসী যথেষ্ট গর্ব অনুভব করেন। এই কোল কোম্পানির খনি পরবর্তীকালে অ্যান্ড্রু ইয়ুল কোম্পানির হাতে যায়। বেঙ্গল কোল কোম্পানি অধিগ্রহণ করে কোল ইন্ডিয়া। তৈরি করেছিলেন বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি। যে কোম্পানিতে বাবু মতিলাল শীল ছাড়াও ঠাকুর পরিবারের আরেকটি শাখার প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রমানাথ ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা ছিলেন। করেছিলেন জাহাজ কোম্পানি ‘আই জি এম আর’, জাহাজ সরানোর প্রতিষ্ঠান ‘ক্যালকাটা ডকিং কোম্পানি’। দ্বারকানাথের মদের কোম্পানিতে প্রস্তুত রাম বিদেশে রপ্তানি হত, যা যথেষ্ট সমাদৃত ছিল।
এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা দরকার। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা রদ আন্দোলনে দ্বারকানাথ প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। আবার রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্ম সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। কিন্তু নিজে ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। দ্বারকানাথের উত্তর পুরুষ ও তাঁর জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়েছেন, বিলেতে গিয়েও তিনি রীতিমত শুদ্ধাচারে ইষ্ট মন্ত্র জপ-ধ্যান করতেন। ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা আন্দোলনে রামমোহনের পাশে সক্রিয়ভাবে থেকেছেন দ্বারকানাথ। ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ সাপ্তাহিক পত্রিকা ও ইংরেজি পত্রিকা ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী ছিলেন দ্বারকানাথ। ১৮২৩ সালে ‘জনবুল’ পত্রিকাটি কিনে নেন, যা পরবর্তীকালে ‘ইংলিশম্যান’ হিসেবে প্রকাশিত হয় নাম বদল হয়ে। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর বৃটিশ সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করলে দ্বারকানাথ বড়সড় আন্দোলন গড়ে তোলেন। টাউন হলের সভায় তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল মনে রাখার মতো।
কিন্তু প্রশ্ন হল, দ্বারকানাথ যে বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর পরবর্তী প্রজন্ম বা পরিবারের অন্য সদস্যরা সচেষ্ট হলেন না কেন? এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করা যায়, দ্বারকানাথের পৌত্র ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ইনল্যান্ড রিভার স্টিম নেভিগেশন সিস্টেম নামে একটি জাহাজ কোম্পানি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বৃটিশ কোম্পানি ‘ফ্লোটিলা’র সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারেনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজ কোম্পানি। ফ্লোটিলা জাহাজ কোম্পানি ভাড়ার হার এতটাই কমিয়ে দেয় যে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিল না জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কোম্পানির। ফলে সেই কোম্পানিও আর টেকেনি,মুখ থুবড়ে পড়ে। আর দ্বারকানাথের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য টিকলো না, সে ব্যাখ্যাও তাঁর বড় ছেলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ দিয়ে রেখেছেন। তাঁর কথায়, দ্বারকানাথ তাঁর তীক্ষ্ণ বৈষয়িক বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন,তাঁর অবর্তমানে ছেলেরা এই বিশাল সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে না। তাই তাঁর সুবিশাল জমিদারির চারটি জমিদারি ট্রাস্ট করে দেন। যাতে সর্বস্ব চলে গেলেও এই চারটি জমিদারি যাতে রক্ষা পায়। তাই এই ট্রাস্ট ডিড। আর কালক্রমে সেটাই হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর যখন সমস্ত ব্যবসা অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তখন কিন্তু ওই চারটি জমিদারি রক্ষা পায়। শেষ পর্যন্ত ট্রাস্ট ডিড ছিল বলে। প্রিন্স দ্বারকানাথের যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন আলামোহন দাস ও স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি। সুযোগ পেলে সে বিষয়ে পরে আলোচনা করব।