হোমআজকের সেরা খবরCRIME REPORTER : পরাধীন দেশে বিপ্লবী, স্বাধীন ভারতে দুর্ধর্ষ ডাকাত

CRIME REPORTER : পরাধীন দেশে বিপ্লবী, স্বাধীন ভারতে দুর্ধর্ষ ডাকাত

CRIME REPORTER : পরাধীন দেশে বিপ্লবী, স্বাধীন ভারতে দুর্ধর্ষ ডাকাত

(CRIME REPORTER: এই পর্বে শোনানো  হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সি গুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর :  সালটা ১৯৬০। জুলাই  মাস। সকাল ন’টা সবে পেরিয়েছে। পার্ক  স্ট্রিট পোস্ট আপিসের সামনের রাস্তার ভিড়ে ব্যস্ততা বেড়েছে। হঠৎই কালো মাঙ্কি ক্যাপ পরা কয়েকটা লোক হুড়মুড় করে চুকে গেল পোস্ট অফিসের ভিতরে। ভিতরে ঢুকেই জামার ভিতর থেকে বের করল রিভলবার। ওদের মধ্যে একজন চলে গেল পোস্টমাস্টারের দিকে। অন্য জন সোজা রিভলবার ধরল ক্যাশিয়ারের মাথায়। গ্রাহকরা আঁতকে উঠলেন। কেউ কেউ কেঁদে ফেললেন। যিনি ক্যাশিয়ারের মাথায় রিভলবার ধরেছিলেন এবার শোনা গেল তাঁর বাঁজখাই গলা। সকলকে আশ্বস্ত করে শান্ত হতে বললেন । বললেন, কারো কোনও ক্ষতি হবে না। শুধু ওদের অপারেশনটা সাকসেসফুল হলেই চলবে। মানুষটির বাঁজখাই গলা একটু বৃদ্ধদের মতো শোনাচ্ছে না ? এর জবাব মিলেছে কয়েক বছর পর ।

ব্রিটিশ যুগে এই বাঁজখাই গলা সূর্য সেনের সঙ্গী। আবার ষাটের দশকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন কলকাতা পুলিশকে। তাই আজও তাঁর পরিচিতি কোথাও বিপ্লবী হিসেবে, কারও কাছে তিনি ডাকাত। তিনি অনন্ত সিংহ ।

পড়াশোনার থেকে খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় বেশি আগ্রহ ছিল ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলের। চট্টগ্রামে  মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ার সময় নজরে আসেন সূর্য সেনের। মাস্টারদা চিনেছিলেন আগুনকে। বুঝেছিলেন গড়ে নিলে ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নেবে। হয়েওছিল তাই। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন দিয়ে অনন্ত সিংয়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু। মনে প্রাণে মানতেন শুধু প্রতিবাদে নয়, পাল্টা মার দিতে হবে। প্রথম রণে নামেন ১৪ ডিসেম্বর ১৯২৩-এ।

ওই দিন দিনের বেলায় ট্রেজারি থেকে আসাম বেঙ্গল রেল কোম্পানির মাইনে নিয়ে যাবার সময় আরও তিন সহযোগীর সঙ্গে লুঠ করেন সেই টাকা। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান সনদ্বীপে, সেখান থেকে কলকাতা। পরে ধরা পড়ে চার বছর জেল হয়। মুক্তি পাওয়ার পর চট্টগ্রামে ফিরে কুস্তির আখড়া খোলেন। সেখানে কুস্তির আড়ালে স্থানীয় যুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন স্বয়ং সূর্য সেন। ১৮ এপ্রিল,১৯৩০। মাস্টারদার পরিকল্পনায় চট্টগ্রামে শুরু হলো যুব বিদ্রোহ। শহরের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোতে একসঙ্গে আক্রমণ করে একদল যুবক। অস্ত্রাগার লুঠ করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন হিমাংশু সেন। আগুন জ্বালাতে গিয়ে নিজের গায়েই আগুন ধরে যায়। হিমাংশুকে শহরের দিকে নিয়ে যাবার সময় এক মারাত্মক অ্যাকশন হয় পুলিশের সঙ্গে। ফেণী স্টেশনে অনন্ত মুখোমুখি হন পুলিশের। দুই হাতে রিভলবার চালিয়ে পুলিশের জালে কেটে বেরিয়ে যান। ২৮শে জুন, ১৯৩০। হঠাৎ কলকাতা পুলিশ কমিশনারের দফতরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন অনন্ত। ঘটে যায় সেই আশ্চর্য ঘটনা। গোয়েন্দা প্রধান লোম্যানকে এই আত্মসমর্পণের কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন।

‘প্রিয় মিঃ লোম্যান,
১৯৩০ সালের ২৮শে জুন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। আমি নিশ্চিন্ত যে, আমাকে গ্রেফতার করার সে সুযোগ তুমি হারাবে না। আমি তার জন্য প্রস্তুত। মনে কর না যে, আমি আত্মসমর্পণ করছি। লোকে কখন আত্মসমর্পণ করে? যখন সে একান্ত অসহায় বা আত্মরক্ষার কোন পথ পায় না, তখনই সে নত হয়।

আমি কি এখন অসহায়? না, কখনোই না। আমার আত্মরক্ষার অস্ত্র আছে, খরচ করার মতো প্রচুর অর্থ আছে, সহায়তা করার মতো লোকও আছে। বাংলা, বাংলার বাইরে বা ভারতের বাইরে থাকবার মতো আশ্রয়ও আছে। তবুও যে ধরা দিচ্ছি, তার কারণ কি? তুমি কি ভেবেছ আমার কাজের জন্য আমি অনুতপ্ত? না, কখনোই না। আমি একবিন্দু দুঃখিত নই। তবে কি উপর থেকে আমার ওপর কোন আদেশ এসেছে? না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং সম্পূর্ণ গোপনীয়।

বিদ্রোহী অনন্তলাল সিংহ

বলা হয়, জেলবন্দি চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার বন্ধ করতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল। কলকাতা পুলিশের দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, বিপ্লবীর শর্তই ছিল অস্ত্রাগার লুন্ঠনে ধৃত বিপ্লবীদের ফাঁসি দেওয়া যাবে না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে আন্দামানে যান অনন্ত। বন্দিদের সাথে নিকৃষ্টতম আচরণের জন্য জেলে গণ অনশনে সামিল হন।

১৯৩০, ২৮ জুন, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বিচারে যাবজ্জীবন। ১৯৩৭ সালের শেষদিকে অনশন করার পরে আন্দামান থেকে বাংলার আলিপুর জেলে আসেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অনন্তলাল সিংহ। দমদম ও আলিপুর জেলে তখন কম করে ৫০/৬০ জন বিপ্লবী রাজবন্দি হয়ে আছেন। অনন্ত সিংহ যখন আলিপুর জেলে, তখন সুভাষচন্দ্র বসু আসেন দেখা করতে, এই নিয়ে চতুর্থবার দেখা সাক্ষাৎ হয় তাঁদের। প্রত্যেকের সাথে দেখা করে সুভাষচন্দ্র বসু এক জোড়ালো বক্তৃতা দিয়ে বিপ্লবীদের মানসিক জোর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৩৮ সাল। সেইসময় একদিকে কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু, অন্যদিকে বাংলায় তখন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে ফজলুক হক-সুরাবর্দীর শাসনভার চলছে। পরিবেশ সম্পূর্ণ পক্ষে, এই চিন্তা করে অনন্ত সিংহ সহ রাজবন্দীরা মুক্তির জন্য আন্দোলন রূপে অনশন করে ইংরেজ সরকারের উপর চাপ বাড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। খবর গেল গান্ধীজির কাছে। সুভাষচন্দ্র বসু ও গান্ধীজি রাজবন্দিদের সাথে দেখা করতে আসেন, যদিও বিপ্লবী বন্দিদের সাথে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয় শুধু গান্ধীকে।

জেলের ভেতরে রাজবন্দিদের সাথে কথা বলে, রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে গান্ধীজী এক বছরের জন্য সময় চান। রাজবন্দিরা প্রথমে রাজি না হলেও পরে এই প্রস্তাব মেনে নেন। কিন্তু দিন যায়, মাস যায় রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। এইভাবে প্রায় এক বছর কেটে যায়। হতাশ রাজবন্দি বিপ্লবীরা মুক্তির জন্য আবার অনশন করার সিদ্ধান্ত নেন। বিপ্লবীরা সরকারকে চরম পত্র দিলেন, সেইসঙ্গে জানানো হ’ল গান্ধীকেও। ১৯৩৯ সাল, এইসময় দেশের রাজনীতিতে একরকম বেইমান ও ধোঁকাবাজির রাজ শুরু হচ্ছে। বিপ্লবীদের চরম পত্রের পরেও, না ব্রিটিশ সরকার, না গান্ধী – কারো কোনও হেলদোল নেই, ফলে শুরু হ’ল অনশন।

বিপ্লবীদের অনশনের খবর চারিদিক ছড়িয়ে পড়লো। এবার গান্ধী তাঁর দূত পাঠালেন বিপ্লবীদের কাছে। গান্ধীর সেক্রেটারী মহাদেব দেশাই, বিধান রায় ও সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ জেলে গিয়ে অনন্ত সিংহদের সাথে দেখা করে জানান, গান্ধীজি অনশন বন্ধ করতে বলেছেন। কিন্তু মুক্তির ব্যাপারে কোনও আশ্বাস নেই, তাই এবারে বিপ্লবীরা গান্ধীর দূতদের সরাসরি ‘না’ বলে দিলেন। জানালেন,গান্ধীজির কথামত অনশন বন্ধ হবে না। তাঁর নির্দেশ অমান্য করেছে! তাই গান্ধী অনন্ত সিংহ সহ বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে খবরের কাগজে এক মারাত্মক ক্ষতিকর বিবৃতি দিয়েদিলেন। এই ঘটনায় বিপ্লবীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও অনশন চলতে থাকল।

বেশ কিছুদিন অনশন চলার পরে অনেক বিপ্লবীই অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। এই খবর পেয়ে বসে থাকতে পারলেন না শুধু দুজন। সেই সময় সুভাষচন্দ্র বসু শারীরিকভাবে বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন এবং রাজনৈতিকভাবে পদত্যাগ করেছেন কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে। তবু তিনি ও মেজদা শরৎচন্দ্র বসু ছুটে গেলেন দমদম ও আলিপুর জেলে। সুভাষচন্দ্রের সাথে অনন্ত সিংহের সেখানে দেখা হয় পঞ্চমবার। প্রথমবার দেখা হয় ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসে, ১৯২৯ সালে দুবার চট্টগ্রামে, এবং ১৯৩৭ সালে চতুর্থবার আলিপুর জেলেই। অনন্ত সিংহের কথায়, সুভাষবাবু খুব উৎকন্ঠা নিয়ে হাতজোড় করে বারে বারে আমাদেরকে বলেছিলেন, “হয়তো এখনই ইংরেজ সরকার আপনাদের মুক্তি দেবে না, তবে মুক্তি খুব তাড়াতাড়ি একদিন হবেই। আমরা স্বাধীনতার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে, এবারে এক চরম আন্দোলন শুরু হবে। আপনারা অনশনের সিদ্ধান্ত নেবেন না, ভারত মায়ের পরবর্তী মুক্তি আন্দোলনে আপনাদের সকলকে দেশের প্রয়োজন”…

সুভাষচন্দ্র বসু তখন কোনও প্রতিশ্রুতি বিপ্লবীদের দিতে পারেননি, তিনি রাজনৈতিক ভাবে কোনও পদে নেই, প্রতিশ্রুতি দেবার মতো সেই পরিস্থিতিও ছিল না। তবু অনন্ত সিংহ সহ সব বিপ্লবীই অনশন তুলে নিলেন। কেন তাঁরা অনশন বন্ধ করলেন? অনন্ত সিংহ বলেছেন, “সে এক দুর্বার আকর্ষণ, অসুস্থ দুর্বল শরীরেও এক অমিত শক্তিশালী ক্ষমতা, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় এমনি। তাঁর সম্মোহন শক্তি এড়াবে কার সাধ্যি!”

শেষপর্যন্ত অনন্ত সিংহ ব্রিটিশ জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। সেলুলার জেল বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৩৮ সালে দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে আলিপুর জেলে বন্দি করে রাখা হয়। জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি মার্কসবাদী দর্শন পাঠ করে আকৃষ্ট হন এবং  বাইরে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে।

দেশ স্বাধীন হবার পর নিজেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির থেকে দূরে রাখেন। কিছুদিন তিনি চলচ্চিত্র ও মোটর গাড়ির ব্যবসা করেন। তাঁর প্রযোজিত অন্যতম চলচ্চিত্র ভানু বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত  “যমালয়ে জীবন্ত মানুষ”। এইসময় ১৯৪৬ সালেই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম এই বিপ্লবীর সাথে আর একজনের আলাপ হয়েছিল, তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আদর্শ, কর্মকাণ্ড গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে, সখ্যতা গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে। অনন্ত সিংহ পরে তাঁর বেশ কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছাড়াও ছিল  ‘সখের চোর’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘শেষ পরিচয়’ ইত্যাদি। এর মধ্যে কয়েকটি ছবিতে শুধুমাত্র অনন্ত সিংহের সম্মানে বিনা পারিশ্রমিকেও কাজ করে দিয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনন্ত সিংহ নিজেও অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ভানুর সম্পর্কে। বলতেন, ‘ছায়াছবির মাধ্যমে সামাজিক দুষ্কর্ম, সরকারের অক্ষমতা ও তথাকথিত নেতাদের প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর শ্লেষপূর্ণ ও বিদ্রুপাত্মক অভিনয় যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলবেন, ভানুবাবুর অন্তরে দেশপ্রেমের আগুন প্রজ্জ্বলিত আছে।’

নকশাল আন্দোলন শুরু হবার ঠিক আগে কলকাতায় একটি রাজনৈতিক  দলের উত্থান হয়। ষাটের দশকের শুরুতে এমএমজি বা ম্যান-মানি-গান নামক নকশালপন্থী বিপ্লবী গ্রুপ তৈরি করেছিলেন তিন। এই সময় কলকাতায় একের পর এক ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়।

১৯৬৮ সালের পয়লা জুলাই পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে হানা দেয় অনন্তের বিশাল দল। ৩.৯৭ লক্ষ টাকা ডাকাতি করেন তাঁরা। এরপরের নয় মাসে আরও তিনটি বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে ওই দল। এর মধ্যে দুটি ছিল আলিপুরের ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিন্ডলেজ ব্র্যাঞ্চ। অপরটি ছিল এসবিআইয়ের পার্কস্ট্রিট শাখা। লুঠ করে ১২ লক্ষ টাকা।

তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান দেবী রায় আবিষ্কার করেন এর পেছনে রয়েছে অনন্ত সিংয়ের মাস্টার মাইন্ড। তিনি রেভ্যুলেশনারি কম্যুনিস্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’র জন্য আন্দোলনের টাকা জোগাড় করছিলেন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। অবশ্য ততদিনে ফের গা ঢাকা দিয়েছেন চট্টগ্রাম হামলার বিপ্লবী। পুলিশের খাতায় সূর্য সেনের দীক্ষিত  সেই বিপ্লবীই হয়ে গেলেন ডাকাত। ১৯৬০ সাল থেকে কলকাতায় ধারাবাহিক ব্যাঙ্ক ডাকাতির অভিযোগে তাঁকে ঘটনার প্রায় দশ বছর পরে ১৯৭০ সালের ১০ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডের যাদুগোড়া থেকে গ্রেফতার  করা হয় । গড়িয়া’য় সম্পর্কে তাঁর কাকাবাবুর বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁর বেশ কিছু অনুগামী।

তাঁর মতো বিপ্লবীর এহেন কাজ অনেককেই ব্যথিত করেছিল। সেসময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এক সাংবাদিক অনন্ত সিংহকে ডাকাত বললে তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে গালাগাল দিয়ে সেই সাংবাদিককে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ডাকাতি কাণ্ডে জেল খেটেছিলেন – এটা ইতিহাস সত্য। কিন্তু কেন তিনি এই কাজ করেছিলেন, তা অনেকেই বোঝার চেষ্টা করেন না। ১৯৫৯ সালে খাদ্য-আন্দোলনে অসংখ্য অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে অনন্ত সিংহ সংগঠন গড়ে দরিদ্র দেশের মানুষের সেবা করার কাজ শুরু করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজে একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে গেছিলেন। তিনি দেখলেন দেশে একদলের কাছে শুধু টাকা আর টাকা, অন্যদিকে একদল প্রায় খেতেই পায় না, অথচ স্বাধীন দেশের সরকার কোনও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। স্বাধীন দেশেই অসহায় মানুষ শুধু না খেতে পেয়ে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে – এই স্বাধীনতা তাঁরা চাননি বলেই অনন্ত সিংহের মনে হয়েছিল। কিন্তু সময় তখন অনেক দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। নতুন ভাবে সংগঠন তৈরি করে দরিদ্র মানুষের দুঃখ দূর করার সঙ্কল্প নিয়েই তিনি ব্যাঙ্ক ডাকাতির রাস্তায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনন্ত সিংহের নিজের কথায়, ‘তবু অপরাধ তো অপরাধই হয়, সে যে জন্যেই হোক, কারণটা কেউই বুঝবে না।’

ডাকাতির অপরাধে অনন্ত সিংহ তখন স্বাধীন দেশের আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। সেইসময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে বাসবী দেবীর বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। মেয়ের বিয়ের ভোজ নিজের হাতে জেলবন্দি অনন্ত সিংহের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ভানু।

প্রায় আট বছর মামলা চলেছিল। তাঁকে আট বছর (১৯৬৯ – ১৯৭৭) জেলে থাকতে হয়। শেষ জীবনে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হয়ে উঠে  ছিলেন। বিচারে বুড়ো ডাকাত বিপ্লবীর দশ বছরের কারাদণ্ড হয়, কিন্তু জেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯৭৭ সালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাসখানেক পরেই মারা যান বিতর্কিত বিপ্লবী। ১৯৭৯ সালের ২৫শে জানুয়ারিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্য হয় তাঁর । অবাক লাগে দেশ স্বাধীন হবার আগে ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের শিষ্য । বিপ্লবী । স্থাধীন ভারতে তিনিই হয়ে গেলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত। পুলিশের মাথাব্যথার কারণ ।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img