(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী । বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)
হীরক কর : সুশান্ত সিং রাজপুতের রহস্যজনক মৃত্যুর মতো বলিউডে এর আগেও একাধিক রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। আমার হিসেব মত দশ-বারোটা তো হবেই। এর মধ্যে একজন পরভিন ববি। ছোটবেলায় তাঁর ছবি আমরা অনেকেই দেখেছি। বিশেষ করে অমিতাভ বচ্চনের ফ্যান হবার জন্য। অমিতাভ বচ্চনের নায়িকা হিসেবে বহু ছবিতেই পরভিন ববি থাকতেন।
সেই পরভিন ববির মৃত্যু এখনও রহস্যই রয়ে গেল। কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও অজানা। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, এত বড় অভিনেত্রী, কেউ কেউ এদেশের লেডি সুপারস্টার বলে থাকেন। অনেকেই তাঁকে হলিউডের মেরেলিন মনরোর সঙ্গে তুলনা করতেন। হিন্দি ফিল্মে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে যে গ্ল্যামার আনা হয়েছিল, তা পরভিন ববিরই দান। একের পর এক সুপারহিট ফিল্ম দিয়ে গেছেন। আট আটটা সিনেমা তিনি অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে করেছিলেন। যার মধ্যে “কালা পাত্থর”, “অমর-আকবর-অ্যান্টনি”, “সুহাগ”, “নমক হালাল”, “কালিয়া” উল্লেখযোগ্য। “ক্রান্তি” এবং “বার্নিং ট্রেন”-এর মত ফিল্ম করেছিলেন তিনি।
এমনকি ওঁর জীবনের উপর দুটো ছবিও তৈরি হয়েছিল। একটি খোদ মহেশ ভাট বানিয়েছিলেন “অর্থ”। বলা হয়, মহেশ ভাট এবং পরভিন ববির গভীর সম্পর্ক নিয়েই তৈরি হয়েছিল এই ফিল্মটি। দ্বিতীয়টি “ও লহমে”। যেটা নাকি পরভিন ববির জীবনের ওপর নির্মিত।
সুপারহিট অভিনেত্রী হিসেবে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন ববি, ততটাই আকর্ষণীয় ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। আড়ম্বরে পরিপূর্ণ তাঁর জীবনে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে, যা অনেকেরই অজানা। একাধিক সম্পর্কেও নাম জড়িয়েছিল পরভিন ববির। সাহসী অভিনেত্রী হিসেবে বি-টাউনে তাঁর খ্যাতি ছিল। এমন এক অভিনেত্রীকে এক সময় মানুষ পাগল বলা শুরু করেন। দুঃখজনক ঘটনা হলো, অত্যধিক সুরাসক্তি, সম্পর্কে ভাঙন তাঁকে ব্যক্তিগত জীবনে সুখী হতে দেয়নি।
এক সময় পুরুষ হৃদয়ে হিল্লোল তোলা পরভিনের মৃত্যুদিন যে কবে, তা জানে না কেউ। ফ্ল্যাটের দরজার সামনে খবরের কাগজ আর দুধের প্যাকেট জমছিল দিনের পর দিন। দুদিন ধরে কেউ জানতেন না পারভিন ববির মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেশীরাই পুলিশে খবর দেন। ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙা হয়। উদ্ধার করা হয় মৃত পরভিনকে।
পারভিন ববির জন্ম গুজরাতের জুনাগড়ে, ১৯৪৯-এ। ওঁর পুরো নাম ছিল পারভিন ববি অলি মহম্মদ খান। আহমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। শুরু থেকেই ফ্যাশনের দিকে উৎসাহ ছিল। তৎকালীন বোম্বের একজন পরিচালক প্রযোজক বি আর ইশারা তাঁকে প্রথম আহমেদাবাদ ইউনিভার্সিটিতে দেখেন। ওই দিন তিনি স্কার্ট এবং টপ পড়েছিলেন। বি আর ইশারা ওই সময় একটা নতুন ছবি তৈরি করতে যাচ্ছিলেন, যেখানে ওয়েস্টার্ন লুকের একটা মেয়ের দরকার ছিল। দূর থেকে পারভিন ববির স্টাইল, চলাফেরা, আচার আচরণ, দেখে বি আর ইশারার ভালো লাগে। তৎক্ষণাৎ আমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়েই পরভিন ববিকে তিনি অভিনয় করার অফার দেন।
১৯৭৩-এ মুম্বাইয়ের ফিল্ম জগতে পরভিন ববির এন্ট্রি হয়। প্রথম ছবির হিরো ছিলেন ক্রিকেটার সেলিম দুরানি। সেই ছবি বেশিদিন চলেনি। কিন্তু মুম্বাইয়ের ফিল্ম স্টুডিওতে পারভিন ববির পা শক্ত করতে ওই ছবি সাহায্য করে। এরপর তার দ্বিতীয় ফিল্ম আছে “ধোঁয়া”। ড্যানি ছিলেন হিরো। এখান থেকেই পারভিন ববির সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। ড্যানির সঙ্গে তাঁর অ্যাফেয়ার শুরু হয়। ড্যানি এবং পারভিন ববি খুব কাছাকাছি চলে আসেন। ড্যানির সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের খুব গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ১৯৭৪ -এ অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে প্রথম ছবি করেন পরভিন। নাম “মজবুর”। ছবিটি বক্স অফিসে সুপার ডুপার হিট হয়। এরপর পরভিনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরেরর বছর, ১৯৭৫-এ, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে নতুন ছবি আসে “দিওয়ার”। যা অমিতাভ বচ্চনের অল টাইম ব্লকবাস্টার ফিল্মের মধ্যে একটি।
দিওয়ারের হিরোইন ছিলেন পারভিন ববি। ১৯৭৭-এ আসে মনমোহন দেশাইয়ের ফিল্ম “অমর-আকবর-অ্যান্টনি”, যার নায়ক নায়িকা ছিলেন অমিতাভ বচ্চন এবং পরভিন ববি। দেখতে দেখতে পারভিন ববি মহিলাদের মধ্যে সুপারস্টার হয়ে যান। তিনি তখন শুটিংয়ের জন্য অনেক পরিচালক-প্রযোজককে ডেট পর্যন্ত দিতে পারছিলেন না।
এই সময় পারভিন ববির সঙ্গে ড্যানির সম্পর্ক ভেঙে যায়। এটা পরভিনের জীবনে প্রথম ঝটকা ছিল। এর আগে পারভিন ববি যখন গুজরাতে ছিলেন, তখন আহমেদাবাদের স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন। সেই সময় ১৯৬০ সালে আহমেদাবাদে দাঙ্গা হয়। দাঙ্গা যখন বাঁধে তখন তিনি স্কুলে ছিলেন। ওই খ্রিস্টান স্কুলের সন্ন্যাসিনী শিক্ষিকা কোনওরকমে বাচ্চাদের একটা ট্রাকে তোলেন। পড়ুয়াদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন। ওই ঘটনা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। তাঁর সব সময় মনে হতো তিনি মরে যাবেন। কেউ তাঁকে মারতে আসছে। কেউ আমাকে মারতে চায়, কেউ আমাকে মেরে দেবে, এই আতঙ্ক তার মন থেকে কখনই যায়নি। এই আতঙ্কেই ড্যানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভেঙে যায়। এরপরে তাঁর জীবনে দ্বিতীয় ব্যক্তি আসেন কবীর বেদি। কবীর বেদির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু একসময় সেই সম্পর্কও ভেঙে যায়। পরভিন আবার হতাশার গভীরে ঢুকে যান। ওই সময় থেকেই সুরা আসক্তি এবং সিগারেট তাঁর প্রিয় হয়ে ওঠে।
এই সময় তাঁর জীবনে আসেন মহেশ ভাট। ব্রেকআপ যন্ত্রণায় মলম লাগাতে সেইসময় পরভিনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মহেশ ভাট। তারপর থেকেই লিভ-ইন করতে শুরু করেছিলেন। এবং মহেশের প্রেমে রীতিমতো পাগল হয়ে গেছিলেন পারভিন। মহেশ ভাটের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্ক চলতে থাকে। মহেশ ভাট নিজের স্ত্রী কিরণকে ছেড়ে পারভিনের সঙ্গে লিভ-ইন রিলেশনে চলে যান। মহেশের কাছ থেকে জানা যায়, পারভিন ববির একটা সমস্যা হচ্ছে যে, তিনি সব সময় মনে করতেন, তাঁকে কেউ না কেউ মেরে ফেলবে।
সালটা ১৯৭৯। একদিন মহেশ বাড়ি ফিরে দেখেন, পরভিন ঘরের এক কোণে ছুরি হাতে বসে আছেন। মহেশকে দেখে তাঁকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলেন। ঘরে কেউ আছে, তারা নাকি ববিকে হত্যার চেষ্টা করছে। এই প্রথম ববির এহেন আচরণ দেখে অবাক হয়েছিলেন মহেশ। এরপর একাধিকবার তাঁকে এই রকম আচরণ করতে দেখা গেছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানা যায়, ‘সিজোফ্রেনিয়া’ নামক মানসিক রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। সবসময় মনে মনে ভাবছেন, কেউ তাঁকে মেরে ফেলতে চায়। এমনকি সবসময়েই কিছু না কিছু নিয়ে তিনি ভেবেই যেতেন। পরভিনের অবস্থা ধীরে ধীরে এতটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল যে, একসময়ে তাঁকে ঘরে আটকে পর্যন্ত রাখা হয়েছিল।
সেই সময় তিনি তাঁর ফিল্মি ক্যারিয়ারের তুঙ্গে । প্রচুর ছবি ফ্লোরে। প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে পরভিন ববির ছবি ছাপা হয় টাইম ম্যাগাজিনের কভার পেজে। তাঁর ‘সিজোফ্রেনিয়া’ রোগ সম্পর্কে জানাজানি হওয়ার পর পরিচালক এবং প্রযোজকদের মাথায় হাত পড়ে যায়। কিন্তু মোটামুটি ফ্লোরে থাকা সব ফিল্মই শেষ করেন তিনি। মহেশ ভাটও তার চিকিৎসা করাতে থাকেন।
১৯৮৩-তে একদিন হঠাৎ পরভিন ববি আমেরিকা পৌঁছে যান। নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর যখন তাঁর তল্লাশি নিতে চাওয়া হয়, তখন তিনি তা করতে নিষেধ করেন। নিরাপত্তারক্ষীদের দেখে চিৎকার করতে থাকেন, বলেন, এরা আমাকে মারতে আসছে, এরা আমাকে মারতে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষে আমেরিকার এক বন্ধু তাঁর চিকিৎসা করাতে থাকেন।
কিন্তু তিনি বলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে গায়েব হয়ে যান। যখন ফিরে আসেন, তখন তাঁর শরীরের ওজন অনেক বেড়ে যায়। তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছিল। শরীরে দানা বেঁধেছিল ডায়াবেটিস রোগ। পায়ে হয়েছিল গ্যাংগ্রিন। ফলে কিডনি লিভারেও প্রভাব পড়তে থাকে। তাঁর ওজন বেশি মাত্রায় বেড়ে যায়। মুম্বই এয়ারপোর্টে নামলে তাঁকে যাতে মানুষ চিনতে পারে, সেই জন্য তিনি পরভিন ববি লিখে একটা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এক সময় অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় । কিন্তু অমিতাভ পরে দূরত্ব তৈরি করেন। পরভিন আমেরিকা থেকে ফিরে এসে অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ করেন। বলেন, “অমিতাভ বচ্চন আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিলেন। অমিতাভের সঙ্গে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কানেকশন আছে । সে আমাকে কিডন্যাপ করে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে গেছিল।”
তিনি জানিয়েছিলেন, মাথার ওপর ঝাড়বাতি ফেলে তাঁকে খুন করতে চাইছেন অমিতাভ বচ্চন। যদিও এই অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও আরও দুজনের বিরুদ্ধে একইভাবে অভিযোগ এনেছিলেন অভিনেত্রী। প্রেমে তিন তিনবার আঘাত খাওয়ার পর পরভিনের মাথা কাজ করছিল না। এটা শুধুমাত্র অভিযোগের পর্যায়েই থেমে থাকেনি। পরভিন অমিতাভের বিরুদ্ধে মুম্বই পুলিশের কাছে এফআইআর পর্যন্ত করেছিলেন। মামলা কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। পরভিন মানসিক রোগী হওয়ায় অমিতাভ বচ্চনকে ক্লিনচিট দেয় আদালত ।
এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই অমিতাভ বচ্চনকে কোনও সমস্যার মুখেই পড়তে হয়নি। তবে সমস্যা পড়েন পরভিন। তাঁর মানসিক অবস্থার কথা জানতে পেরে একে একে সকলেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বন্ধ করে দিতে শুরু করেন।
মহেশ একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, পারভিনের উপর রেগে গিয়েই একবার বেডরুম থেকে সোজা বেরিয়ে এসেছিলেন। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে পারভিন মুখ থেকে একটি কথা শুনেই হতবাক হয়ে গেছিলেন মহেশ। তারপর তার কথার কোনও উত্তর না দিয়েই শোবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান মহেশ।
মহেশের মতে, তিনি লিফটের জন্য অপেক্ষা করেননি। বরং সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেন। সেই সময় সিড়ি দিয়ে দৌড়ে নামার শব্দও শোনেন। ঠিক তখনই পুরো নগ্ন অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে এসেছিলেন পরভিন। পরে কোনও রকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেন মহেশ। এই ঘটনার কয়েক মাস পরেই তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল।
মহেশ ভাটও পরভিনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। কেননা, চিকিৎসকরা তাঁকে বলেছিলেন, আপনি যদি পরভিনকে সুস্থ দেখতে চান, তাহলে ওঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করুন। আপনি কাছাকাছি থাকলে ওর পুরনো স্মৃতি তাজা থাকবে। বারবার ১৯৬০-এ আমেদাবাদের দাঙ্গার কথা মনে পড়বে। তাই মহেশ ভাট নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরে যান। আর পারভিন ববির জীবন আটকে যায় মুম্বাইয়ের জুহু এলাকার চার কামরার ফ্ল্যাটে ।
পরভিন ওই ফ্ল্যাটে কুড়ি বছর ধরে বসবাস করছিলেন। তাঁর এক প্রতিবেশী ছিলেন, যার নাম এম এস মালহোত্রা। তাঁর কথায়, কুড়ি বছরে তিনি স্রেফ ১৫ বার দেখেছেন পারভিনকে। কেননা, শেষের দিকে পরভিন ফ্ল্যাট থেকে বের হতেন না। পায়ে যেহেতু গ্যাংগ্রিন ছিল, তাই হুইলচেয়ারে করেই ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। ধীরে ধীরে তিনি বলিউডের স্টুডিওপাড়া থেকে হারিয়ে যান। আমার আপনার আশেপাশের পৃথিবী থেকেও তার দূরত্ব তৈরি হয়। তাঁর কথা আর কারোরই মনে থাকে না।
২০০৫-এর ২২ জানুয়ারি। ঐদিন সকালে এক প্রতিবেশী দেখেন, পরভিনের ফ্ল্যাটের বাইরে দু’দিনের খবরের কাগজ পড়ে আছে। পড়ে আছে দু’দিনের দুধের প্যাকেট। সেগুলো কেউ তুলে রাখেনি। তখন প্রতিবেশীরা ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজান। দরজায় নক করা হয়। কেউ কোন সাড়াশব্দ দেয় না। প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দেন। ফোন পেয়ে জুহু পুলিশ ছুটে আসে। ফ্ল্যাটবাড়ির সোসাইটির নিরাপত্তা রক্ষীর কাছ থেকে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি নেওয়া হয়। পুলিশ চাবি দিয়ে ফ্ল্যাট খোলে। পরভিন ববির মাস্টার বেড রুমে গিয়ে দেখে, একটা হুইলচেয়ার শোবার ঘরের খাটের পাশে পড়ে রয়েছে। পাশের টেবিলে কিছু ওষুধ রাখা আছে। দু জোড়া কাপড় রাখা আছে। কিছু পেন্টিং ছিল। আর পরভিন ববির দেহ পড়েছিল খাটের ওপর। আর ওঁর মৃত্যু আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই হয়ে গেছে। বাইশে জানুয়ারির প্রায় আড়াই দিন আগে। ঘরে এবং ফ্ল্যাটে কেউই ছিলেন না। পুলিশ বিস্তারিত তদন্ত শুরু করে। মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয় । জানা যায়, মৃত্যু হয়েছে রোগভোগের কারণেই।
মহেশ ভাট যখন পারভিন ববির সঙ্গে থাকতেন, তখন মহেশ ভাটকেও সন্দেহ করতেন তিনি।
সিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ তাকে দিলে, তিনি বলতেন আগে তুমি খাও, তারপর আমি খাবো। মহেশ ভাট অনেক সময় ড্রিঙ্কসের মধ্যে ওষুধ মিশিয়ে তাকে খাওয়াতেন। সিজোফ্রেনিয়া রোগ তাঁর স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিয়েছিল। কখন লাঞ্চ করতে হবে, কখন ডিনার করতে হবে, কখন ওষুধ খেতে হবে, কিছুই তার মনে থাকত না। যখন মনে পড়তো তখনই তিনি ওষুধ খেতেন ।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে কিছুই মেলে না। রোগ ভোগের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে বলা হয়। গ্যাংগ্রিনের জন্য লিভার ও কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি তার মৃত্যুর কারণ বলে মনে করে পুলিশ।
পরভিন ববির মৃত্যুর পর বহু লোকের নাম উঠে আসে। আগেও বলিউডে এ ধরনের রহস্য মৃত্যু হয়েছে বলে মুম্বই পুলিশ সন্দেহের অবকাশ রাখে নি। তারা বিস্তারিত তদন্ত করে। কিন্তু কোন “ফাউল প্লে” মেলেনি। মেডিকেল হিস্ট্রি এত জোরদার ছিল যে, খুনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহই ওঠেনি। পুলিশ দেখে মৃত্যুর আগে চার দিনের মধ্যে ওই ফ্ল্যাটে কে এসেছে আর কে গেছে ? যে পরিচারিকা ছিলেন তিনি দুদিন ধরে এলেন না কেন ? পারভিন ববির মানসিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, কোনো পরিচারিকা সেখানে বেশি দিন কাজ করতে পারতেন না। শেষে যে পরিচারিকা কাজ করছিলেন, তাকেও পরভিন তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও তার দূরত্ব বেড়ে গেছিলো।
শেষ সময় তিনি খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে ছিলেন। যারা মা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে, এমন কিছু চার্চের সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কাকা ছিলেন পরভিনের ঘনিষ্ঠ। তিনি থাকতেন গুজরাতে। ৮০ বছর বয়সের জন্য তিনি মুম্বইয়ে পরভিনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেও পারতেন না। পরভিন ববির যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল। জহুর ফ্ল্যাট ছাড়াও জুনাগড়ে এক বিশাল হাভেলি ছিল। প্রচুর অলংকার ছাড়াও ব্যাংকে কুড়ি লক্ষ টাকা জমানো ছিল। এই সম্পত্তি নিয়ে তাদের ফ্যামিলির মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। পরে একটা উইল পাওয়া যায়। কিন্তু পরিবারের লোকেরা সেটা অস্বীকার করে। মামলা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ওই উইলে বলা ছিল সমগ্র সম্পত্তির ৮০ শতাংশ এমন কোন সংস্থাকে দেওয়া হোক যারা শিশু এবং মহিলাদের জন্য কাজ করে। বাকি কুড়ি শতাংশ ওনার ওই কাকাকে দেওয়া হোক । এই বিষয়ে ২০১৬-তে কোর্ট রায় দেয়। কোর্ট একটা ট্রাস্টি বোর্ড তৈরি করে দেয়। যার পরিচালন ক্ষমতা থাকে মূলত পরভিনের ওই কাকার হাতে। সেখানে উইল অনুযায়ী ৮০ শতাংশ দেওয়া হয়। বাকি টাকার কুড়ি শতাংশও ওই ট্রাস্টের হাতে চলে যায়। যারা এখনো শিশু এবং মহিলাদের সেবায় কাজ করে চলেছে।