হোমক্রাইম রিপোর্টারCRIME REPORTER : হত্যা না আত্মহত্যা, মহুয়ার মৃত্যু আজও রহস্যই

CRIME REPORTER : হত্যা না আত্মহত্যা, মহুয়ার মৃত্যু আজও রহস্যই

CRIME REPORTER : হত্যা না আত্মহত্যা, মহুয়ার মৃত্যু আজও রহস্যই

(CRIME REPORTER: এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত নার্সিং হোমের আট তলায় ৭২২ নম্বর ঘর। আষাঢ় শেষের বেলা। বিরামহীন বৃষ্টি। বাইশে জুলাইয়ের দুপুর। ঝলসানো শরীর অস্ফুট উচ্চারণে শুধু কয়েকটা শব্দ শোনা গিয়েছিল, “আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস।” অভিনয় জীবনের সাফল্যের মধ্য গগনেই সেদিন ঘটে গিয়েছিল চরম বিপত্তি। ১২/১৩ জুলাই ১৯৮৬-এর মাঝরাতে আকণ্ঠ মদ্যপ অবস্থায়, পার্টি থেকে বাড়ি ফেরার পরেই থার্ড ডিগ্রি বার্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল মহুয়া রায়চৌধুরীকে। টানা ১০ দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে হার মানতে হয় এই দাপুটে অভিনেত্রীকে।

দশ দিন ধরে ছটফট করেছিলেন বাংলা ছবির এক নম্বর নায়িকা। তবে পুলিশের কাছে কারও নামে সরাসরি অভিযোগ করেননি তিনি। তাই কেসটি ধামা চাপা পড়ে যায় সহজে। মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল মাত্র ২৮। এই বয়সেই তাঁর কাঁধে সেই সময় ছিল প্রায় ১৫-১৬ টি ছবির দায়িত্ব। আশির দশকে বাংলা ছবির জগতে নায়িকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের দাবিদার ছিল মহুয়া। শোনা যায়, ছবি প্রতি মোটামুটি এক লাখের ওপরে পারিশ্রমিক নিতেন এই নায়িকা । যা সমকালীন নায়ক-নায়িকাদের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আর হবে নাই বা কেন ? সিনেমার পোস্টারে তাঁর নাম বা ছবি যে অসংখ্য দর্শক টানতো। এমনকী চিত্রনাট্যও লেখা হতো তাঁকে মাথায় রেখেই। অগ্রগামী থেকে নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় থেকে তপন সিংহ, সকলেরই নজর তাই সেসময় ছিল মহুয়ার ওপর।

তাঁর ২৮ বছরের জীবনপঞ্জিতে নিহিত রয়েছে কতই না ওঠাপড়ার কাহিনী। জন্ম : ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮, মৃত্যু : ২২ জুলাই ১৯৮৬। দুইয়ের ব্যবধান মাত্র ২৮ বছর। মৃত্যু তো জীবনের সবথেকে কঠিন বাস্তব। কিন্তু তা যদি ঘটে অসময়ে, অস্বাভাবিকভাবে, তবে তা তো ট্র্যাজেডিরই নামান্তর। আত্মহত্যা নাকি হত্যা? নাকি নিছকই দুর্ঘটনা? অমীমাংসিত এই প্রশ্ন জালে আটকে আছে এক সময়ের ব্যস্ততম এই অভিনেত্রীর মৃত্যু অধ্যায়টি। যে মৃত্যুরহস্য আস্তরণ ফেলে দিয়েছে , তার ১৩ বছরের অসম্ভব সফল অভিনয় জীবনের ওপর।

নীলাঞ্জন রায়চৌধুরীর কন্যা, তিলক চক্রবর্তীর স্ত্রী, তমালের মা। এই ছিল মহুয়া রায়চৌধুরীর সমাজ নির্দিষ্ট পরিচয়। কিন্তু এই পরিচয়গুলো ছাপিয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারে বেড়ে ওঠা এই মেয়ে যে একক পরিচিতি তৈরি করেছিল তা হল ‘অভিনেত্রী’, ‘লিট্‌ল গ্লোরিয়াস টুইলাইট’, ‘জাত শিল্পী’ এবং আরও অনেক সম্মানীয় বিশেষণে। তাঁর অভিনয় জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি ছিল প্রায় নব্বইটিরও বেশি ছবি থেকে সঞ্চয় করা দর্শকানুকল্য। দাদার কীর্তিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার  এবং দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ওই একই সম্মান।

এই মামলাটির ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ‌ চমকে দেওয়ার মতো তথ্য জানালেন সেই সময়কার সিআইডির এক তদন্তকারী  অফিসার। তাঁর কথায়, মহুয়া আসলে পালিত বাবা-মায়ের কাছে মানুষ হয়েছিলেন। নীলাঞ্জন নয়, তার বাবা ছিলেন অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়। অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন ফিল্ম সম্পাদক। ‌পরবর্তীকালে পরিচালক। অন্য ধারার ছবি করার জন্য সারা ভারতে তাঁর বেশ নাম ছিল। সেই সময় টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় অভিনয় করতে আসেন এক তরুণী।

ওই মহিলা ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। তার সঙ্গে অর্ধেন্দুর সম্পর্ক তৈরি হয়। আর সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই মহুয়ার জন্ম। ‌ এর পরেই অর্ধেন্দু সঙ্গে ওই অভিনেত্রী মহিলার সম্পর্ক ভেঙে যায়। নীলাঞ্জন ছিলেন অর্ধেন্দুর ইউনিটে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর। অর্ধেন্দু তখন বেশ বিপাকে। এই শিশুকন্যাটিকে নিয়ে তিনি কী করবেন। তিনি তো অকৃতদার। তাই তিনি নীলাঞ্জনকে শিশুটিকে মানুষ করার জন্য অনুরোধ করেন। ‌ নিঃসন্তান নীলাঞ্জন এবং তাঁর স্ত্রী সানন্দে সেই অনুরোধ মেনে নেন। ‌ শিশুটি যত বড় হতে থাকে, ততই মহুয়ার  বাবা মা হিসেবে আশেপাশের জগতে পরিচিতি পান নীলাঞ্জন এবং তাঁর স্ত্রী।

মহুয়ার আসল মা সেই অপূর্ব সুন্দরী অভিনেত্রী অভিনয় থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতা থেকে চলে যান। পরবর্তীকালে বহু বছর পর ঋষিকেশে তাঁকে দেখা যায়। সন্ন্যাসিনীর বেশে। সকালবেলা স্টুডিও পাড়ায় এসে অর্ধেন্দুর শখ ছিল ঘুরে ঘুরে কাকদের মুড়ি খাওয়ানো। পরে সিনেমা জগতে অভিনেত্রী হিসেবে নাম করলে মহুয়াও একইভাবে কাকদের মুড়ি খাওয়াতেন। তাই স্টুডিও পাড়ায় অনেকেই বলতেন বাবার স্বভাব পেয়েছে মেয়ে।

অতি স্বল্প সময়ে গড়ে ওঠা মহুয়ার এই চরম সাফল্যের কারণগুলো কিছুটা ছিল তাঁর সহজাত এবং বাকিটা অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জিত। ধ্রুপদী বা আধুনিক, সমস্ত ধরনের নৃত্যেই সে যে শুধু পারদর্শী ছিল তাই নয়, সেই পারদর্শিতাকে নিখুঁতভাবে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয়ের কাজে লাগিয়েছিলেন মহুয়া, যা তাঁর সমসাময়িক অন্য নায়িকারা প্রায় কেউই পারেননি। এছাড়া ছিল অসম্ভব ভালো স্ক্রিন প্রেজেন্স, যাঁর মরমি অভিনয় দেখলে মনে হয়, পাশের বাড়ির আটপৌরে মেয়েটি, অথচ সেই আটপৌরতার মধ্যেও কোথাও যেন রয়ে গেছে অনন্যতার ছাপ। আর এ সব গুণের  মধ্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল তাঁর তুখোড় সৌন্দর্য- এক ঢাল কালো চুল, পানপাতা মুখ, মায়াময় দুটি চোখ আর সর্বোপরি প্রাণখোলা হাসি।

উচ্চাকাঙ্খী বাবার হাত ধরেই মহুয়ার সিনেমায় প্রবেশ। নীলাঞ্জন এক সময় উদয় শঙ্করের দলে নাচতেন। যশের আশায়, অর্থের সন্ধানে তিনি মুম্বই (তখন বম্বে) পাড়ি দেন। নামী এডিটরের শাগরেদি এবং আরও অনেক টুকটাক কাজ, এসব কোনও কিছুই যখন তাঁকে সাফল্যের আলো দেখাতে পারল না, তখন কতকটা বাধ্য হয়েই নীলাঞ্জন ফিরে এলেন কলকাতায়। আর ফিরেই অসফল পিতা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন কন্যার মাধ্যমে সাফল্য ছোঁয়ার। ঠিক যেমনটাতে অভ্যস্ত আমাদের সমাজের অধিকাংশ পিতামাতাই। চৌধুরীপাড়ার জলসায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সুচিত্রা সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মত তাবড় শিল্পীরা, সেখানে ‘দিল ভিল প্যার ভ্যার ম্যায় ক্যয়া জানুরে’র তালে তাল মিলিয়ে মাত্র সাত বছর বয়সে শিল্পী জীবন শুরু মহুয়ার।

আর ঠিক এই সময় থেকেই হারিয়ে যেতে লাগল সাধারণ মেয়েটা। হারিয়ে গেল শিপ্রা, জন্ম নিল সোনালী রায়। মাতিয়ে দিল কলকাতা ও আশেপাশের অস্থায়ী স্টেজ, যা বাংলায় মাচা নামেই বেশি পরিচিত। নৃত্যশিল্পী পিতার সহজাত তালজ্ঞানে সমৃদ্ধ শিশুকন্যার তখন থেকেই স্টেজ পারফরম্যান্সের সূত্রপাত। নাচের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ এবং কিছুটা আর্থিক অসঙ্গতি ছেদ টেনে দেয় তাঁর পড়াশোনায়। দমদমের রত্নাগর বিদ্যামন্দিরের ক্লাস এইটের পড়ুয়া মহুয়ার স্কুলজীবনের সেখানেই ইতি।

সত্তরের দশকে মাত্র তেরো বছর বয়সে তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় শ্রীমান পৃথ্বীরাজ ছবিতে কিশোরী বধূর বেশে নাচের জগত থেকে সিনেমার জগতে পদার্পণ মহুয়ার। সুখেন দাসের প্রযোজনায় পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় “নয়া মিছিল’ ছবির জন্যে নায়িকার খোঁজ চলছে। জহুরি সুখেন দাসের খাঁটি সোনা চিনতে ভুল হয়নি। কিন্তু বিধি বাম। নির্দেশকের ওই চরিত্রের উপযুক্ত মনে হল না রোগাসোগা সোনালি কিংবা শিপ্রাকে। বাবার হতাশা দেখে ছোট হলেও অপমান বড় বেজেছিল। স্টুডিও চত্বর ছেড়ে ভগ্ন মনোরথ বাপ-মেয়ে  বাড়ির পথ ধরেছেন। পিছু ডাকলেন সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেকআপ-ম্যান জামালভাই।

রোগাসোগা চেহারার কারণে “নয়া মিছিল” ছবি থেকে বাদ পড়ার পর, সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেক-আপ ম্যান জামাল ভাইয়ের কাছে পাওয়া খবরই মহুয়ার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর আরও কিছু ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেলেও খ্যাতি সেরকম আসেনি। খবর পাওয়া গেল তরুণ মজুমদার তাঁর আগামী ছবির জন্যে অল্পবয়সী নতুন মুখ খুঁজছেন। আবার আশার আলো। কনেবউ সেজে সন্ধ্যা রায়, তরুণ মজুমদারের সামনে দাঁড়াল সদ্য কৈশোর-পাওয়া শিপ্রা ওরফে সোনালি। মাত্র তেরো বছর বয়স। নামকরণের তখনও কিছু বাকি ছিল। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এর বউ থেকে প্রেয়সী হবার যাত্রা শুরু হল নতুন নামে।

কাঁচামাটির তাল নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায়। অস্থায়ী স্টেজের অখ্যাত এক রোগাসোগা শিশুশিল্পীকে অপত্য স্নেহে অভিনয়ের পাঠ থেকে শারীরিক যত্নে লালন করা। তবু আজ অনায়াসে বলেন, ওকে কিছু শেখাতে হয়নি। আমি শুধু পড়ে দিলাম। বাকিটুকু ও নিজেই তরতর করে বলে গেল। নাচ, অভিনয়, সবই ছিল ওর জন্মগত প্রাপ্তি। দুরন্ত, চঞ্চল তেরো বছরের বালিকা যখন পার্ট বুঝত, চরিত্র শুনত, তখন একবারে স্থির এবং আত্মমগ্ন। তাঁর ভাষায় মহুয়া এক ‘লিটল গ্লোরিয়াস টুইলাইট’।

মাধবী চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর মাধুমা। ভাত না খেয়ে কাজে বেরোতে পারত না। দূর দমদম থেকে ভোরের কল টাইমে হাজির হতে হলে, নির্দ্বিধায় থেকে যেত মাধুমার কাছে। “সকাল সকাল দুটো ভাত রান্না করে দিতাম। খেয়ে বেরোত। আমারও শান্তি হত”, সেকালের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না নায়িকা ঘরোয়া মা-মাসির মতোই অপার স্নেহমাখা মুখে বললেন।

বলতে বলতে বিষণ্ণতার আকুল করা ব্যথা চারিয়ে উঠল। টলটলে চোখে বললেন, “সাবুর মতো অভিনয়ের ধরন ছিল। অমনি স্বচ্ছন্দ, অমনি আন্তরিক। ও চলে যাবার পর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিল। সেটা তপন সিনহার কাছেই রয়ে গেল। ওর বাড়ির কেউ ওর হয়ে নিতেও আসেনি। অভিমান, অবহেলা নাকি আশঙ্কা? কেউ জানি না।”

এর কয়েক বছর পর, তরুণবাবুর ছবি “দাদার কীর্তি” (১৯৮০) তাঁকে এনে দিয়েছিল খ্যাতি, প্রতিপত্তি। প্রায় ৫০ সপ্তাহেরও বেশি চলা মহুয়া-তাপস পাল অভিনীত এই ছবি বাংলা সিনেমা জগতকেও সমৃদ্ধ করেছিল। তরুণবাবুই সোনালী নাম বদলে রাখেন মহুয়া। সার্থক ছিল সে নামকরণ। আজও আপামর বাঙালি মহুয়ায় মাতাল।

সন্ধ্যা রায়, মাধুমা’র (মাধবী মুখোপাধ্যায়) তালিমে মহুয়াকে দাদার কীর্তি’র পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মুক্তি পেয়েছে একের পর এক ব্লকবাস্টার ছবি। ১৯৮৩ তে মুক্তি পাওয়া “লাল গোলাপ” প্রায় একা হাতেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল বাংলা সিনেমার মোড়। ঠিক পরের বছরই মুক্তি পেল অঞ্জন চৌধুরীর ছবি “শত্রু”। মারকাটারি হিট। ছয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছবিটির মোট আয় ছিল নব্বই লক্ষ। তৎকালীন বাংলা সিনেমার ‘গুরু’ উত্তম কুমারের সাথেও মহুয়া কাজ করেন “সেই চোখ” এবং “বাঘবন্দী খেলা” ছবিতে।

অভিনয় জীবনের প্রথম পর্বে, ১৯৭৬-এর ২ মে, বাবার মতের বিরুদ্ধে মহুয়া গাঁট ছড়া বাঁধেন বাল্যবন্ধু, ব্যাঙ্কে কর্মরত কিশোরকণ্ঠী তিলক চক্রবর্তীর সাথে, যিনি নিজেও স্বপ্ন দেখতেন অভিনেতা হবার। তিলকের দাদা অলোক চক্রবর্তী দুজনকে নিয়ে প্রযোজনা করেন “আনন্দমেলা” ছবিটি, কিন্তু তা সফল হয়নি। অবশ্য তাতে অল্পবয়সী এই দম্পতির সংসার জীবনে প্রেমের ঘাটতি হয়নি। বেপরোয়া প্রেমে মাঝরাতে বাইক ভ্রমণ, মদ্যপান, সে যেন এক ফুর্তির ফোয়ারা।

শেষ ছবি বীরেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আশীর্বাদ’। চিত্রগ্রাহক শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যামেরা বন্দি করলেন মহুয়ার শেষ শট। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফোনে বলছে, “আমি ভাল নেই, আমি ভাল নেই। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। সে কি শুধু অভিনয় ছিল?”

সেই মৃত্যুকে ঘিরে জমাট বাঁধতে থাকে রহস্য। হত্যা, না আত্মহত্যা? নাকি নিছকই দুর্ঘটনা? পুলিশের কাছে দেওয়া তিলকের জবানবন্দি অনুযায়ী, সেটি ছিল দুর্ঘটনা। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, স্টোভ ফেটে দুর্ঘটনার কথা বলা হলেও, সেই স্টোভে কোনও কেরোসিন ছিল না। স্টোভটিও ছিল অক্ষত। অথচ চিকিৎসকের দাবি, হাসপাতালে নিয়ে আসার সময় মহুয়ার শরীরে ছিল ভরপুর কেরোসিনের গন্ধ। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে যায় মৃত্যুর কারণ নিয়ে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট উল্লেখ করে, মহুয়ার চোখের কোণে ছিল কালশিটের দাগ। আবার তিলকের পায়ের গোড়ালিতে ছিল মচকানোর দাগ। তিলক অবশ্য তাঁর বয়ানে বলেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়েই পায়ে চোট লাগে তাঁর।

মহুয়ার বাবাও একই বাড়িতে থাকতেন মেয়ে-জামাইয়ের সাথে। মহুয়ার ম্যানেজার ছিলেন তিনি। টাকা পয়সার হিসেব রাখতেন। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, তিলক এবং নীলাঞ্জনের সাথে মহুয়ার যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো তাঁর মৃত্যুর ঠিক চার দিন আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতি সাধারণ ব্যাঙ্ক কর্মচারী তিলক এবং ব্যর্থ অভিনেতা নীলাঞ্জনের, মহুয়ার টাকা থেকে লাভের সম্ভাবনা থেকেই যায়, আর তাই এই মৃত্যুর পিছনে খুনের মোটিভ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়নি।

মহুয়ার মৃত্যু নিয়ে  সন্দেহ আছে আজও। মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নেন এন সি বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেণ্ট পুলিশ, সিআইডি এবং ইন্সপেক্টর এ এন  দুবে। সাক্ষী হিসেবে সই করেন দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী এবং সিস্টার ঊষা। উপস্থিত ছিলেন রত্না ঘোষাল। বহু সংশয়ের নিষ্পত্তি আজও হয়নি। সেই সময়কার সংবাদমাধ্যমে ধরা আছে অগুনতি পরস্পরবিরোধী তথ্য।

আত্মহত্যার সম্ভাবনাও পুলিশকে ধন্দে ফেলে দেয়, কারণ এর আগেও মহুয়া একবার সেই চেষ্টা করেছিলেন। এও জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগছিলেন। তাঁর মনে হতে থাকে, তিনি নীলাঞ্জনের  “মানি মেকিং মেশিন মাত্র । না তাকে ভালোবাসে স্বামী তিলক,  না স্নেহ দেন বাবা নীলাঞ্জন। এমনকি স্টুডিও পাড়ার বহু পুরুষের কাছে ভালোবাসা চেয়ে শুধু প্রতারিতই হয়েছেন। এবং সেই থেকেই আসে সুরাসক্তি, যা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর সুস্থ জীবনের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু কেন এই অবসাদ ? কেন আশ্রয়হীনতার ভীতি ? বঞ্চিত ছেলেবেলার যন্ত্রণাবোধ, শৈশবে বিকৃত লালসার শিকার হওয়া সংবেদনশীল রক্তাক্ত মন, তীব্র আবেগের ভার, ঈপ্সিত আশ্রয়ের বাসনা, অতি সাধারণ পরিবার থেকে হঠাৎ পাওয়া যশ-প্রতিপত্তি, বাবা এবং স্বামীর সাথে প্রত্যহিক বোঝাপড়ার অভাব, নাকি অসংযমী জীবনযাপন ? এ সব প্রশ্নের উত্তর সেদিন ৭৭২ নম্বর ঘরের বেডে পড়ে থাকা ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহটির নিথর মন বা মস্তিষ্কের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। “আমার গোলা রইল, ওকে দেখিস”, যন্ত্রণাদগ্ধ কণ্ঠে প্রাণের বন্ধু অভিনেত্রী রত্না ঘোষালকে বলেছিলেন মহুয়া। তার কিছুক্ষণ পরেই সব শেষ। পুলিশের কাছে জবানবন্দিতেও একই কথা উল্লেখ করেন রত্না ।

মাঝরাত অতিক্রান্ত। বাড়িতে দু’জন পরিচারক। তবু মহুয়া নিজে খাবার বা দুধ গরম করতে গেল কেন ? তিলক কিন্তু ডিনারের পরেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল। মহুয়ার কথামতো তাঁর অসাবধানতাবশত যদি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে বাড়িতে চারজন মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও কী করে এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছিল ?

স্টোভ বার্স্টের একটা তত্ত্ব পরিবারের পক্ষ থেকে বার বার খাড়া করা হয়েছে। পুলিশ কেরোসিন ছাড়া  একটি স্টোভ রান্নাঘর থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে, যেটা কোনওভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

পিঠে এবং শরীরের আরও কয়েক জায়গায় কালশিটের দাগ পাওয়া যায়, যার কোনও সদুত্তর মেলেনি। মহুয়ার মুখের ডান দিকে একটা ক্ষতচিহ্নের বিচিত্র ব্যাখ্যা মেলে বাবার কাছে। কোনও কাপড়ের টুকরো আটকে যায় দুর্ঘটনার সময়, যেটা টেনে তুলতে গেলে মহুয়া ব্লেড দিয়ে কেটে নিতে বলে আর তাতেই নাকি এই বিপত্তি। প্রায় সত্তরভাগ অগ্নিদগ্ধ মানুষের পক্ষে এ কি সম্ভব ?রান্নঘর এক রকম অক্ষত। অথচ শোবার ঘরে লেপ তোষক মায় বালিশ পর্যন্ত পোড়া। নাইটি এবং বিছানায় এত কেরোসিনের গন্ধ কোথা থেকে এসেছিল? স্টোভ বার্স্ট করলে পিঠ, তলপেট, ঊরু এমন ভয়াবহ দগ্ধ কেন? নীলাঞ্জনের মাত্র তিনটি আঙুলের ডগায় সামান্য চোট ছিল। তিলক অক্ষত। শুধুমাত্র খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, অমন মারাত্মক আগুন থেকে বাঁচাতে গেলে এ এক রকম অসম্ভব। পরিবারের তরফ থেকে কোনও এফআইআর করা হয়নি। শোনা যায়, তদন্ত চলার কিছুদিনের মধ্যে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধের নির্দেশ আসে। কিন্তু কেন ? আজও জানা নেই তা’ও ।

দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করে বৃত্ত যখন সম্পূর্ণ করল, তত দিনে শুধুমাত্র চন্দ্রাভ সে মুখের স্মৃতিভারটুকু রেখে পুরস্কারের পাশে ‘মরণোত্তর’ কথাটুকু বসিয়ে দিয়ে মহুয়া চলে গেছে চিরকালের মতো। সব মায়ার ও পারে। 

আত্মহত্যা নাকি হত্যা ? মহুয়ার মধুমা মাধবী চক্রবর্তীর সাফ কথা, “সত্যি নাকি মিথ্যে সেটা বলতে পারব না। তবে আমাকে এক পুলিশ অফিসার তদন্ত করে বলেছিলেন, ওর মুখে টেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় গায়ে।” ব্যক্তিগতভাবে মাধবী চক্রবর্তী জানান, মহুয়ার মৃত্যুর অনতিকাল পরে তাঁর বাবা স্মরণসভা আয়োজন করবার প্রস্তাব নিয়ে  তাঁর কাছে আসেন। মৃত্যুর যথোচিত কারণ না জানা পর্যন্ত এ ধরনের কোনও সভায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন না বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

দশ বছর পর প্রদেশ মহিলা কংগ্রেস আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারীদিবস উপলক্ষে মাধবী চক্রবর্তী তাঁর ভাষণে মহুয়া রায়চৌধুরীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ তোলেন। শোনা যায়,  বারো জুলাই রাতে অঞ্জন চৌধুরীর বাড়ি থেকে আকন্ঠ মদ্যপান করে আসার পর বাড়ির শোবার ঘরে মদের বোতল নিয়ে বসেন। এই সময় নীলাঞ্জনের সঙ্গে তাঁর টাকা-পয়সা নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায়। নীলাঞ্জনও মদ্যপান করে ছিলেন। অভিযোগ, তখনই মহুয়াকে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারেন নীলাঞ্জন। তাই স্টোভ বার্স্ট করলেও তা ছিল অক্ষত।। স্টোভে কেরোসিন তেল ছিল না। রান্নাঘরে বিস্কোরণ হলেও সেখানে তার চিহ্ন ছিল না। বরং শোবার ঘরের বিছানায় তোষক ছিল পোড়া। ঘর জুড়ে ছিল কেরোসিনের গন্ধ ।

৩ জুলাইয়ের পর বাংলাদেশ চলে যাওয়ার কথা। মমতাজ আলমের ‘ঊশীলা’ ছবির নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবার আয়োজন সম্পূর্ণ। অপেক্ষা শুধু ভিসা পাওয়ার। তবে মহুয়ার প্রিয় বান্ধবী অভিনেত্রী রত্না ঘোষাল বলছেন, এটি খুন নয়। আত্মহত্যা। তাঁর কথায়, “গায়ে আগুন লাগার দিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মৌ আমার বাড়িতে ছিল। খুব ছোট ব্যাপারে এত বড় ঘটনা ঘটেছিল বলে আমার মনে হয়।” তাঁর যুক্তি, “মহুয়া বাংলাদেশের নামী নায়িকা হতে চাইছিল। বাংলাদেশের হাই কমিশনার আমাকে স্নেহ করতেন। ‘নহবত’ নাটক করে আমার নাম হয়েছিল বাংলাদেশে। মহুয়ার ভিসার জন্য বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থার থেকে একটা চিঠি দরকার ছিল। সেটা আসতে দেরি হচ্ছিল। মহুয়া আমাকে বলে, হাই কমিশনার ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেতে হলে, চিঠিটা লাগবেই। আমি মৌকে বলি, একটু অপেক্ষা কর তুই। কিন্তু মৌ খুব জেদি ছিল। ওর কোনও কিছু চাই মানে সঙ্গে-সঙ্গে চাই। আমার সঙ্গে সেদিন বিকেলে এটা নিয়ে কথা হওয়ার পর বাড়ি ফিরে যায়। আমি নাটক করতে চলে যাই। ওর টেনশন হলেই অসম্ভব মদ খেত। একটা বাজে স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ফিরে অঞ্জন চৌধুরীর ফ্ল্যাটে যায়। সেখানে মদ খায়। নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আরও মদ খায়। মাথার ঠিক ছিল না। নিজেই গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।”

মহুয়া যাঁকে মায়ের মতো মনে করতেন, সেই মাধবীর বিশ্বাস, “মহুয়ার পরিবারের মধ্যেই ছিল তাঁর শত্রু। স্বামী নাকি শ্বশুরবাড়ির অন্য কেউ ? স্বামী নির্দোষ। শ্বশুর এবং আর এক জন। মহুয়া কাকা বলে ডাকত। তাই মনে হয়। তবে ভুল হতে পারি”, বলছেন মাধবী। অনেকের ধারণা, মহুয়া আত্মহত্যা করেছিলেন। তা শুনে মাধবীর প্রতিক্রিয়া, “আত্মহত্যা হলে গায়ে আগুন লাগাবে সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে লাগাবে না। আমাদের কারও দশটা হাত নেই।”

মহুয়ার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বয়ান, তুলে রাখা তদন্ত, সবই এই মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনারই তকমা দিয়েছে। পরে মিডিয়ার চাপে নতুন করে তদন্ত শুরু হলেও তার ফরেনসিক রিপোর্ট অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে।

সত্য একটাই। আপন মহিমা নিয়ে সেদিন নায়িকা হয়েও কোথাও যেন পাশের বাড়ির মেয়েটির মতো আপন ছিল মহুয়া। চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে, সে স্থান আজও অটুট। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই গেছে মহুয়ার মৃত্যু, আত্মহত্যা না হত্যা ? উত্তরটা আজও রহস্য।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img