নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়:
নতুন বছরের গোড়াতেই ইসরোর চেয়ারম্যানের ঘোষণা চন্দ্রযান-৩ এর অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গগনযান অভিযানের জন্য চার নভোশ্চর বাছাই পর্বও সারা। রাশিয়ায় প্রশিক্ষিত হবেন তাঁরা। ভাবুন তো, এর ঠিক দিন পনেরো বা কুড়ি আগের কথা। গোটা দেশ সাক্ষী থেকেছে অন্য এক ছবির। নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়কে জড়িয়ে ফেলে তৈরি হয়েছে চরম নাগরিক-সংকট। কোথাও বাস ভাঙচুর, কোথাও দাউদাউ করে জ্বলেছে ট্রেন। জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে ছাত্র সমাজ। মতের অমিল হলেই প্রকট হয়েছে আমরা ওরা বিভাজন। এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে কিছু মানুষের। “নাগরিক” উত্তাপের সেই আঁচে ছারকার হয়েছে এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তও। মোদ্দা কথা, মানুষ দিশেহারা। কোনটা ঠিক? কোনটা ভুল? অনেকটা ডিকেন্সের টেল অব টু সিটিজের শুরুর সেই লাইনগুলোর সঙ্গে কোথাও যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity.
আমরাও যেন খানিকটা সেরকমই এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। শিয়রে যখন এমন সংকট বিষাক্ত সাপের মতো নি:শ্বাস ফেলছে , সেই অস্থির সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে অঞ্জন দত্ত বেছে নিয়েছেন থিয়েটারকে। তবে এবার ব্রেখট, সাত্রে বা মিলার নয়, আশ্রয় নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। মূল নাটক “বিসর্জন” এর ব্যঞ্জনাকে এক রেখে কিছু অদল বদল এনে মঞ্চস্থ করেছেন “রঘুপতি”, যা একান্তই অঞ্জন ঘরনার, সমকালীন এবং গভীরভাবে রাজনৈতিক। রঘুপতি মানবিকতার পাঠ শিখিয়েছে জয়সিংহকে। রঘুপতিই আবার ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে ক্ষমতা কায়েম করতে চাইছে হিংসার মাধ্যমে। অঞ্জন দত্ত ঠিক এ ভাবেই রঘুপতির চরিত্রকে তুলে ধরেছেন দর্শকদের সামনে। এখানে রঘুপতি কখনই রাজা হতে চাই না। বরং রাজা গোবিন্দমানিক্যকে চালনা করতে চায়। মানে কিং মেকার। অনেকটা আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মতো যেখানে মন্ত্রী সান্ত্রীদের চালনা করে চলেছে অন্য কেউ বা কোনও সংগঠন। পরিচালক রবীন্দ্রনাথের বিসর্জনকে এই সময়ের মতো করে মঞ্চস্থ করে দর্শকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন জটিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট, সমস্যা, কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাননি। উল্টে ধাক্কা দিয়েছেন। সরলীকরণের পথে না হেঁটে দর্শকদের আরও ভাবার পরিসর করে দিয়েছেন। অঞ্জন দত্তের নিজের কথায় “ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আশার আলো দেখতে পারছিনা। এক রঘুপতি থেমে গেলেও, সামাজিক ও অর্থৈনিতক পরিস্থিতি আবার একটি রঘুপতির জন্ম দিতে পারে। নিজেদের অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন”।
গোটা থিয়েটার জুড়ে রঘুপতি ও জয়সিংহের অভিনয়ের কেমিস্ট্রি বহুদিন মনে রাখবে দর্শক। বর্তমান সময়কে মাথায় রেখে রঘুপতির বেশ কিছু মনোলগ থিয়েটারটিকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রা দিয়েছে। আর চরিত্রের মধ্যে সম্পূর্ণ ঢুকে পড়া, সেটা অঞ্জন দত্তের মতো ক”জন পারেন? হল থেকে বেরনোর পরেও, এ প্রশ্ন আপনাকে ভাবাবেই। জয়সিংহের ভূমিকায় সুপ্রভাতের অভিনয় কোনও একটি বিশেষ বিশেষণে চিহ্নিত না করলেই ভালো। চরিত্রের অস্থিরতা, দোটানা, দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলতে যা যা করা প্রয়োজন, সুপ্রভাত সেই সব শর্ত পূরণ করেছেন সাবলীলভাবে। অপর্ণার প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রেমের কোনও দ্বৈববাণী নয়, বরং প্রকাশ পেয়েছে অস্থির দ্বিমুখিতা যা আমরা দৈনন্দিন জীবনেও অনুভূব করি। জয় সিংহের অবস্থা অনেকটা… শ্যাম রাখি না কূলের মতো!। গুরুর প্রতি অগাদ ভক্তি, শ্রদ্ধা। অন্যদিকে অপর্ণার প্রতি গভীর ভালবাসা। শেষ পর্যন্ত গুরুর জন্য প্রাণ বিসর্জন। অপর্ণার চরিত্রে এনএসডি পাস আউট রুক্মিণী সরকারের দাপটের সঙ্গে অভিনয়, তাঁর উজ্জ্বল কেরিয়ারের দিশারী। সারা দুনিয়ায় ভালো অভিনেতাদের জন্ম দিয়েছে থিয়েটার। অঞ্জন দত্তর রঘুপতি আবার একবার সেটাই প্রমাণ দিল ১৯ ডিসেম্বর জ্ঞানমঞ্চে। রাজা গোবিন্দমানিক্যের ভূমিকায় লোকনাথ দে থেক অপর্ণার চরিত্রে রুক্মিণী সরকার..প্রত্যেকেই নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। এই নাটকের উপরি পাওনা অবশ্যই নীল দত্তের ব্যাক গ্রাউন্ড স্কোর। বিশেষ করে “বসন্ত” ও “গণতন্ত্র” গান দুটি রঘুপতির বিষয় ভাবনার পরিপূরক। এছাড়া ছন্দা দত্তের ছিমছাম মঞ্চসজ্জা ও উষ্ণক বসুর আলোর ব্যবহারে বুদ্ধিমত্তার ছাপ অবশ্যই রঘুপতি নাটকের অন্যতম সম্পদ। যাঁরা এখনও দেখেননি, আর দেরি করবেন না। আট ফেব্রুয়ারি সন্ধেয় ফের জ্ঞানমঞ্চে মঞ্চস্থ হতে চলেছে রঘুপতি।