(CRIME REPORTER: এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর-এর কলমে।)
হীরক কর : এমন ঘটনা সাধারণত রুপোলি পর্দাতেই দেখা যায়। নিজের দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা খুবই বিপজ্জনক কাজ। কিন্তু নিজের দেশের কূটনৈতিক যদি অন্য দেশের হয়ে গোপনে খবর সংগ্রহ করেন তাঁকে ‘মীরজাফর ছাড়া অন্য কিছুই বলা যায় না। ভারতের স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যেমন মীরজাফরের দায় ছিল, তেমনই নিজের দেশের ‘কনফিডেনশিয়াল’ তথ্য, বিদেশে পাচার করলে ‘মীরজাফর’ তকমা জুটবেই ।এক দেশের বিদেশমন্ত্রকের কর্মী গোপনে পাচার করছেন তাঁর নিজের দেশেরই গোপন তথ্য। কাজ করছেন শত্রু দেশের হয়ে। তাঁকে ‘মীরজাফর’ না বলার কোনো কারণ নেই ।
এই কাহিনী এক ভারতীয় মহিলা ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস বা IFS অফিসারের। বেশি দিন নয়, মাত্র দশ বছরের পুরোনো ঘটনা। 2010-এর এপ্রিল মাস। 22 এপ্রিল। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলকে (যা দুঁদে অফিসারদের নিয়ে গঠিত। জঙ্গিদের নিয়ে কাজ-কারবার) নর্থ ব্লক থেকে এক বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎই বলা হয়েছিল, আপনারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছন। এক জন মহিলা আসছেন। তাঁকে গ্রেফতার করতে হবে।
স্পেশাল সেলের টিম ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছয়। এয়ারপোর্ট থেকে লেডিজ স্যুট পরা তিপান্ন বছরের এক মহিলা বেরিয়ে আসেন। ওঁনার কাছে ডিপ্লোম্যাটিক পাশপোর্ট ছিল। ডিপ্লোমেটিক পাশপোর্ট তাঁদের কাছে থাকে, যাঁরা ভারত সরকারের উঁচু পদে কাজ করে থাকেন। এই মহিলার বিশেষত্ব এটাই ছিল যে, পাকিস্তানে ভারতীয় হাইকমিশনে তিনি কর্মরত ছিলেন। তাঁর পদ ছিল সেকেন্ড সেক্রেটারির। পাকিস্তানের মত দেশে সব সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে। ভারতের চির শত্রু বলে পৃথিবী জুড়ে পরিচিত। এখানকার হাইকমিশনে গুপ্তচর সংস্থাগুলোর সবসময় কড়া নজর থাকে।
পাকিস্তানে ভারতীয় হাইকমিশনে যখন পোস্টিং হয়, তখন পাকিস্তান ছাড়াও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কড়া নজর রাখে। কোনো কিছু ‘লিক’ হচ্ছে না তো? তেমনই ভারতেও পাকিস্তানের হাইকমিশনে দুই দেশই কড়া নজর রাখে। নজর রাখে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকও। ‘র’ও নজর রাখে, শত্রুরা তাদের জালে আমাদের কোনও কর্মীকে ফাঁসিয়ে দেয় নি তো !
ইসলামাবাদের ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত এক মহিলা ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে 22 এপ্রিল বাইরে আসেন। আর বাইরে আসতেই অবাক হয়ে যান। আচমকা সাদা উর্দিতে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের সদস্যরা তাঁকে ঘিরে ফেলেন। জোর করে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। সেই সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত লোকজন ভেবেছিলেন কোনও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে বুঝি। তাঁকে লোধি কলোনিতে স্পেশাল সেলের দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও ওই মহিলার জানা ছিল না, তাঁর সঙ্গে কি হতে চলেছে। উনি বলতে থাকেন, আমি একজন IFS অফিসার, বিদেশ মন্ত্রকে কাজ করি, ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত। কিন্তু গাড়িতে কোনও জবাব দেওয়া হয়নি। স্পেশাল সেলের দফতরের সটান নিয়ে আসা হয় । এরপর প্রথম তাঁকে বলা হয়, লোধি কলোনিতে কেন আনা হয়েছে।
তাঁর ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। সাতটি পেপার পাওয়া যায়। এমন নথি তাঁর কাছে ছিল, যা পদের গুরুত্বের নিরিখে থাকার কথা নয়। সেগুলো ভারত সরকারের গোপন ডকুমেন্ট। ইসলামাবাদে তাঁর যা কাজ ছিল, সেই হিসেবে ওইসব ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে ট্রাভেল করার কথাও নয়। এই মহিলার নাম, মাধুরী গুপ্তা। স্পেশাল সেলের দফতরে ওকে বলা হয়, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাকিস্তানের হয়ে আপনি গুপ্তচরবৃত্তি করছেন। স্পেশাল সেল তাঁকে লম্বা জিজ্ঞাসাবাদ করে। আদালতে পেশ করা হয়। স্পেশাল সেল তাদের হেফাজতে নেয়। এরপর পুরো জিজ্ঞাসাবাদের শেষে এক কাহিনী সামনে আসে ।
মাধুরী গুপ্তা দিল্লির বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা মা সাউথ দিল্লিতে থাকতেন। ভাই আমেরিকায় কর্মরত । ছোট বেলা থেকেই মাধুরী পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। গুপ্তচর হবার শখ ছিল। কিন্তু গুপ্তচর হওয়া হয়নি । বিদেশ মন্ত্রকে চাকরি পান। প্রথমে দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকেই ছিলেন। এরপরয বাগদাদ, কুয়ালালামপুর সহ বিভিন্ন দেশে ভারতীয় হাইকমিশনে কাজ করেন। 2007 সালে বিদেশ মন্ত্রক থেকে তাঁকে বলা হয়, আপনাকে পাকিস্তানে যেতে হবে। পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারির পদে প্রেস ও ইনফর্মেশন বিভাগের ভার প্রাপ্ত করে তাঁকে পাঠানো হয়। এর একটা কারণ ছিল। মাধুরীর উর্দু লেখা ও বলা ছিল ভীষণ রকম ভালো। উনি গৃহশিক্ষক রেখে উর্দু শেখেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সির কোর্স করেন ।
পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসে মাধুরী গুপ্তার কাজ ছিল সেখানকার সমস্ত উর্দু কাগজ অনুবাদ করে দিল্লিতে পাঠানো। উর্দু ভালো জানতেন বলেই তাঁকে এই কাজ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রেস ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ভারতের বক্তব্য তুলে ধরা।
জীবনের শুরু থেকেই মাধুরী চাইছিলেন তিনি গুপ্তচর হবেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয় নি । ইসলামাবাদে উর্দু কাগজ অনুবাদ করে কাজ শুরু করলেও প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের কাছাকাছি চলে আসেন তিনি । মাধুরীর দামি পারফিউম, ভালো জামা কাপড়, স্টাইল ড্রেসিং ভালো লাগত। এই শখের জন্য পাকিস্তানি মিডিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থার নজরে আসেন মাধুরী। হামেশাই যে কোনো দূতাবাসে ঢুকে খবর সংগ্রহের জন্য এই ধরনের কমজোরি মানুষকে খুঁজতে থাকে গুপ্তচর সংস্থা গুলো।
এই ভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, শপিং করা পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের কাছে পৌছয়। তাঁরা বোঝেন ভারতীয় হাইকমিশনে ঢোকার পথ হতে পারেন মাধুরী গুপ্তা। এই সময় পাকিস্তানের অথরিটি ভারতীয় দূতাবাসে ঢোকার জন্য মাধুরী গুপ্তাকে নিশানা করে। পাশাপাশি, আইএসআইয়ের এজেন্ট মুবসার রাজা রানা ও জামশেদকে সাংবাদিক বানানো হয়। তাদের প্রেস কার্ড তৈরি হয়। ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসের প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় তাঁরা প্রায় রোজই আসতে থাকে। এই প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় জাভেদ রশিদ নামে জনৈক পাকিস্তানি সাংবাদিকের মাধ্যমে মাধুরীর পরিচয় হয় মুবাসির রাজা রানা, জামশেদের সঙ্গে। মাধুরী যেহেতু হাইকমিশনের পাশেই থাকতেন তাই রানা ও মাধুরীর মেলা মেশা শুরু হতে অসুবিধা হয় না । রানার বয়স তখন পঞ্চান্ন। মাধুরী তিপান্ন। আর ওর অবসরের মাত্র পাঁচ-ছ’বছর বাকি ছিল। ধীরে দুজনের বন্ধুত্ব শুরু হয়। রানা নিজের জালে মাধুরীকে জড়িয়ে নেয়। মাধুরীর পিছনে পয়সা ওড়াতে থাকে। দুজনের মধ্যে প্রেম শুরু হয়ে যায়। এমনকি শরীরী সম্পর্ক হয় বলেও শোনা যায়।
মাধুরী বাড়িতে রানার আসা-যাওয়া শুরু হয়। রানা মাধুরীকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকেন। এই সময় রানা বুঝে যায়, মাধুরী পয়সার জন্য সব কিছু করতে পারে। দুজনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার ছবি গোপনে রানা তুলে রাখে। শুরুতে সাংবাদিক হিসেবে রানা ছোট খাটো খবর মাধুরীর কাছ থেকে নিত। ধীরে ধীরে মাধুরীকে ফাঁসিয়ে রানা আসল রূপ ধারণ করে। হাইকমিশনের ভিতরের খবর দিতে বলে। বলে, যত পয়সা লাগবে তোমাকে দেব। কিন্তু মাধুরীর মনে হয়, এটা দেশের সঙ্গে বেইমানি হবে। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই পা বাড়িয়ে ফেলেছিলেন। পয়সার লোভও ছিল। এই সময় রানা ব্ল্যাকমেল করে বলে, দুজনের আপত্তিকর ছবি আম জনতার সামনে প্রকাশ করে দেব।
মাধুরীর এই ফাঁস ছাড়িয়ে বের হবার আর উপায় ছিল না। যে ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট মাধুরীর দেওয়ার কথা নয়, তা রানাকে দেওয়া শুরু করে দেন। সব খবর ভারতীয় দূতাবাস থেকে সংগ্রহ করে মাধুরী নিজের বাড়িতে যান। নিজের ঘরের কম্পিউটার থেকে এবং আলাদা মেল আই ডি থেকে পাকিস্তানি সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট রানাকে খবর পাঠাতে থাকেন। বদলে মাধুরীর প্রচুর পয়সা মিলতে থাকে । এবং সব টাকা পাকিস্তানের ব্যাঙ্কে মাধুরীর আকাউন্টে জমা হতে থাকে। আইএসআইকে তাঁর দিল্লির ব্যাঙ্ক আকাউন্টের নম্বরও দেওয়া ছিল। এরই মধ্যে দিল্লি থেকে ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে একটি খবর পাঠানো হয়েছিল। সেই খবর ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে না গিয়ে পাকিস্তান সরকারের কাছে আগেই পৌঁছে যায়। দিল্লিতে এই নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। কেননা এই খবর দু-চার জনই জানতেন । এতে বিদেশ মন্ত্রকের সন্দেহ হয়। ‘র” আর বিদেশ মন্ত্রক ঠিক করে, ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের ওপর নজর রাখা হবে।
২০০৮ সাল থেকে ভারতের গোয়ন্দা সংস্থাগুলো মাধুরীকে সন্দেহ করতে শুরু করে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ সহজ ছিল না। এক গোপন তদন্ত মারফত সংগ্রহ হয় প্রয়োজনীয় তথ্য। পাকিস্তানে কেউই এই তদন্ত সম্পর্কে জানতে পারেনি। ভারতেও খুব কম লোক এই তদন্তের কথা জানত। দূতাবাসের সব কর্মীর ওপর নজরদারি করে দেখা যায়, তাঁরা কাজের শেষে দূতাবাসের চত্বরে নিজের কোয়ার্টারে বা বাড়িতে চলে যান। বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কাটানো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা, সবেতেই নজরদারি চালানো হয়। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে সব কিছু ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মাধুরী গুপ্তার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে অনেক ঘটনাই সামনে আসে। জানা যায়, কেউ একজন মাধুরীর ঘরে ঘন ঘন যাতায়াত করছে। সে ছিল রানা। রানা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ তো পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থার লোক। ফের মাধুরীর দিল্লির ব্যাঙ্ক আকাউন্টের ডিটেল খুঁজে দেখা যায়, প্রচুর হিসেব বর্হিভূত টাকা আছে। সেগুলো কোথা থেকে এসেছে জানা নেই। সন্দেহ বাড়তে থাকে। খবর ‘লিক’ কনফার্ম করার জন্য বিদেশ মন্ত্রক একটা মিথ্যা খবর পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসে দেয়। জেনে বুঝে কর্মীদের সামনে ওই মিথ্যা খবর ফাঁস করা হয়, যাতে পাকিস্তানের সিক্রেট সার্ভিসের কাছে ওই খবর পৌঁছে যায়। এই খবর মাধুরী জানতে পেরে রানাকে লিক করে দেন। কয়েক দিন পর জানা যায় এই মিথ্যা খবর পাকিস্তান সরকারের কাছে পৌঁছে গেছে। তখনই বোঝা যায় এর মধ্যে মাধুরী জড়িত।
এই সময় ‘র’ ঠিক করে মাধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল, ভারতীয় হাইকমিশনে যদি জানাজানি হয়ে যায়, মাধুরী পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছেন তাহলে ঝামেলা লেগে যাবে। পাকিস্তান থেকে তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। আইএসআই তাঁকে শেল্টার দেবে। তাই তাঁকে যে করেই হোক ভারতে আনতে হবে। এমন ভাবে আনতে হবে যাতে কারো সন্দেহ না হয়। কেননা কিছু দিন আগেই ছুটিতে দিল্লির বাড়িতে এসেছিলেন মাধুরী। সবে ইসলামাবাদে ফিরেছেন । তাঁর জমা ছুটিও ছিল না। সেই সময় কুয়ালালামপুরে একটি সার্ক সম্মেলন ছিল। সেখানে পাকিস্তানও অংশ নেবে। মাধুরীকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হল।
তাঁকে জানানো হয়েছিল, সার্ক সম্মেলনের ব্যবস্থাপনার কাজে তাঁকে ডেকে আনা হচ্ছে। বলা হল, পাকিস্তানের মিডিয়ার জন্য প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হবে। তুমি যেহেতু ভালো উর্দু জানো। উর্দু অনুবাদ করো। তাই ওই প্রেজেন্টেশন তৈরিতে সাহায্য করতে পারো। সার্ক সম্মেলনের আগে দু দিনের জন্য দিল্লি চলে এসো। বিদেশ মন্ত্রকে দেখা করো। কাজ হয়ে গেলে ফের ইসলামাবাদে ফিরে যাবে।
২০১০ সালের 22 অক্টোবর মাধুরী দিল্লিতে অবতরণ করেন। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলকে সবটাই বুঝিয়ে বলে রাখা হয়েছিল। বিমান থেকে নামতেই দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের কব্জায় চলে আসেন মাধুরী। মাধুরীকে অতি গোপনীয় তথ্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়া, মুবসার রাজা রানা ও জামশেদ নামে দুই আইএসআই চরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল।
এরপর শুরু হয় ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েন মাধুরী। এই পুরো জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে মাধুরী যা বলেন, তা অবাক করার মত। বলেন, “আমি গুপ্তচরবৃত্তি করেছি। তারজন্য আমার কোনো আফসোস নেই। আমি এই গুপ্তচরবৃত্তি আমার সিনিয়র অফিসারদের শিক্ষা দেবার জন্য করতাম। ওরা কাজ করেন না। কাজ জানেন না। আর আমরা যারা পরিশ্রম করি, তা দিল্লিতে সরকারের কাছে দেখিয়ে ওরা প্রমোশন পান। আর আমাদের পরিশ্রম বিফলে যায় । ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে থাকার সময় আমি ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে চেয়েছি। কিন্তু আমার সিনিয়র অফিসাররা তাতে উৎসাহ দেখাননি। বলেন, তোমার যা কাজ তুমি স্রেফ সেটাই করো। মানছি আমি ভারত সরকারের খবর পাচার করে টাকা নিয়েছি। আসলে আমার সিনিয়র অফিসারদের প্রতি বদলা নেবার ছিল। কারণ ওরা আমাকে ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে দিচ্ছিলেন না। আরও ভালো জায়গায় আমার পোস্টিং দরকার ছিল, যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ডে। কিন্তু কিছুতেই ওই পোস্টিং আমাকে দেওয়া হচ্ছিল না।
এর ঠিক আগেই 26/11 হয়েছিল। ভারত সরকার পাকিস্তানের কাছে একের পর এক জবাব চাইছিল । আন্তর্জাতিক স্তরে এই ইস্যু উঠছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যা পরিকল্পনা হত, তা পাকিস্তান আশ্চর্যজনকভাবে জেনে যেত। 26/11 এবং কাসভ সংক্রান্ত খবর মাধুরী গুপ্তা রানাকে দিয়েছিলেন। এতে ভারতের যথেষ্ট ক্ষতি হয় ।
মাধুরীর বেশ কিছু ই-মেল তদন্তকারীদের হাতে আসে, যা থেকে ইঙ্গিত, রানার সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়েছিল। মাধুরীকে জেরা করে বেরিয়ে আসে, রানা তাঁকে জানান, জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২০ পর্যন্ত ৩১০টি হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্টের প্রস্তাব রয়েছে। এ ব্যাপারে মাধুরীকে খোঁজ নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। মাধুরী এজন্য ছুটি কাটানোর নামে জম্মু ও কাশ্মীর ঘুরে যান। বিদেশ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রক, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় হাইকমিশনে কোন কোন অফিসারকে কোথায় নিয়োগ করা হচ্ছে, সে ব্যাপারেও তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের নানা তথ্যও মাধুরী পাচার করেছেন, যাতে ওদের জীবন বিপন্ন হতে পারত। সন্ত্রাসবাদ, কাশ্মীর, ভারতের আফগানিস্তান সংক্রান্ত নানা কৌশলগত তথ্যও মাধুরী পাচার করেছেন। কখনও মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে, কখনও ই মেলে, ব্ল্যাকবেরি ফোনের মাধ্যমে মাধুরী তথ্য পাচার করতেন। এজন্য আইএসআই তাঁকে একটি বিশেষ ইমেল আইডি তৈরি করে দিয়েছিল। ওরাও বিশেষ আইডি মারফতই মাধুরীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করত।
পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইকে ভারত সম্পর্কে নানা গোপন, গুরুত্বপূর্ণ নথি পাচার ও জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে এক সময় কাজ করা প্রাক্তন কূটনীতিক মাধুরী গুপ্তাকে। 2018-র ১৯ মে দিল্লি কোর্টের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক সিদ্ধার্থ শর্মা চরবৃত্তি, আইনে সুরক্ষিত গোপন তথ্য, খবর অন্যায়ভাবে পাচারের দায়ে সরকারি গোপনীয়তা রক্ষা আইনের নানা ধারায় তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন। তিন বছরের সাজা ঘোষণা করা হয়। দিল্লি হাইকোর্ট তা বজায় রাখে।
তাঁকে সরকারি গোপনীয়তা রক্ষা আইনের ৩ ও ৫ ধারায় চরবৃত্তির জন্য দোষী ঘোষণা করা হয়। বিস্তারিত বিচারপর্বের পরে তথ্য পাচার, গুপ্তচরবৃত্তি ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আপাতত তিন বছরের কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত ৬১ বছরের মাধুরী গুপ্তা ।