সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের সময় কী হয়েছিল, যার জেরে তোলপাড় হয়েছিল গোটা রাজ্য। পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ফিরে দেখলেন প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
ছ ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার কৃষ্ণবর্ণ সেই যুবক ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন আসতে পারি? নিবিষ্ট মনে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। বললাম আসুন। ব্যক্তিটি ভেতরে এসে বসলেন। ‘বললেন আমার নাম শিকারী। থাকি হাওড়ায়। আমার সম্পর্কে পরে জেনে নেবেন। আমি আপনাকে বলতে এসেছি যে, স্বপন জামিন পেয়েছে। সাবধানে থাকবেন। আমাকে বলা হয়েছিল আপনাকে মারার জন্য। আমি বলেছি, পারবো না। দেখুন দাদা আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনার সম্পর্কে জানি।’
বললাম, এই কেসে তো জামিন পাবেই । এখন ও থাকছে কোথায়? পাড়ায় তো নেই? তিনি বললেন, আমহার্স্ট স্ট্রিটে এক কংগ্রেস নেতার শেল্টারে আছে। কমিশনার বদল হওয়ায় ও সমস্যায় পড়েছে। ও এটাও জানে নতুন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার সৎ ও বামপন্থী লোক। পুলিশে ওর যে কন্ট্যাক্ট ম্যান ছিল মিসিরজি এখন বেকায়দায় আছেন। জিজ্ঞেস করলাম মিসিরজি কে? উত্তরে জানলাম, মিসির হলেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কনস্টেবল। দুঁদে ও নামকরা দুই পুলিশ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগী ও উমাশঙ্কর লাহিড়ীর দেহরক্ষী। বরানগর থেকে বেহালা সব গুণ্ডা মিসিরের হাতে থাকে। বললাম ঠিক আছে দেখা যাক। বললাম চা খাবেন? বললেন, চা খাই না, সাবধানে থাকবেন।
কিছুক্ষণ পর পাড়ারই এক বাল্যবন্ধু দেবুু মিত্রকে ঘটনাটা বলি। দেবু ও এই প্রতিবেদক ১৯৭০ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে দুজনে একই শেল্টারে বহু রাত কাটিয়েছি। দেবু শিকারীর কথা শুনেই স্বপনের বাড়ি গেল। পথে মিন্টু নামে স্বপনের এক সাগরেদের সঙ্গে দেখা। দেবু বলে, শোন মিন্টু দেবাশিসের কোন ক্ষতি হলে স্বপন কিন্তু পৃথিবীতে থাকবে না। পাড়ার লোকেরা ঘর জ্বালিয়ে দেবে। বলবি দেবুদা একথা বলেছে। এটাও ঠিক কলকাতা পুলিশ তখন এই প্রতিবেদকের নিরাপত্তায় সাদা পোশাকের পুলিশ দিতে চেয়েছিল। প্রতিবেদক রাজি হননি। আজকাল পত্রিকার সম্পাদক সহকর্মী এবং পাড়ার বন্ধুরা যতটা সম্ভব খোঁজ রাখতেন এবং দেবু শ্যাডো করতো। এর কিছুদিন পর একদিন সকালে ছ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এক ব্যক্তি এসে হাজির হলেন। বললেন আমার নাম মিসির। আমি লালবাজারে ডি.ডি তে চাকরি করি। আমাকে বাঁচান। বললাম কেন কি হয়েছে? আজকাল পত্রিকায় আমার সম্পর্কে ভাস্কর মিত্র একটা ভুল রিপোর্ট দিয়েছে। বললাম রিপোর্ট নিয়ে কিছু বলার থাকলে, অফিসে গিয়ে সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তকে বলবেন। কিন্তু মিসির নাছোড়বান্দা। বললেন আপনি তো চিফ রিপোর্টার। ঘুরিয়ে একটা রিপোর্ট লিখতে পারবেন না? বললাম পারবো না।
তখন মোবাইল ফোন চালু হয়নি। ল্যান্ড ফোনে সম্পাদক মশাইকে জানালাম। তিনি বললেন, ভাস্করকে ফোন করে জেনে নাও। ভাস্করকে ফোন করলাম। ভাস্কর বললো দাদা যা যা লিখেছি সব ঠিক। এই লোকটা হল লালবাজার ও কলকাতার গুন্ডাদের মধ্যে লিয়াসো ম্যান। এর প্রচুর অবৈধ টাকা। মেটিয়াবুরুজে ও একটি ইট ভাটার মালিক। স্বপন, শ্রীধরের মতো ছেলেরা ওকে বখরার ভাগ দেয়। আরও কিছু কথা হল। সব শুনে মিসিরকে বললাম রিপোর্ট ঠিক আছে। রিপোর্টারের পাশে আছি। আপনি মানহানির মামলা করতে পারেন। মিসির চলে যাবার সময় বললেন, বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম। মিসির চলে গেল। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। কিছুদিন পর দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। মেটিয়াবুরুজের কাছে আক্রায় রিভলভার নিয়ে গুন্ডামি করতে গিয়ে মিসির পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সাসপেন্ড হয়ে যায়।
ওই ঘটনার কিছুদিন পরে আমহার্স্ট স্ট্রিটে এক কংগ্রেস নেতার বাড়ি থেকে অন্য একটি মামলায় ফের স্বপন ধরা পড়ে। পরদিন রাসবিহারী মোড়ের কাছে হঠাৎ অপরিচিত দুজন এই প্রতিবেদককে দাঁড় করায়। একজন বললো স্বপন দে কংগ্রেসের লোক বলে ওর বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লাগলেন? অথচ শ্রীধর দাসের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেন না! কেন ও সিপিএমের লোক বলে?
(চলবে)