হোমফিচাররামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন: এক অনন্য যাত্রাপথের কাহিনী

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন: এক অনন্য যাত্রাপথের কাহিনী

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন: এক অনন্য যাত্রাপথের কাহিনী

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়:
রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশন হচ্ছে, পাশাপাশি অবস্থানরত জোড়া-প্রতিষ্ঠান। একে যেন অন্যের পরিপূরক। ১৮৯৭-এর ১ মে, স্বামীজির উপস্থিতিতে রামকৃষ্ণ মিশনের পথ চলা শুরু। গোড়ার দিকে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ বা ‘রামকৃষ্ণ প্রচার’-এর নাম ছিল ‘রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন’। কলকাতার বাগবাজার এলাকায় ঠাকুরের ভক্ত বলরাম বসুর বাড়িতে এই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

তবে রামকৃষ্ণ মঠ বা সন্ন্যাসী সঙ্ঘের আদি কাজ কিন্তু তার বহু আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই মঠ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশায় কাশীপুর বাগানবাড়িতে দানা বাঁধে। হয়তো মঠের নাম ঠিক হয় নি, হয়তো ঠিকানাও নির্দিষ্ট ছিল না, হয়তো নানান সময়ে মঠ স্থানান্তরিত হয়ে নানান জায়গায় গিয়েছে, তবুও তার একটি প্রবল প্রবাহ অব্যাহত ছিল।

মঠজীবনে বরানগরে ছিল কঠোর তপশ্চর্যার ক্ষেত্র এবং তা ছিল অনস্বীকার্য, এমনই মন্তব্য করেছিলেন স্বামীজি। কথামৃতে দেখা যায়, এই বাগানের জন্য আদরের নরেনকে দলপতি নির্বাচিত করে গেছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ১৮৮৪ সালের ২৩ শে মার্চ বললেন, “নরেন, দলপতি টলপতি হয়ে যেতে পারে। ও যেদিকে যাবে, সেইদিকেই একটা কিছু বড় হয়ে দাঁড়াবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণের উপস্থিতিতে ১৬-১৭ জন তাপসকে নিয়ে রামকৃষ্ণ সন্ন্যাসী সঙ্ঘের সূচনা কাশীপুর বাগানবাড়িতে। এটিই ছিল রামকৃষ্ণ ভাব-আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। এখানেই ১১ জন ত্যাগীভক্তকে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে গেরুয়া বস্ত্র দান করেন। নরেন্দ্রনাথ, রাখাল, বাবুরাম, নিরঞ্জন, যোগীন্দ্র, তারক, শরৎ, শশী, কালী, লাটু এবং বুড়োগোপাল পেলেন গেরুয়া সন্ন্যাস। আর এই মঠেই ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি তিনি ‘কল্পতরু’ হলেন। এই মঠেই গুরুভ্রাতাদের প্রতীতী জন্মাল, সারদাদেবী শ্রীরামকৃষ্ণের ‘শক্তি’, তিনি জীবন-মিশনের সহায়িকা সঙ্ঘজননী। এখানেই ঠাকুরের জন্য সংসারত্যাগ করে আসা যুবকদের সঙ্ঘবদ্ধ করলেন নরেন্দ্রনাথ।

কাশীপুর বাগানবাড়িতেই নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি-সুখ আস্বাদন করেছিলেন ঠাকুরের আশীর্বাদে। এখানেই ঠাকুরের কাছ থেকে তিনি সংগঠন তৈরির উপদেশ পেলেন এবং ঠাকুর কর্তৃক নেতার ভূমিকায় সংস্থাপিত হলেন, “দ্যাখ নরেন, তোর হাতে এদের সকলকে দিয়ে যাচ্ছি। কারণ, তুই সব চেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী। এদের খুব ভালবাসবি। আর ঘরে ফিরে না গিয়ে সবাই যাতে একসঙ্গে খুব সাধন ভজনে মন দেয় তার ব্যবস্থা করবি।”

দেখা যাচ্ছে রামকৃষ্ণ ভাবধারার উৎপত্তি দক্ষিণেশ্বরে মাতৃমন্দির ও পঞ্চবটী হয়ে তা ধীরে ধীরে শ্যামপুকুর, কাশীপুর, বরানগর, আলমবাজার পেরিয়ে পৌঁছল বেলুড়ে। গঙ্গার তীরে তৈরি হল রামকৃষ্ণ-ভাবগঙ্গার প্রবল প্রবাহ।

কাশীপুর মঠ সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ব্রহ্মানন্দ মহারাজকে চিঠিতে লিখছেন (১৩ ই জুলাই, ১৮৯৭), “ও-বাগানের সহিত আমাদের সমস্ত association। বাস্তবিক এটাই আমাদের প্রথম মঠ।” অর্থাৎ কাশীপুরে ভাড়া করা বাগানবাড়িতেই প্রথম গড়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ মঠ, যা কলকাতায় মতিঝিলের কাছে কাশীপুর রোডের উপর ১১ বিঘা ৪ কাঠা জমির উপর বিস্তৃত ছিল। এটি শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অন্ত্যলীলার স্থল’ এবং এখানেই মহাপ্রয়াণের পূর্বে তিনি একাদিক্রমে ২৪৮ দিন অবস্থান করেছেন (১১  ডিসেম্বর, ১৮৮৫ — ১৬ অগাস্ট, ১৮৮৬)। পরে ১৯০১ সালে একটি ট্রাস্ট হিসাবে রামকৃষ্ণ মঠ রেজিস্ট্রিকৃত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই এই মঠ রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

১৮৯৭-এর ১ মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি রবিবার বিকেল চারটের পর বলরাম বসুর বাড়িতে সাপ্তাহিক অধিবেশন হত৷ একাদিক্রমে ৩ বছর ধরে সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বামীজি সুবিধামত ওই অধিবেশনগুলিতে উপস্থিত থাকতেন, উপদেশ দিতেন, কখনও সঙ্গীত পরিবেশনও করতেন।

২ জানুয়ারি, ১৮৯৯ সালে হাওড়ার বেলুড়ে সংগঠনের নিজস্ব জমি ও বাড়িতে রামকৃষ্ণ ভাবধারার মূলকেন্দ্র স্থাপিত হল। এই স্থানটিতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব আগেই পদার্পণ করেছিলেন। যেন মিশন তৈরির জন্য ‘কুটোবাঁধা’ হয়েই ছিল এই জমি। স্বামী বিবেকানন্দ মঠের জন্য জমিটি কিনেছিলেন ১৮৯৮ সালের ৪ ঠা মার্চ ভাগবতনারায়ণ সিং-এর মালিকানা থেকে। ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর মঠের নিজস্ব জমিতে ঠাকুরকে পুজো করে পরমান্ন নিবেদন করেছিলেন৷

রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কাজ সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন (‘স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি’ গ্রন্থ থেকে), “পীড়িতের শুশ্রূষা ও দরিদ্রকে আহার্যদান বস্তুতঃ প্রথম হইতেই শ্রীরামকৃষ্ণ-সন্তানগণের স্বাভাবিক কার্য ছিল৷ কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার পরে ঐ কার্যগুলি বিপুল আকার ধারণ করে। অতঃপর ঐ-সব কার্য জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হইত। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে সাহায্য দিবার জন্য, কোনো শহরে স্বাস্থ্যবিধি পালন সম্বন্ধে নির্দেশ দিবার জন্য, অথবা কোনো তীর্থস্থানে পীড়িত ও মুমূর্ষুগণকে সেবা-শুশ্রূষা করিবার জন্য মঠ হইতে লোক পাঠানো হইতে লাগিল।”

বরানগরে মঠ চলাকালীন সময়ে ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাবুরাম মহারাজের মায়ের আমন্ত্রণে নয়জন গুরুভাই (নরেন্দ্র, তারক, শশী, কালী, বাবুরাম, শরৎ, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর ও সারদা) হুগলির আঁটপুরে পৌঁছলেন। এখানেই ২৪ শে ডিসেম্বরে তাঁরা ধুনি প্রজ্জ্বলিত করে পালন করলেন ‘ত্যাগব্রত দিবস’। ১৮৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে নরেন্দ্রনাথ এই বরানগর মঠ থেকে বেরিয়ে এলেন ভারতবর্ষকে পরিপূর্ণভাবে চিনতে। তারপর তিনি পৌঁছে যান শিকাগো ধর্মমহাসভায়৷ সাত বছর পর যখন মঠে ফিরে এলেন (তখন মঠ আলমবাজারে) তখন তিনি বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। আলমবাজারে মঠের কাজ চলে প্রায় ৬ বছর। শেষ হয় ১৮৯৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে।

আলমবাজার মঠ সম্পর্কে (১৮৯৫ সালের ঘটনা) স্বামী অখণ্ডানন্দজী লিখেছেন, “মঠে আমরা প্রায় ডাল, ভাত ও চচ্চড়ি মাত্র খাইতাম। কোন কোন দিন ডালের সঙ্গে ফালা করে ঝুনো নারিকেল আমাদের তরকারির সাধ মিটাইত৷ রাত্রে রুটিতে ঘৃতের সংস্পর্শও থাকিত না।”

১৮৯৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি স্বামীজি আলমবাজার মঠে ফিরলেন। এরপর গঙ্গার পূর্বকূল ছেড়ে মঠ উঠে এল পশ্চিম কূলে বেলুড়ে৷ এই এক বছরের মধ্যে তিনি ভারতের নানান স্থান ভ্রমণ করেন এবং ৫০ দিনের মতো সময় আলমবাজারে অতিবাহিত করেন। জানা যায়, ১৮৯৭ সালের মার্চের শেষার্ধে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজে গেলেন মঠ স্থাপনের জন্য। তিনি ঠাকুরের পবিত্র দেহাবশেষ সংরক্ষণ ও সেবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

মঠের পরিচালনা ও কাঠামো সম্পর্কে স্বামীজির অভিমত (১৮৯৭ সালের ১১ জুলাই-এর কার্য-বিবরণী) ছিল, মঠে তিনজন করে মহন্ত নির্বাচন করলে ভালো, একজন দেখবেন বৈষয়িক, একজন আধ্যাত্মিক এবং একজন দেখবেন জ্ঞানার্জনের বিষয়। স্বামীজি সবসময় জনসাধারণের দান করা অর্থের সঠিক হিসাব রাখার উপর জোর দিয়েছেন৷ এমনকি বিদেশে বসেও চিঠিতে তার নির্দেশ দিয়েছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দকে (১০ ই আগষ্ট, ১৮৯৯), “লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায় — এই দস্তুর। প্রতিপদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়।”

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রচারের অন্যতম উপায় ছিল পত্র পত্রিকা। এইভাবে প্রকাশিত হতে লাগল ইংরেজি পাক্ষিক ‘ব্রহ্মবাদিন্’ (১৮৯৫ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর মাদ্রাজ থেকে), ইংরেজি মাসিক ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ (১৮৯৬ সালের জুলাই মাদ্রাজ থেকে) এবং বাংলা ‘উদ্বোধন’ (১৮৯৯ সালের ১৪ ই জানুয়ারি কলকাতা থেকে)। রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার পর প্রতি রবিবার শাস্ত্রপাঠ ও ভাষণের আয়োজন করা হয়। পরে বড় বড় হলে এবং জনসভার আয়োজন করে বক্তব্য পরিবেশনের ব্যবস্থা হয়৷

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img