ডঃ বিকাশ পাল, লন্ডন
সর্বনাশ ! করছেন কী মশাই? এই গান আপনি মান্না দে-কে দিয়ে গাওয়াবেন ? ও এই গান গাইবে কী করে? ও তো এই গানটাকে কীর্তন বানিয়ে ছেড়ে দেবে। রতুবাবুকে এই কথাগুলি কলকাতার কেউ বলেছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ১৯৬৪-৬৫ সাল। মানে আমাদের অনেকের, অন্তত আমার জন্মের আগে। গানের কথাগুলি লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর করেছিলেন রতু মুখোপাধ্যায়। কলকাতার বাংলা গানের জগতে তখন মান্নাবাবু ছিলেন এতটাই উপেক্ষিত, অনাকাঙ্কিত।
অথচ হিন্দি সিনেমায় গান করে তখন তিনি আসমুদ্র হিমাচলের এক চর্চিত নাম। বাংলাতেও তিনি বেশ কয়েকটা সিনেমা আর আধুনিক গান গেয়েছেন। ‘আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ’ , ‘আমি আজ আকাশের মত একেলা’, ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’-এর মত অসাধারণ সব গান, আবার নিজেরই করা সুরে। সিনেমাতেও গেয়েছেন সলিল বাবুর সুরে, ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি, সব সত্যি’, সেই কবে ১৯৫৪-৫৫ তে ছবি বিশ্বাসের লিপে। মাতালের গান, অথচ কোনও বেলেল্লাপনা নেই। সুধীনবাবুর সুরে ১৯৫৮ তে ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’ বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শান্তিদেব ঘোষের লিপে। আমি আজ আকাশের মত একেলার সুরের সাথে বিং ক্রসবির ‘ও ডানি বয়’-এর কোথায় যেন একটা মিল । পরে বলেছেন উনি সুর করতে গিয়ে ঐ গানটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যাঁদের একটু আধটু গান ভাল লাগে, এই গানগুলির যে কোনো একটা শুনলেই তাঁরা বলবেন, তিনি কত ভালো গাইতে পারেন, তাও তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো হবে না। একে নিছক ঈর্ষা ছাড়া কি আর বলা যেতে পারে।
আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক। আমাদের পেশায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে ঠিকই, তবে সঙ্গীতের জগতে তা বহুগুণ বেশি। তা না হলে রতুবাবুকে ওই কথা শুনতে হতো না।
তারপর যা হোল সে তো ইতিহাস। রতুবাবুর সুরে সে বছর তিনটি গান রেকর্ড করেছিলেন মান্না বাবু। ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’, ‘পারো যদি ফিরে এসো, তোমারি থাকবো আমি তখনও’, ‘হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই, কজনা তোমার মতো গাইতে জানে’ – পুলক বাবু নিন্দুকদের জবাব তার কথাতেই দিয়ে দিলেন ওই শেষ গানটাতে। আজও প্রায় ৬০ বছর হতে চলল, এই তিনটি গান সমান জনপ্রিয়। মানুষ যতদিন জীবনকে ভালবাসবে – ততদিন এই সব গানও বেঁচে থাকবে।
আজ মে ডে – তাঁর অনুরাগীরা বিশেষ করে বাংলার বাইরের মানুষরা বলতেন, ‘মে ডে -মান্না ডে’, ঠিকই ধরেছেন – আজ এই কিংবদন্তী শিল্পীর জন্মদিন । তিনি বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ১০৫ বছর বয়স হোত। বছরের এই দিন রফিসাহেব নিয়ম করে কয়েক ঝুড়ি আলফানসো আম তাঁর বাড়িতে উপহার পাঠাতেন। বাড়ি ভরে যেত ফুল, ফল, মিষ্টি আর চিঠিতে। তিনি দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জন্মদিনের ফোন ধরতে ব্যস্ত থাকতেন।
‘রঙ্গিনী কতো মন’ গানটি ১৯৬০-এর দশকের একেবারে শেষের দিকের গান। এই গান দিয়েই আমার গান শোনার শুরু। এই গানেই প্রথমে আমি প্রেমকে উপলব্ধি করি। জীবনে যখন প্রেম পরিণতি পায়নি, তখন সেই সব হতাশ মুহূর্ত থেকে আমায় উদ্ধার করেছে তাঁরই গান, যেমন ‘দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি, করেছে রাজার রাজা – ও রানী সাহেবা বিদায় এবার’।
তবে ১৯৬৪ সালে রতুবাবুর সুরে গাওয়া ওই তিনটি গানের মতো ‘রঙ্গিনী কতো মন` গানটিরও একটা অসাধারণ পটভূমি আছে, যেটা আমি মান্নাবাবুর আর পুলকবাবুর জীবন চেতনা আর সঙ্গীত ভাবনা নিয়ে একটু পড়াশুনো করে জানতে পেরেছি। তিনি কত জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, তাঁর গান শুনে কোনও রুচিশীলা তাঁর সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব করতে আগ্রহ কি দেখাননি? এই প্রশ্নের মুখে তাঁকে বারবার পড়তে হয়েছে, তাঁর একেবারে কাছের মানুষগুলির থেকেই। তাঁর জীবনে এসব যে ঘটেনি তা নয়। তবে যখনই অন্য দিক থেকে একটু ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েছেন, অমনি নামের শেষে দিদি দিয়ে মহিলাদের সম্বোধন করতে শুরু করেছেন। তাই সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তিনি এই গানটির সুর এভাবেই করেছেন।
পুলকবাবুর প্রশ্নের জবাব পুলকবাবুর কথাতেই দিয়েছেন, তবে তাঁর নিজের সুরে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভালোবাসার চেতনার আকাশে একজনই বিরাজমানা – তিনি সুলোচনা দেবী-তাঁর জীবনসাথী। এই গানে সেটা একেবারে পরিষ্কার। যেমন একটা লাইন আছে, ‘সন্দেহে ভরা হোক তোমার দুচোখ , আর কারো চোখে আমি চাইনা’। প্রথমবার দুচোখের ‘চোখ’ কথাটা যখন বলছেন,;তখন কত যত্ন আর আগ্রহ করে সেটা বলছেন । সেটা গানটা একটু মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়। সন্দেহ নেই এই চোখ বলার সময় তিনি সুলোচনা দেবীর চোখের কথাই বলছেন। আর কারো চোখে আমি চাইনা’র জায়গাটাতে ‘চোখে’ বলার সময় কিন্তু সাধারণভাবেই বলছেন – সেখানে না আছে তত আবেগ, না আছে তত আগ্রহ। শুধু সুরে গেয়ে চলেছেন।
‘হিন্দি সিনেমার গানে তাঁর প্রথম সাফল্য আসে ১৯৫০ শে ‘মশাল’ ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি গেয়ে, শচীনকর্তার সুরে , কবি প্রদীপের কথায়। তারপর একটার পর একটা বাজিমাত করা গান। লতাজির সাথে দ্বৈত কণ্ঠে রাজকাপুর নার্গিস জুটির জন্য ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’, ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’। ‘দো বিঘা জমিন’-এ ‘ও ভাইরে’, কাবুলিওয়ালাতে ‘অ্যায় মেরে প্যারে ওয়াতন,মেরি সুরত তেরি আঁখে তে 'পুছো না ক্যায় সে ম্যায় নে রায়েন বিতাই' , দিল হি তো হ্যায় তে
লাগা চুনরি মে দাগ, ওয়াকত এ;
অ্যায় মেরি জোহরা জুবিন। শেষের এই গানটি তো ৫০ বছরেরও বেশি হোল উত্তর ভারতের বিয়ে বাড়ির একটি বাঁধা গান হয়ে গেছে, এরকম আরও কত গান। আমার তো মনে হয় হিন্দি সিনেমার ১০০ বছরে যদি প্রথম ১০টি রোমান্টিক ডুয়েট গানবাছাই করার জন্য ১০ টা আলাদা প্যানেল বানানো হয়, প্রত্যেক প্যানেলই 'প্যায়ার হুয়া ইক রার হুয়া',
ইয়ে রাত ভিগি ভিগি গান দুটোর থেকে অন্তত একটাকে প্রথম ১০ এ রাখবেন।
আনন্দ-এ
জিন্দেগি ক্যায়শী হে পাহেলি হায়-এ গানটি সলিলবাবু রাজেশ খান্নার লিপে মান্নাবাবুকে দিয়েই গাইয়েছেন, কেননা এটা তিনিই পারতেন । আর ঐ বেলুন উড়িয়ে সমুদ্র সৈকতে এই গানটি গেয়ে রাজেশজী অভিনয় করছেন । এই দৃশ্যটিই আজ রাজেশ খান্নার অভিনয় জীবনকে অমরত্ব দিয়েছে – বান্দ্রাতে এই পোষাকেই বেলুন হাতে তাঁর পূর্ণমূর্তি বসেছে । রাজেশ খান্না হিন্দি সিনেমার প্রথম সুপারস্টার -ভাবা যায় – মুম্বাই এর মানুষ তাঁকে মনে রাখতে চান মান্নাবাবুর গানের দৃশ্যে – এখানেই তাঁর সঙ্গীত জীবনের সার্থকতা ।
বিভিন্ন আলাপচারিতায় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে কি ভাবে তিনি সুরের উপর এত সুন্দরভাবে কথার ছবি আঁকতে পারতেন তাঁর গানে । উত্তর দিতে গিয়ে সব সময় লক্ষ্য করেছি তিনি মাথা নুইয়ে কিছুক্ষণ থেমে গিয়েছেন । তখন তাঁর সঙ্গীতগুরুদের কথা তাঁর মনে এসেছে । তিনি তাঁর পিতৃব্য সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে তালিম শুরু করেছিলেন , এছাড়াও তিনি উস্তাদ দবীর খাঁ , উস্তাদ আমন আলি খাঁ , উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ আর উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খাঁ -এর থেকে তালিম নিয়েছিলেন। আমন আলি খাঁ সাহেব তাঁকে শিখিয়েছিলেন কি ভাবে গানে স্বরবর্ণকে সুরে উচ্চারণ করতে হয় । শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাষায় একে বলে নুম
-স্বরবর্ণ দিয়ে স্বরগম কে বলা । এই জন্যই তাঁর গানে শব্দের বিন্যাস তিনি এত সুন্দর করে করতে পারতেন।
উস্তাদ রশিদ খানের মামা , উস্তাদ গুলাম মোস্তফা খাঁ তাঁকে তালিম দিয়েছিলেন তার সপ্তকেও কিভাবে গলা খুলে গাইতে হয় । উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ তাঁকে শিখিয়েছিলেন কিভাবে গানের কথার অর্থ বুঝে সুরের ভেতরে ঢুকে কথার ছবি আঁকতে হয় স্রোতার মনে । তবে গানে তিনি মোটেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কালোয়াতী করেন নি । যতটুকু না হলে নয় । অথচ তিন মিনিটের গানে, বোল বিস্তার, ছোট তান, শ্রুতি , গমক, মিড় সবই আছে । আর সেজন্যই তাঁর গান তাঁর মত করে কেউ গাইতে পারেন না । এই জন্যই সারা দেশের মানুষ যখন রফি সাহেবের গানে বুদ থাকতেন – রফি সাহেব তখন একান্তে শুনতেন মান্না বাবুর গান । সত্যই তিনি শিল্পীর শিল্পী ।
আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরন করলাম পুলক বাবুর লেখা আর রতু বাবুর সুরে তাঁর ওই পারো যদি ফিরে এসো গানটির কথা দিয়ে –
“হাজার বদল হউক পৃথিবী –
পুরনো হবে না প্রেম কখনো ।
সত্যিই তাঁর গানের জন্যই প্রেম যেন সত্যি , আর তা কখনও পুরনো হবে না, অন্তত আমার জীবনের অভিজ্ঞতা তাই বলে। মান্না বাবুর মতো শিল্পী যদি পৃথিবীতে আবার আসতেন । তাই তাঁর গানের লাইন দিয়েই তাঁকে আমার জন্মদিনের প্রণাম ।
পারো যদি ফিরে এসো,
এসো ফিরে, তোমারি থাকবো আমি তখনও
(লেখকের স্বীকারোক্তিঃ এই লেখাটা আমার একান্ত নিজের মত করে তাঁর গান বোঝা থেকে বিশ্লেষণ। তাই আমার মতামতের সব নৈতিক আর সাংগীতিক দায় আমারই )