হোমফিচার!! মূর্খের জয়জয়কার !!

!! মূর্খের জয়জয়কার !!

!! মূর্খের জয়জয়কার !!

আশীষ রহমান

ছোট বেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম, আমার কোন এক কাকা নাকি পড়াশুনায় খুব ফাঁকিবাজ ছিলেন । লেখাপড়ায় তাঁর একেবারেই মন ছিল না । এ ব্যাপারে বাড়ীর কেউ তাঁকে কিছু বললেই তিনি বলতেন, – সবাই যদি পড়াশুনা করে তো একদিন দেশে মূর্খের বড় অভাব হবে, যদি কোনদিন মূর্খের প্রয়োজন হয় তো তখন আমার মত মূর্খ সবার আগে থাকবে ।

আজ মনে হচ্ছে যে, কথাটা সত্যিই বড় প্রাসঙ্গিক । শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমগ্র জগৎই যেন এক ভয়াবহ অবনমনের দিকে চলে যাচ্ছে । সর্বক্ষেত্রেই হতাশার কালো মেঘ প্রতি নিয়ত যেন আমাদের গ্রাস করে চলেছে । আমি ছবি আঁকি, আর তারই সুবাদে চিত্রশিল্পের সাথে আমার সামান্য হলেও কিছুটা যোগেযোগ আছে । ইদানীংকালের চোখে পড়ছে বেশ কিছু শিল্পী ছবি আঁকার চেয়ে রাজনীতি করাটা তাঁদের পচ্ছন্দের তালিকায় নথিভুক্ত করে ফেলেছেন, সেটা যদিও তাঁদের ব্যক্তিগত পছন্দের জায়গা । আসল কারণটা খুব স্বাভাবিক, ছবি আঁকতে গেলে যে শৈল্পিক মনের প্রয়োজন, যে নিরপেক্ষ মানসিকতার প্রয়োজন, যে ভাবনার প্রয়োজন, সেইসব ধ্যানধারণায় আজ যেন ভাটা পড়েছে ।

অর্থ রোজকার করাটা যেখানে প্রাধাণ্য, সেখানে উন্নতমানের শিল্পকর্মের বিচ্যুতি ঘটবেই । কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর হল, বর্তমানে ভিন্ন জগতের কিছু মানুষজন, হিজিবিজি কিছু একটা এঁকে আকাশছোঁয়া মূল্যে বাজারে বিক্রি করছেন । আর্ট কলেজে পড়াশুনা করে, ভাল ও খারাপ ছবি বোঝার ক্ষমতা, ক্ষীণ হলেও বুঝতে খুব একটা অসুবিধা আমার হয় না । অপরে অর্থ উপার্জনে আমার তেমন কোন আপত্তি নেই ঠিকই । কিন্তু ভয় হয় যখন দেখি সেই সব জঘণ্য ছবিগুলোকে বিশিষ্ঠ কিছু শিল্পীরা প্রশংসার ঝড় বহিয়ে দেন ।

যাঁরা সদ্য আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে ছবি আঁকতে শুরু করেছেন, তাঁদের কাছে এই সকল বিশিষ্ঠ শিল্পীরা অনেকেরই মনিকোঠায় গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত । আগামীদিনে সেই সব তরুন শিল্পীদের জীবনে বিষণ্ণতা গ্রাস করবে । শিল্পী সমাজে তৈরী হবে এক ঝাঁক ব্যার্থ মূর্খ শিল্পী । যাঁরা জীবনে প্রস্ফুটিত হবার আগেই শুকিয়ে যাবেন ।
আমাদের ছেলেবেলায় বাংলা শিশুসাহিত্যের যে রমরমা ছিল, আজ সেগুলো অবলুপ্তির পথে । “ঠাকুরমার ঝুলি,” “টুনটুনির বই,” “আলাদিন,” “আলিবাবার গল্প,” “রাজ কাহিনী,” “ক্ষীরের পুতুল,” “বুড়ো আংলা” আরও কত যে সাহিত্য ভাণ্ডার আমাদের সময় ছিল, তা বলে শেষ করা যাবে না ।

“আবোল তাবোল” আর “হযবরল” যেন এই বয়সে আজও পড়তে নতুন লাগে । আজকালকার শিশুরা এর থেকে বঞ্চিত । রমাপদ চৌধুরীর ভাষায় শিশুসাহিত্য রচনা করাটা মোটেই শিশুসুলভ কাজ নয় । আজকাল অনেকেই শিশুসাহিত্য লিখছেন ঠিকই, কিন্তু কোন কল্পনার চরিত্র সৃষ্টি করার মত ক্ষমতার অভাব খুবই অনুভব করি । বর্তমানের শিশুসাহিত্য তেমন ভাবে শিশুদের মনে দাগ কাটে না বলেই আমার ধারণা । আমাদের ছেলেবেলায় যে সকল কাল্পনিক চরিত্র পড়ে, শিশুরা তাঁদের নিজস্ব কল্পনার পৃথিবী গড়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন, সেই ধরনের চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা বর্তমানে থাকলেও, কোথায় যেন খামতি রয়ে গেছে ।

সে আমলে বীরপুরুষ কবিতাটা পড়ে সব শিশুই নিজেদের বীরপুরুষ মনে করে, মাথায় পাগড়ি পরে আর কোমরে বেল্টের মাঝে স্কেল গুজে নিজেকে বীরপুরুষ মনে করতো । পরবর্তীকালে শৈশব আর কৈশোর জীবনে টেনিদা, ঘনাদা এবং ফেলুদার চরিত্র আমাদের চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছিল । আসলে মানুষকে শিক্ষিত করতে হলে, তার শিশুকাল থেকেই সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন । কিন্তু বাস্তবে শিশুদের জীবন ক্রমেই যেন টেলিভিসন, ল্যাবটপ আর মোবাইল ফোনে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ।

তবে সেটা যে সব ক্ষেত্রে খারাপই হচ্ছে, এমনটাও নয় । মুসলমান বাড়িতে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও আমার বাবা আমাদের “ছোটোদের রামারণ ও মহাভারত” পড়তে শিখিয়েছিলেন । তিনি এই বইগুলোকে শিশু সাহিত্য হিসাবেই আমাদের পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, কোন বিশেষ ধর্মের গ্রন্থ হিসাবে নয় । অনেকেই হয়তো ভাববেন এখানে আমার ধর্মের পরিচয়টার কি কোন প্রয়োজন ছিল ! বর্তমানে আমাদের সমাজটা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি, সেখানে আমার পরিচয়টা খুবই প্রাসঙ্গিক । কারণ এখন সাম্প্রদায়িকতাই আমাদের মূল মন্ত্র হতে চলেছে ।

এই লেখার প্রথমেই যে মূর্খের কথা বলা হয়েছে, সেই প্রকৃত মূর্খকুলের কথাই এবার বলি । বর্তমানে আমাদের সমাজে যারা রাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই এই মূর্খের দলেই পড়েন বলেই আমার বদ্ধমূল ধারণা । দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে কি ভয়ঙ্কর সেটা আমরা সবাই অনুভব করতে পারছি । এরই মাঝে দাঁড়িয়ে যে অত্যন্ত জরুরী কাজগুলো দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা অত্যাবশ্যক, সেদিকে মনসংযোগ না করে, আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ নিজেদের ভোটবাক্সের দিকে মননিবেশ করে চলেছেন ।

ফলত, গরীব দরিদ্রশ্রেণীর মানুষজনের দূর্দশার অন্ত নেই । আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরের বহু জায়গায় মুসলমান, খ্রীষ্টান ও নিম্নবর্গের বিরূদ্ধে অপপ্রচারের নমুনা চোখে পড়ার মত । এবং সবচেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার হল এই অশক্ষিত নেতৃত্বকুলের মুখ থেকে নির্গত উস্কানিমূলক বিবৃতি, যেটা বর্তমানে প্রায় রোজই সংবাদ মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ে । কেউ হিন্দু তোষামোদ আর কেউ বা মুসলমান তোষামোদে নিজেদের আর দেশের বেশ কিছু মূর্খ জনগণকে মজিয়ে রেখেছেন ।

এই মূর্খ জনগনের একটা বৃহৎ অংশই সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং পুঁথিগত বিদ্যায় উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত । এই মূর্খশ্রেণীকূল প্রধাণত উচ্চমধ্যবিত্তের আওতায় পড়েন । এঁরা নিজেদের বিচারবুদ্ধি আর মস্তৃষ্কের ব্যবহার না করেই, নির্বোধ নেতাদের ধামাধারি হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন । সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে এরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নন । এদের আলোচনা ও চিন্তাভাবনার বিষয়বস্তু হল শেয়ার মার্কেট, আয়কর, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি । পাশ্চাত্য প্রথাকে পাথেয় করেই এদের বেঁচে থাকা ।

আমাদের সবচেয়ে উচ্চমানের নির্বোধ মূর্খকুল হল অসৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, ফলে পঞ্চাশ শতাংশ লোকসভার সদস্যই আজ দুর্নীতিগ্রস্থ । বহু অমুসলমান রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের ইদানিং হিজাব পরে বা মাথায় একটা টুপি লাগিয়ে ইফতার পার্টিতে ঢুকে পড়ার দৃশ্য প্রায়শই চোখে পড়ছে । এক্ষেত্রে ইসলাম বিপন্ন বলে যে মূর্খের দল বাজার গরম করতেন, তাঁরা টুঁ শব্দটি করছেনও না । সেক্ষেত্রে ইসলামের যা হয় হোক, আমাদের কিছু অর্থের (ইমাম ভাতা) আমদানি হলেই হল । মুসলমান তোষামোদের এই নগ্নরূপ আমাকে লজ্জিত করে । আবার আর একদল বলছেন করোনার হাত থেকে বাঁচতে গোমূত্র পান করুন, গোবর গায়ে মাখুন, গরুর দুধ থেকে সোনা পাওয়া যায়, গঙ্গা নদীর জল দিয়ে কোরোনার প্রতিষেধক করা যায় ইত্যাদি নানান মুর্খের প্রলাপ বকেই চলেছেন । কেউ আবার বলেই বসলেন, গরু তাড়ানোর মত কোরোনা তাড়ানোর জন্য মোমবাতি জ্বালান ।

আমাদের দেশের মূর্খ জনগণ আনন্দের সাথে উৎসবও পালন করে ফেললেন । বাস্তবিক দিক থেকে বিচার করলে দেখতে পারবো যে, এইসব অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন বিবৃতি, মানুষকে শুধু যে বিভ্রান্তই করছে তা নয় সমাজকেও কলুষিত করছে । তবে আশার কথা হল, বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন, সাহসী ও যুক্তিবাদী । এই জাতীয় অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন বিবৃতি তাদের কোন ভাবেই আকৃষ্ট করে না ।

কিন্তু বর্তমানের যুব সমাজ বড়ই রাজনীতি বিমুখ । দেশের জন্য বিন্দুমাত্র তাঁরা বিচলিত নন । এ আচরণ যদিও খুবই আশ্চর্য্যের, তবুও যতদিন না আমাদের দেশের দায়িত্ব এই যুবসমাজ কাঁধে তুলে নেবেন, ততদিন আমাদের এই মূর্খের স্বর্গেই বাস করতে হবে ।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img