সংযুক্তা সরকার
অক্ষয় কুমারের ‘প্যাডম্যান’, ঋত্বিক রোশনের ‘সুপার-৩০’র পরে এবার দীপিকা পাডুকোনের ‘ছাপাক’। সামাজিক সমস্যা নিয়ে তৈরি আরও একটি অর্থপূর্ণ ছবি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আবারও সমাজ সচেতনতার নজির গড়লো বলিউড। কিন্তু দর্শকদের সচেতন করতে ঠিক কতটা সফল হচ্ছে এই ধরনের ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ ধারার ছবিগুলি? আদেও কি কোনও প্রভাব পড়ছে ভারতীয় দর্শকের সামাজিক সচেতনতায়? নাকি শুধুই তিন ঘন্টার বিনোদনের মোড়কেই থেকে যাচ্ছে এইসব ছবি?
যে দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কাছে চলচ্চিত্র শুধুমাত্রই বিনোদনের মাধ্যম, রুপোলি পর্দাকে নিদেনপক্ষে শিল্পের মর্যাদা দিতেও যাঁরা নারাজ, তাঁদের কাছে একটা সিনেমা কি
কোনওভাবে সামাজিক সমস্যার বার্তা পৌঁছে দিতে পারছে? আজ যাঁরা ছবি দেখতে হলে ভিড় করেন, শহরে এবং শহরের বাইরে, তাঁদের অধিকাংশের কাছেই সিনেমা নিছকই সস্তা বিনোদনের মাধ্যম বই কিছু নয়। ছবির মাধ্যমে গুরু-গম্ভীর মেসেজ তাঁদের একেবারেই না-পসন্দ।বরং ‘পয়সা উসুল’ ছবি দেখতেই স্বচ্ছন্দ তাঁরা। ‘দাবাং’, ‘ওয়ান্টেড’এর মতো সরল বিনোদনের ছবি তাই এই দেশে ‘ব্লক ব্লাস্টার’। কাজেই আলোচনায়, বিতর্কে বার বার উঠে এলেও সমাজ সচেতনতামূলক ছবি থেকে মূলত মুখ ঘুরিয়েই রেখেছেন ভারতীয় দর্শককুল।
অন্যদিকে, ব্লক ব্লাস্টার না হলেও মানুষের মনের মতো বক্স-অফিসেও রীতিমতো সাড়া ফেলতে পেরেছিলো অমিতাভ অভিনীত অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ছবি, ‘পিঙ্ক’। বাজার মন্দ হয়নি সুপার-৩০-রও। দেশের মাটিতে ব্যবসা ভালো না হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ ভালো ব্যবসা করেছে প্যাডম্যান। তবে দীপিকার মতো তারকা অ্যাসিড আক্রান্ত লক্ষ্মী আগরওয়ালের চরিত্র করার চ্যালেঞ্জ নেওয়া সত্বেও মেঘনা গুলজারের ‘ছাপাক’ কিন্তু সেভাবে আশার আলো দেখাতে পারেনি প্রথম সপ্তাহের শেষে। বরং গত চারদিনে ব্যবসা পড়েছে ৫৫ শতাংশ। তার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক কারণও কাজ করছে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। ইতিমধ্যেই জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের সহমর্মিতা জানিয়ে শাসকদলের রোষের মুখে পড়েছেন ছবির নায়িকা, অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোন।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, অবশ্য সামাজিক এইসব ছবিগুলি কিছুটা হলেও দর্শকদের মনে দাগ কাটে বৈকি। একটা সচেতনতা তৈরি হয়। এটা অস্বীকার করার নয় যে , দৈনন্দিন থোড়-বড়ি-খাড়া থেকে কিছুটা মুক্তি পেতেই এবং মূলত বিনোদনের আশাতেই মূলস্রোতের দর্শক হলে যান।এলাম, দেখলাম, জয় করলাম , এই দর্শনেই বিশ্বাসী তাঁরা।তাই থিয়েটার হলের তিন ঘন্টা কাটানোর পর তাঁরা পেট ফাটানো হাসি, হাড়হিম করা ভয় অথবা ‘হ্যাপিলি এভার আফটার’ সন্তোষ নিয়েই বাড়ি ফিরতে চান। কিন্তু এইসব ছবির পাশাপাশি এমন ছবিও হয় যেখানে পেটে নয়, সুড়সুড়ি লাগে অন্তরাত্মায়। এমন ছবি যা মুহূর্তের জন্য হলেও ভাবতে বাধ্য করে। মেরুদন্ড সোজা হয়। বয়ে যায় ঠাণ্ডা স্রোত। একটা অস্বস্থি কাজ করতে থাকে অনবরত, হল থেকে বেরোনোর পরেও। আর সেখানেই এইসব সামাজিক ছবির জয়। কিছুটা হলেও শুরু হয় আলোচনা, বিতর্ক, মত বিনিময়। ছাপাকদের স্বার্থকতা সেখানেই। বিনোদনের বাইরে গিয়ে ছায়াছবি যেখানে হয়ে ওঠে অন্যতম ‘গণমাধ্যম’।
সুখের কথা হলো, দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর তাগিদেই হোক অথবা ব্যক্তিগত দায় থেকেই হোক, বক্স-অফিসে পারদের ওঠানামা অগ্রাহ্য করেও এমন ‘অস্বস্তিকর’ সামাজিক ছবি বানাচ্ছেন মেঘনা গুলজার, আর. বাল্কি, বিকাশ বহেল, অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীরা। এগিয়ে আসছেন, দীপিকা পাডুকোন, ঋত্বিক রোশান, অক্ষয় কুমারদের মতো অভিনেতারা। সেই প্রাপ্তিটুকুই বা কম কীসের?