হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিGhost : গেছো থেকে চোরাচুন্নি, নানা রূপে ভূতকাহিনী

Ghost : গেছো থেকে চোরাচুন্নি, নানা রূপে ভূতকাহিনী

Ghost : গেছো থেকে চোরাচুন্নি, নানা রূপে ভূতকাহিনী

দেবস্মিতা নাগ
এসে পড়েছে আষাঢ় মাস, সাথে করে নিয়ে এসেছে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, ইলিশ মাছ। কিন্তু বর্ষাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে গেলে, বাঙালির আরেকটা জিনিস লাগে। ওই জিনিসটি ছাড়া উদরপূর্তি অসম্পূর্ণ। সেটি হল, একটা আষাঢ়ে গপ্পের ভূতুড়ে বই। মুখশুদ্ধি হিসেবে ছুটির দিনে ওটি কিন্তু বাঙালির চাই-ই চাই। শিশু কিশোররা তো বটেই, বড়রাও অনেক সময় বইয়ের তাক থেকে ঝেড়ে ঝুড়ে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। এক লহমায় পৌঁছে যান ফেলে আসা কৈশোরে।

কাদের হাত ধরে? সেই ‘তেঁনাদেঁর’ হাত ধরে। বাংলা গল্প, আষাঢ় মাস, ঝমঝমে বৃষ্টি দিয়ে শুরু হলেই বুঝতে হবে, এইবারে ‘তেঁনারা ‘ অর্থাৎ ভূতেরা হাজির হবেন, আর খোলা গলায় কিছু বলবেন বা লম্বা ঠ্যাং ঝুলিয়ে গাছে বসে পা দোলাবেন। বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে শীর্ষেন্দু, সঞ্জীব সবাই কিন্তু তাঁদের গল্পে ভূতেদের জায়গা দিয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যে রকমারি ভূতের দেখা মেলে। এইসব ভূতের পরিচিতির সাথে বঙ্গ সমাজের নানান উত্থান পতনের কাহিনী জড়িয়ে আছে। আজ সেই সব ভূতেরা কী করে বঙ্গসাহিত্যে জন্মালো, সেই কথাই হবে।

প্রথমেই বলি, মেছো ভূতের কথা। বাঙালির বড় পছন্দের ভূত মেছো। হবেই তো। এবং সঙ্গত কারণেই। মাছ খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনে নিয়ে কত বাঙালির যে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়, তা কে বলতে পারে! সেই সব ভূতেরাই তো মানুষের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে মাছ আদায় করে খায়।

এর পর আসে শাকচুন্নি বা শঙ্খচূর্ণিকা। এরা বিধবা ভূত। এরা জীবিতাবস্থায় অসম্ভব অবহেলা অত্যাচার সহ্য করে মারা যায়। ফলে মৃত্যুর সময় এদের মনে অনেক অতৃপ্ত বাসনা থেকে যায়। সেই সব বাসনা চরিতার্থ করতেই এরা লোকের ঘাড় মটকায়। এদের পরনে থাকে সাদা শাড়ি। এরা গ্রামের উপান্তে বনে বাদাড়ে বাস করে।

সবচেয়ে শক্তিশালী ভূত হলো বেম্মদত্যি বা ব্রহ্মদৈত্য। এরা হলো ব্রাহ্মণ ভূত। তাই প্রাচীন বঙ্গসমাজ এদেরকেই সবচেয়ে শক্তিশালী ধরে নিয়েছে। এরা সাধারণত থাকে প্রাচীন বট গাছে।এদের হাতে পড়লে আর নিস্তার নেই।

আর দেখা যায় মামদোকে। মুহম্মদ কথাটা থেকে মামদো নামটা এসেছে। অর্থাৎ, মুসলমান মরলে মামদো ভূত জন্মায়।

কন্দকাটা বা স্কন্ধকাটা ভূতের মাথা থাকে না। রেলে কাটা পড়লে বা গলা কাটা গিয়ে মারা গেলে এ হেন ভূত হয়। এরা সারাক্ষণ জ্যান্ত মানুষের মাথা খুঁজে বেড়ায়।

গেছো ভূতেরা খুবই বিপজ্জনক হয়। এরা সন্ধেবেলা গাছতলা দিয়ে কোনো মানুষ গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকায়।

বেঘো ভূত দেখা যায় সুন্দরবন এলাকায়। সেখানকার মানুষরা বাঘের পেটে গেলে বেঘো ভূত হয়ে জন্মান। এরা গ্রামের লোককে ভয় দেখাতে বাঘের গলা নকল করে ডেকে ওঠে।

এরকমই চেনা মানুষের গলা নকল করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা নিশি ভূতের একটা খারাপ স্বভাব। অবশ্য তার ডাকে সাড়া না দিলে আর ভয় নেই।

যে কোনও মহিলা অতৃপ্ত ইচ্ছা নিয়ে মারা গেলেই পেত্নী হতে পারেন। সেক্ষেত্রে পা যদি পিছন দিকে ঘোরানো হয়, বুঝতে হবে সেটা একটা পেত্নী। এরা সাধারণত খুব বদমেজাজি হয়। আর যে কোনও চেহারা ধারণ করতে পারে।

চোর মরে ভূত হলে চোরাচুন্নি হয়। এ মরেও চুরি করতে গৃহস্থের ঘরে ঢোকে। স্বভাবটা বড্ড খারাপ।গঙ্গাজল ছিটিয়ে একে বাড়ি ছাড়া করতে হয়।

প্যাঁচা পেঁচির হলো সবচেয়ে সাংঘাতিক ভূত। খুব কমই একে দেখা যায়। গভীর জঙ্গলে থাকে। একলা পথিক দেখলে তাদের মেরে মাংস খায়।

সব শেষে বলি সাহেব ভূতের কথা। এরা সেই ইংরেজ আমলে বিপ্লবীদের হাতে নিহত নীলকুঠির সাহেব।খুবই নিরাপদ ভূত। ওই কুঠিগুলোর বাইরে পা দেন না। সাহেবি কেতায় আজও সে সব নীলকুঠিতে বাস করেন। ওনাদের জন্য রাতের বেলা নীলকুঠিগুলো আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে।

যুগে যুগে ‘তেঁনারা’ বঙ্গসাহিত্য ও বাঙালির বর্ষাকালকে জমিয়ে রেখেছেন। ‘তেঁনাদেঁর’ দীর্ঘায়ু কামনা করি।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img