হোমPlot1"তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী"

“তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী”

“তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী”

বিকাশ পাল, লন্ডন
‘কফোঁটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে?’ এটি একটি কালজয়ী আধুনিক বাংলা গানের প্রথম লাইন। সত্যি ভালোবেসে চোখের জল ফেলা যায়, কিন্তু চোখের জল ফেলার পরও কি ভালোবাসা যায়? সত্যিই যায়।
“প্রেম চিরদিন কাঁদিয়ে গেছে কেঁদেছে মানুষ তবু  ভালো তো বেসেছে”। এই বোধটি আমার ধারণায় বাঙালির প্রেমের চেতনাতে তাঁর গান শুনেই চিরস্থায়ী হয়েছে। ভারতের এক কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী, আমার, আপনার আরও অনেকের প্রিয় মান্না দে। ১ মে, তাঁর জন্মদিন। সত্যিই তাঁর গান শুনে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে আজও প্রেম করে, প্রেমে ব্যর্থ হয়,  ব্যর্থ হয়েও আবার প্রেম করে।

আমি তখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। একদিন আমাদের বাড়ির উঠোনে সন্ধেবেলায় পাশের গ্রামের সত্যদা হ্যারিকেনের আলোয় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছিলেন ‘রঙ্গিনী কতো মন মন দিতে চায়, কি করে বোঝাই কিছু চাই না’, এ গান কে গেয়েছেন, তা ভাববার বা জানতে চাওয়ার বয়স তখনও আমার হয়নি। তার প্রায় ১২-১৩ বছর পর আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমার স্কুল হস্টেলের বন্ধু সুপ্রিয় বলল, তাদের তমলুকের বাড়ির পাশেই মান্না দে নাইট হচ্ছে, আমি যেতে চাই কিনা। সেদিন সুপ্রিয়র সাথে হস্টেল সুপারকে না বলেই চলে গেলাম তমলুক। ১০ মাইলেরও বেশি রাস্তা।

বাসের ভেতরে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই, তাই বাসের খোলা ছাদে বসেই তমলুক পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, হাসপাতাল লাগোয়া মাঠে একটা বিরাট প্যান্ডেল বেঁধে  অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ১৫ টাকার টিকিট কেটে আমরা পেছনে মাটিতে বসে গেলাম। অন্তত ৫-৬ হাজার মানুষ অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা থেকে এসে জড়ো হয়েছেন গান শোনার জন্য। সেদিন মান্নাবাবু প্রায় ২০-২৫টা  বাংলা গান করেছিলেন। তবলায় বিখ্যাত রাধাকান্ত নন্দী। শ্রদ্ধেয় সুপর্ণকান্তি (ঘোষ) দার সুরে পুলকবাবুর লেখা সারা জীবনের গান তখন (১৯৮২-৮৩) সবে বাজারে এসেছে। সেই গানগুলিকে আরও জনপ্রিয় করার জন্যে মান্নাবাবু জলসাতে গাইলেন। ‘মা, মা গো মা আমি এলাম তোমার কোলে’, ‘এসো যৌবন এসো হে’, ‘মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়’…।

আরও অনেক পরে যখন আমি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি, আবার সুযোগ এলো মান্নাবাবুর লাইভ অনুষ্ঠানে গান শোনার। আমাদের ইউনিভার্সিটির বার্ষিক  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান  ‘সংস্কৃতি’ তে তিনি গেয়েছিলেন। ইউনিভার্সিটির মুক্তমঞ্চ,  ওপেন এয়ার থিয়েটারে। সেদিন শুরু করেছিলেন রঙ্গিনী কতো মন গানটি দিয়ে। খোলা মঞ্চের সামনের দিক থেকে ভীষণ জোরে হাওয়া আসছিল, ওনার গাইতে অসুবিধা হচ্ছিল। 

‘রঙ্গিনী কতো মন’ গানটি ১৯৬০এর দশকের, একেবারে শেষের দিকের গান। আমার চেয়ে এ গান বয়সে বড়। তার প্রায় ২০ বছর আগে থেকেই তিনি হিন্দি সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেই বেশ নাম করেছেন। আসমুদ্র হিমাচলের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ তাঁর গান শোনেন। প্রথম সাফল্য  আসে ১৯৫০-এ। ‘মশাল’; ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি গেয়ে। তারপর একটার পর একটা বাজিমাত করা গান। লতাজির সাথে দ্বৈত কণ্ঠে  রাজকাপুর নার্গিস জুটির জন্য ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’, ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’। ‘দো বিঘা জমিন’-এ  ‘ও ভাইরে’, কাবুলিওয়ালাতে ‘অ্যায় মেরে প্যারে ওয়াতন’, মেরি সুরত তেরি আঁখেতে ‘পুছো না ক্যায় সে ম্যায় নে রায়েন বিতাই’,  দিল হি তো হ্যায় তে ‘লাগা চুনরি মে দাগ’, ওয়াকত-এ ‘অ্যায় মেরি জোহরা জুবিন’। শেষের এই গানটি তো ৬০ বছরেরও বেশি হোল উত্তর ভারতের  বিয়ে বাড়ির একটি বাঁধা গান হয়ে গেছে। এরকম আরও কত গান, সব লিখতে গেলে এই লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে।

কিন্তু তাঁর এই আকাশছোঁয়া সাফল্য সহজে আসেনি। অনেক পরিশ্রম অধ্যাবসায় তালিম নিয়ে এগোতে হয়েছে নানান বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও। তিনি এই লড়াইটা উপভোগ করতে পেরেছিলেন বলে  বোধ হয় তাঁর ভেতরের সবচেয়ে ভালোটা দিতে পেরেছিলেন তাঁর গানে। তিনি একবার পুলকবাবুকে দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি আমার লাইফে অনেক স্ট্রাগল্ করেছি। এখনও করি। স্ট্রাগল্ করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে জানেন।” 

মানুষের জীবনে দুঃখের মধ্যেও একটা সুখ থাকে। ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ গানটি রেকর্ড করার দিনের একটা ঘটনা উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক। চোরি চোরি ছবির এই গানটির সুর করেছিলেন শঙ্কর-জয়কিষেন জুটি। রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে রাজকাপুর আর নার্গিসজি এসেছেন। রাজসাহেবের লিপে মান্নাবাবু আর  নার্গিসজির লিপে লতাজি। ছবির প্রযোজক এসে জানতে চাইলেন লতাজির সাথে মান্না দে কেন?  উনি ছবিটির বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা ভেবে চাইছেন  রফি/মুকেশদের। শঙ্করজি বললেন, গানের সুর তিনি মান্নাবাবুকে ভেবেই করেছেন। বললেন, এই কম্পজিশানে সুরের রেঞ্জ মন্দ্র সপ্তক  থেকে তার সপ্তকের অনেক উপর পর্যন্ত আছে। যেমন অন্তরাতে একটা লাইন আছে এই গানের  ‘ইথলাতি হাওয়া নীলম সে গগন, কলিওঁ পে  ইয়ে বেহসি কি নমি’। যাঁরা এই গানটা শুনেছেন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন এটা সুরের কত উপরের সপ্তকের দিকে। আবার ঠিক পরের লাইন ‘জীবন মে না জানে ক্যায়া হ্যায় কমি’। এখানে সুরটা দ্রুত লয়ে ঝপ করে নীচের সপ্তকের দিকে নেমে যাচ্ছে। একমাত্র মান্নাবাবুর গলায় সেই রেঞ্জ, পাওয়ার, কমনীয়তা ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, যেটাকে শঙ্কর-জয়কিষেন জুটি কাজে লাগানোর জন্য এইভাবে সুর করেছেন। কিন্তু প্রযোজক এসব মানতে নারাজ। 

তখন রাজসাহেব ঐরকম একটা  মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতির ওপর রাশ টানতে আসরে নামলেন। তিনি প্রযোজককে বললেন, “চেতিয়ারজি, মান্নাবাবু  লতাজির সাথে গানটা আগে রেকর্ড করুন, রেকর্ড করার পর সেটা আপনি শুনুন, তখন যদি আপনার পছন্দ না হয় তখন ভাবা যাবে। শঙ্করজি বললেন, পছন্দ না হলে তাঁরা এই গান আর কাউকে দিয়ে গাওয়াবেন না। এটা মান্নাদা আর লতাজিকে দিয়ে নন ফিল্ম গান হিসেবে এইচএমভি-তে রেকর্ড করাবেন। এই সিনেমার জন্য গান গীতিকার শৈলেন্দ্রজির অন্য কথা আর অন্য সুরে করে দেবেন। রেকর্ডিং হোল। প্রযোজককে শোনানো হল। স্টুডিও ভর্তি লোকের সামনেই প্রযোজক মান্নাবাবুকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন।

তারপর যা হল সেটা তো ইতিহাস। এই গান দিয়েই ‘চোরি চোরি’ ছবিটি বক্স অফিস হিট। এই গানটির জন্য এখনও এই ছবিটিকে মানুষ মনে  রেখেছেন। আমার তো মনে হয় হিন্দি সিনেমার ১০০ বছরে যদি সিনেমার প্রথম ১০টি  রোমান্টিক ডুয়েট গান বাছাই করার জন্য দশ দশটা আলাদা প্যানেল বানানো হয়, প্রত্যেক প্যানেলই ‘প্যায়ার হুয়া ইক রার হুয়া’, ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ গান দুটোর থেকে অন্তত একটাকে প্রথম ১০ এ রাখবেন। 

মান্নাবাবুকে আমি এত ভালবাসি যে তাঁকে নিয়ে লিখতে বসলে আমি   সহজেই শেষ করতে পারি না।  তাঁর ছবিটি আমার গান শোনার ঘরের দেওয়াল-কার্পেটের ওপর রেখেছি। মান্নাবাবুর প্রতি আমার এত শ্রদ্ধা জানতে পেরে আমার পুরনো পিএইচডি ছাত্র অভিনব এটা স্কেচ করেছিল। আমি ইরানে বেড়াতে গিয়ে এক তাঁতির বাড়ি থেকে সরাসরি দেওয়াল কার্পেটটা কিনেছিলাম।

রঙ্গিনী কতো মন, মন দিতে চায়, যেটা দিয়ে আমার গান শোনার শুরু, তারও একটা সুন্দর পটভূমি আছে, যেটা আমি মান্নাবাবুর আর পুলকবাবুর জীবন চেতনা আর সঙ্গীত ভাবনা নিয়ে একটু পড়াশুনো করে জানতে পেরেছি।  তিনি এত বড় একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, তাঁর গান শুনে কোনও শিক্ষিত মহিলা তাঁর সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব করতে আগ্রহ কি দেখাননি? এই প্রশ্নের মুখে তাঁকে বার বার পড়তে হয়েছে, তাঁর একেবারে কাছের মানুষগুলির থেকেই।  তার উত্তর দেওয়ার জন্য তিনি এই  গানটির সুর এভাবেই করেছেন। পুলকবাবুর প্রশ্নের জবাব পুলকবাবুর কথাতেই দিয়েছেন, তবে তাঁর নিজের সুরে।  তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভালোবাসার আকাশ একজনই আলোয় ভরিয়ে দিয়েছেন, তিনি  সুলোচনা দেবী। তাঁর  জীবনসাথী, তিনি তাঁকে ডাকতেন সুলু। এই গানে সেটা একেবারে স্পষ্ট। যেমন একটা লাইন আছে  ‘সন্দেহে ভরা হোক তোমার দুচোখ, আর কারো চোখে আমি চাই না’।

তাঁর  চরিত্রের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আরেকটি গান মনে এল। ‘ও কেন এত সুন্দরী হোল , অমনি করে ফিরে  তাকালো, দেখে তো আমি  মুগ্ধ হবোই, আমি তো মানুষ’ – সত্তরের দশকের এই গানটিরও একটা অসাধারণ ইতিহাস আছে। একবার মান্নাবাবু সিন্ধ্রিতে এক  অনুষ্ঠান সেরে ধানবাদ হয়ে কলকাতা ফিরছেন। সঙ্গে পুলকবাবু ছিলেন। পুলকবাবু বললেন, “মান্নাদা আমার ভায়রা ভাই এখানের এক কয়লা খনির ম্যানেজার। তাঁর সাথে একটু দেখা না করে কলকাতা ফিরলে বড় অসৌজন্য হবে।”

মান্নাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার যখন আত্মীয় বলছেন, তা হলে সেখানে আমারও নিশ্চয়ই  যাওয়া চলে। পুলকবাবু বললেন , তাহলে তো ওঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবেন। পুলকবাবু গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে একটি বাংলো বাড়ির দরজাতে বেল টিপলেন । মাথায় একরাশ খোলা চুল নিয়ে শাড়িতে সুসজ্জিতা এক আসামান্যা সুন্দরী মহিলা দরজা খুললেন। বললেন, আপনি অন্য বাড়িতে বেল দিয়েছেন, মুখার্জি সাহেবের বাংলো পরের গলির এত নম্বর। পুলকবাবু গাড়ির কাছে ফিরে এলেন, মান্নাবাবু জানতে চাইলেন, বাড়িটা খুঁজে বের করতে পারলেন কি না। পুলকবাবু বললেন, এখনও পাইনি, তবে আপনার এ বছরের পুজোর গান পেয়ে গেছি মান্নাদা। বলেই বললেন, ঐ সুন্দরী মহিলার রুচিশীল সাজের কথা।

ভায়রা ভাইয়ের সাথে দেখা করে কলকাতা ফেরার পথেই ভাবতে ভাবতে মান্নাবাবুকে বললেন গানের লাইনগুলো।  অন্তরাতে  কথাগুলি এইরকম আছে – ‘সবে যখন আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে, ঝড় ওঠেনি বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে। ও কেন তখন, হঠাৎ এমন খোলা চুলে বাইরে এলো, দেখে তো আমি মুগ্ধ হবোই – আমি তো মানুষ’।  এই রকম আপাত উত্যক্তকর কথা,  কিন্তু ১৮ থেকে ৮০, কারোর কাছে এই গানের ভাষা একটুও অরুচিকর মনে হয়নি। সুরে কোন বেলেল্লাপনা নেই। শিল্পীর মনের পবিত্রতা না থাকলে যে এই ভাবে গাওয়া  যায় না, আশা করি তা বোঝা গেল। শুধু সুর , তাল লয় ভাব দিয়ে এত সুন্দর গাওয়া যায় না। আমার ছেলে মেয়ের জন্ম, বড় হওয়া সব লন্ডনে। তারা  গাড়িতে উঠলে বলে, বাবা মান্না দের গান চালাও।

বিভিন্ন আলাপচারিতায় মান্না বাবুকে প্রশ্ন করা হয়েছে, কীভাবে তিনি সুরের উপর এত সুন্দরভাবে কথার ছবি আঁকতে পারতেন তাঁর গানে। উত্তর দিতে গিয়ে সব সময় লক্ষ্য করেছি তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ থেমে গিয়েছেন। তখন তাঁর সঙ্গীতগুরুদের কথা তাঁর মনে এসেছে। তিনি তাঁর পিতৃব্য  সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের  কাছে তালিম শুরু করেছিলেন। এছাড়াও তিনি উস্তাদ দবীর  খাঁ, উস্তাদ আমন আলি খাঁ , উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ আর উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খাঁ-এর কাছে তালিম নিয়েছিলেন।

‘আনন্দ’-এ ‘জিন্দেগি ক্যায়সি হে পাহেলি হায়’- এই গানে যে জীবন দর্শনের কথা গীতিকার বলেছেন, সেটা উপলব্ধি করতে হবে আগে – সেজন্য এই  ছবিতে এই গানটি  সলিলবাবু রাজেশ খান্নার লিপে মান্নাবাবুকে দিয়েই গাইয়েছেন। আর ঐ বেলুন উড়িয়ে সমুদ্র সৈকতে এই গানটি গেয়ে রাজেশজি অভিনয় করছেন। এই দৃশ্যটিই রাজেশ খান্নার অভিনয় জীবনকে অমরত্ব দিয়েছে। বান্দ্রায় এই পোশাকেই বেলুন হাতে রাজেশজির মূর্তি বসেছে।

আবার  কবি  ডঃ হরবন্স রাই বচ্চনের মধুশালাতেও তাই। কেমব্রিজ থেকে ইংরেজিতে  ডক্টরেট করে ফিরেই হিন্দিতে তাঁর এই প্রতীকী  কাব্য তিনি লিখেছিলেন পারস্যের  বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম-এর কালজয়ী কাব্য ‘রুবায়ত’-এর  অনুপ্রেরণায়। ‘রাম নাম সত্য  না কহে না, কহে না সত্য  মধুশালা’,  মধুশালার এই লাইন এ যে গভীর জীবনদর্শন আছে, সেটা তখনকার  সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র মান্নাবাবুই সবচেয়ে ভাল উপলব্ধি করতে পারতেন। সেজন্য  ডঃ  বচ্চন মান্নাবাবুকেই  নির্বাচন করেছিলেন, গানটি গাওয়ার জন্য।

‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’ গানটির একটা সুন্দর ইতিহাস আছে। পুলকবাবু একদিন কলকাতা থেকে রাতের  ফ্লাইটে বোম্বে যাচ্ছেন। জানালার ধারে বসেছেন। জ্যোৎস্না রাত। দেখতে পেলেন চাঁদের ধবধবে আলোয় আকাশ ভেসে গিয়েছে। ওদিকে এক ছিপছিপে চেহারার অপরূপা বিমান সেবিকা তাঁকে জলখাবার দিতে এসেছেন। পুলকবাবুর চোখে চাঁদের আলোর সৌন্দর্য, বিমান সেবিকার মুখের সৌন্দর্য মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। জলখাবারের সাথে দেওয়া টিস্যু পেপারেই বোম্বেতে ল্যান্ড করার আগে লিখে ফেললেন এই গানটি।

শুনেছি শাস্ত্রীয়  সঙ্গীতের এক বিরাট দিকপাল একবার এই গানে চাঁদ কথাটাকে  ১০ বার, ১০ রকমভাবে গেয়ে শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন, এক অনুষ্ঠানে।  মান্নাবাবুর সেই অনুষ্ঠানে পৌঁছতে দেরি হয়েছিল  ফ্লাইট  সময় মত না পৌঁছনোর জন্য। শ্রোতারা বিনম্রভাবেই বললেন তাঁকে, তাঁর নিজের গান গাইতে। তাঁরা ওটা মান্নাবাবু যখন অনুষ্ঠানে আসবেন, তখন তাঁর থেকেই শুনতে চান। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গভীর ব্যুৎপত্তিকে কাজে লাগিয়ে মান্নাবাবু তাঁর আধুনিক গানগুলিকে অমর  অক্ষয় করে দিয়েছেন।

তাঁর সঙ্গীতচর্চা আর চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে তাঁর পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ, সংবেদনশীল মন আর নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন। তবে তাঁর জীবনেও বিরহ, অনুরাগ, সুখ, দুঃখ, আনন্দ সবই ছিল। ‘আমি সাগরের বেলা’য় তিনি বিরহে কাতর, আর ‘সেই তো আবার কাছে এলে’ কথাটা যেভাবে গাইছেন, তাতে মনে হয় তাঁর মিলনেও সুখ নাই। তিনি তাঁর কাছের মানুষকে কাছে পেয়েও সুখী নন। 

পুলকবাবুর আকস্মিক প্রয়াণে তিনি যখন সুপর্ণকান্তিদার সুরে গাইলেন ‘পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছে বন্ধু আমার, সেখানে বন্ধু বিয়োগ-বেদনার বুকফাটা হাহাকার। আহা কী সুর করেছেন সুপর্ণকান্তিদা – মান্নাবাবুর একা হয়ে যাওয়ার যে দুঃখ বেদনা, একবারে পরতে পরতে ধরেছেন তাঁর সুরে। আর ওই ৮২-৮৩ বছরের  মান্নাবাবু কী  অসাধারণ গাইছেন। একেবারে ভালোবাসার মানুষ হঠাৎ চলে গেলে, মানুষ এভাবেই শোক প্রকাশ করেন।

আমি মান্নাবাবুর গান  ভালোবাসি কিন্তু গাইতে পারি না। যখনই চেষ্টা করি, রবিঠাকুরের এই নিচের গানের কথাগুলি মনে আসে:
“তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী,
আমি অবাক হয়ে শুনি”।

বাংলা গানে একজন মান্নাবাবু হওয়ার জন্য একজন পুলকবাবুকেও ঈশ্বর পাঠিয়েছিলেন । আজ ১ মে, মান্নাবাবুর জন্মদিন। আর কাল পুলকবাবুর জন্মদিন। সেই দিক থেকেও এই দুজন একেবারে পাশাপাশি। ঠিক সুর আর কথা, হাত ধরাধরি করে চলেছে। মান্নাবাবুর গান আমি যতবারই শুনি, ততই আমি তাঁর মধ্যে এক পবিত্র, দরদী আর সমব্যথী মনের মানুষের সন্ধান পাই।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img