হোমআজকের সেরা খবর"র"-এর গুপ্তচর, ভারতীয় মেজরের মা, তিনিই পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারের পুত্রবধূ

“র”-এর গুপ্তচর, ভারতীয় মেজরের মা, তিনিই পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারের পুত্রবধূ

“র”-এর গুপ্তচর, ভারতীয় মেজরের মা, তিনিই পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারের পুত্রবধূ

(CRIME REPORTER: এই পর্বে শোনানো  হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : বোরখায় ঢাকা মুখ, হাতে বন্দুক। তিনি কাশ্মীরের কন্যা। বাবা মুসলিম ব্যবসায়ী। মা হিন্দু রমণী। তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ারের পুত্রবধূ। পাকিস্তানের মেজরের স্ত্রী । আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজরের মা। কি আজব ব্যাপার না! আসলে তিনি ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ আন্ড আনালিটিক্যালস উইং বা “র”-এর এজেন্ট ।

ভারতের যুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে উঠে আসবে এমন  অনেক অজানা নাম। যারা খুব পরিচিত না হলেও দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তেমনই একজন কাশ্মীরের এই সেহমত। আবেগের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশকেই আগে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য কাজ করেছিলেন কাশ্মীরের এই গুপ্তচর।

একাত্তরের যুদ্ধের সময় দেশের গর্ব ছিল ভারতীয় নৌসেনার জাহাজ আইএনএস বিরাট । সেহমত “র”কে  জানান, আইএনএস বিরাটকে পাকিস্তান ডুবিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে, যা দেশের সুরক্ষার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। সেনা অফিসারের স্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের সেনা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নাতি নাতনিদের পড়াতে যেতেন সেহমত। আর পাশাপাশি চালাতেন তাঁর গুপ্তচরবৃত্তির কাজ।

“শ্রীনগরের প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে এখানে থাকেন কেন?” প্রশ্ন শুনে কিছু ক্ষণের নীরবতা। তার পর উত্তর এল, “এই গ্রামে আব্দুল থাকত।” প্রশ্নকর্তা জানতে চেয়েছিলেন, কী পরিণতি হয়েছিল আব্দুলের। উল্টো দিক থেকে উত্তর এসেছিল, আব্দুল মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর কারণও জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ বার জবাব এসেছিল, “আমি তাঁকে ট্রাকের চাকায় পিষে মেরে ফেলেছি।”

যিনি এই উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি মাঝবয়সী কাশ্মীরি। পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ, শিফনের ওড়না। দু’চোখের অভিব্যক্তি বেশির ভাগ সময়ে ঢাকা থাকত কালো চশমার আড়ালে। নিহত আব্দুল ছিলেন পাকিস্তানে তাঁর শ্বশুরবাড়ির বিশ্বস্ত ও পুরনো পরিচারক।

বহু সাধ্যসাধনার পর ওই মধ্যবয়সিনীর বাড়িতে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন প্রশ্নকর্তা। ২০০০ সালের কোনও এক দিন পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত মালেরকোটলায় তাঁর বাড়ির দরজায় পৌঁছেছিলেন নৌসেনার প্রাক্তন আধিকারিক হরিন্দর সিক্কা। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য।

শুনে ওই পঞ্চাশোর্ধ্ব বিনীত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি চান না তাঁর অতীতের কথা আলোচনা করতে। প্রত্যাখ্যাত হরিন্দর ফিরে যাননি। সকাল ১০টা থেকে বিকেল অবধি একটি মাত্র জলের বোতল সম্বল করে বসেছিলেন তাঁর বন্ধ দরজার সামনে।

অবশেষে বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ আবার খুলে গিয়েছিল দরজা। এ বার মধ্যবয়সিনী বলেছিলেন, ‘প্লিজ কাম ইন।’ তার পর অনেক বার তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন হরিন্দর। কিন্তু কোনওবারই দীর্ঘক্ষণ কথা হয়নি। আলাপের সর্বোচ্চ মেয়াদ ছিল পাঁচ মিনিট।

ওই টুকরো আলাপ দিয়েই মালা গেঁথেছিলেন হরিন্দর। সেই মালা-ই রূপ পায় ‘কলিং সেহমত’ বইয়ে। যে বই আবার সেলুলয়েড বন্দি হয় ‘রাজি’ নামে। যদিও আসল সেহমতকে (পরিবর্তিত নাম) কোনওদিন রাজি করানো যায়নি বাইরের দুনিয়ার সামনে তাঁর পরিচয় প্রকাশ করার জন্য।

সেহমতের সন্ধান হরিন্দর পেয়েছিলেন সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে। নৌসেনার লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার হরিন্দর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়েছিলেন নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেই। এর পর তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্তার পদে কর্মরত ছিলেন।

কার্গিল যুদ্ধের সময় তিনি সাংবাদিক সেজে পৌঁছেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। উদ্দেশ্য, গ্রাউন্ড জিরো থেকে যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করা। সেখানেই এক বার সেনা আধিকারিকদের সামনে মেজাজ হারিয়ে সিক্কা অভিযোগ করেছিলেন, ভারতীয় সেনার গাফিলতিতেই শত্রুপক্ষ ঘাঁটি দখল করতে পেরেছে।

তাঁর উষ্মার প্রতিবাদ করেছিলেন এক সেনা অফিসার। বলেছিলেন, “সবাই বিশ্বাসঘাতক হয় না, স্যর। আমার মা বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না।” এই দুটো লাইন, বিশেষ করে ‘আমার মা’ শব্দ দুটো তাড়া করে বেড়াচ্ছিল হরিন্দরকে। দিল্লি ফিরে এসেও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। আবার তিনি যান কাশ্মীর। খুঁজে বার করে ওই সেনা আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেন হরিন্দর।

কিন্তু তাঁর মায়ের কাছে পৌঁছতে আরও এক বছর সময় লেগেছিল। অবশেষে ঠিকানা যোগাড় করে মালেরকোটলায় সেহমতের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন হরিন্দর। তাঁর বক্তব্য শোনার পাশাপাশি গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। উদ্দেশ্য গোপন করে অতিথি হয়েছিলেন এক বিচারপতির কাছে। ফলে সহজেই পৌঁছতে পেরেছিলেন অভীষ্ট গন্তব্যে। সন্ধান নিতে পেরেছিলেন সেহমতের।

তা ছাড়া তিনি নিজে দীর্ঘদিন ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে। ফলে সব মিলিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মালেরকোটলার বাসিন্দা কাশ্মীরি মহিলা যা বলেছেন, তা ভুল বা মিথ্যে নয়।সত্যি-মিথ্যের হিসেব করেননি কুড়ি বছরের সেহমতও। যখন বাবার কথায় তিনি সম্মত হয়েছিলেন পড়শি অথচ শত্রুদেশের হাই প্রোফাইল সেনা আধিকারিকের বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে যেতে। সংসার করার জন্য নয়। বরং ‘হিন্দুস্তানের চোখ আর কান’ হয়ে থাকতে।

সেহমতের বাবা হিদায়েতুল্লাহ (পরিবর্তিত নাম) ছিলেন ব্যবসায়ী। তাঁর কারবার ছিল সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে। সে দেশের উচ্চমহলেও ছিল তাঁর অনায়াস গতি। অথচ ব্যবসার আড়ালে হিদায়েতও ছিলেন পড়শি দেশে তাঁর জন্মভূমির ‘চোখ’ এবং ‘কান’।

ভারতীয় গোয়েন্দাদের প্রাথমিক পর্যায়ের গুপ্তচর হিদায়েত প্রথম জীবনে সামিল হয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও। তাঁর অভিজ্ঞ নজর ষাটের দশকের শেষে বুঝেছিল, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবার অবশ্যম্ভাবী। এ যুদ্ধে তিনি নিজেও গুপ্তচর হিসেবে সক্রিয় থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। সেহমত তখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বাবার  ডাকে দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরলেন একমাত্র মেয়ে, সেহমত। তখনও জানতেন না আর ফিরে যাওয়া হবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে।

প্রেমিক অভিনব (নাম পরিবর্তিত) এবং ভবিষ্যতের সব রঙিন স্বপ্নকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে ফেলে রেখে সেহমত কাঁটাতার পেরিয়ে চলে গেলেন শ্বশুরবাড়ি। যাওয়ার আগে কঠোর অনুশীলন চলেছিল ‘র’-এর তত্ত্বাবধানে। মৃত্যুপথযাত্রী বাবার শেষ ইচ্ছের অমর্যাদা করতে পারেননি তাঁর একমাত্র মেয়ে, সেহমত।

আগ্নেয়াস্ত্র চালানো-সহ নিজেকে বাঁচানোর সবরকম উপায়ের পাশাপাশি তাঁকে শেখানো হল মর্স কোডিংয়ের খুঁটিনাটি, যাতে তিনি সাঙ্কেতিক ভাষায় তথ্য পাঠাতে পারেন। আবার, সাঙ্কেতিক ভাষায় তাঁকে পাঠানো তথ্যের পাঠোদ্ধার করতে পারেন।

সেই পাঠোদ্ধারের কাজের ফাঁকে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার শেখ সৈয়দের (পরিবর্তিত নাম) পরিবারেরও মন জয় করে নিলেন সেহমত। শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেক সদস্য সেহমতের গুণমুগ্ধ। শুধু তো শ্বশুর একা পাক সেনাবাহিনীর নন। সেহমতের স্বামী ইকবাল খান (পরিবর্তিত নাম) এবং ভাসুর মেহবুব সৈয়দ (পরিবর্তিত নাম)-ও ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর আধিকারিক যখন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন সে এই অলীক কারণে নিজের জীবন বিপন্ন করছে? তখন উত্তরে মেয়েটি বলেছিল “ম্যায় হয় তো মুল্ক হু”। তবে সেহমতের জন্য কিন্তু কারণটা খুব বাস্তব। কারণ তাঁর বাবাও ছিলেন ভারতের গুপ্তচর ও তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী।

তবে এখানে যে প্রশ্নটা মনে আসে সেটা হল, এই মেয়েটি ছিলেন একজন মুসলমান, একজন কাশ্মীরি মুসলমান। নিজের সংস্কৃতি কিংবা সমাজের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করেননি সেহমত। পরে নিজের বাংলোতে আল্লা, যিশুখ্রিস্ট ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্য আলাদা আলাদা পুজোর ঘর তৈরি করে নিরপেক্ষতার নজির গড়েছিলেন তিনি। বলতেন, “ধর্ম কিছুই নয়, বিশ্বাস আর কর্মটাই আসল।”

ভারতীয় ব্যবসায়ী হিদায়তের সুন্দরী মেয়েকে পুত্রবধূ করার প্রস্তাব ঠেলতে পারেননি শেখ সৈয়দ। ছোট ছেলে ইকবালের সঙ্গে সেহমতের বিয়ের পর পদোন্নতি হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার সৈয়দের। তিনি মেজর জেনারেল হন। ফলে তাঁর বাড়িতে দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনা এবং সেহমতের কদর, দুই-ই বেড়ে গিয়েছিল। সেই পরিবারকে নিজের হাতে তিলে তিলে শেষ করে ফেলার গ্লানি ও পাপবোধ সেহমতের সঙ্গী হয়েছিল জীবনভর।

‘রাজি’ সিনেমায় যেমন দেখানো হয়েছিল তেমন জিপের চাকায় নয়। তিনি আব্দুলকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ট্রাকের চাকায়। কারণ,  সৈয়দের বাড়ির পরিচারক আব্দুল সেহমতকে সন্দেহ করা শুরু করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে নিজেকে বলেছিলেন “আমি দুঃখিত আবদুল। কিন্তু তোমার থেকেও আমি বেশি ভালবাসি মাতৃভূমিকে।”

কিন্তু তিনি কি ভাসুরকেও খুন করেছিলেন নিজের হাতে? নিজের আসল পরিচয় বাঁচাবেন বলে? সিক্কার এই প্রশ্নের উত্তরে নীরব ছিলেন সেহমত। তবে স্বীকার করেছিলেন তাঁর জন্যই প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী ও ভাসুর, দু’জনেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে আন্ডারকভার এজেন্ট হয়ে যাওয়া সহজ ছিল না সেহমতের পক্ষে। নিজের শ্বশুরবাড়ির পাশাপাশি তিনি বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন আরও অনেক হাই প্রোফাইল পাকিস্তানি পরিবারের। তৃতীয় পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নাতি নাতনি-সহ আরও অনেক পাকিস্তানি সেনা পরিবারের সন্তানদের শিক্ষকতাও করেছেন সেহমত। ভারত থেকে স্বামীর ঘর করতে আসা তরুণী হিসেবে বিশ্বাস অর্জন এবং গুপ্তচর হয়ে নিজের পরিচয় গোপন রেখে কাজ করে যাওয়া, দু’টি দুই মেরুর কাজকে একইসঙ্গে করতে হয়েছিল সেহমতকে। তাঁর পাঠানো গোপন তথ্যের উপর ভিত্তি করেই রক্ষা করা গিয়েছিল ভারতীয় রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে। 

সেহমতের কাছ থেকে খবর পেয়ে বিক্রান্তকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আন্দামান নিকোবরের কাছে  গোপন ঠিকানায়। পাকিস্তানি আক্রমণ থেকে রক্ষা করা গিয়েছিল ভারতীয় নিরাপত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সূত্রকে। শুধু তাই নয়। সেহমতের দেওয়া সূত্র ধরে ভারতীয় নৌসেনা বিশাখাপত্তনমের কাছে ধ্বংস করেছিল পাকিস্তানি ডুবোজাহাজ পিএনএস গাজি-কে।

যদিও পাকিস্তান বরাবর দাবি করে এসেছে, তারাই তাদের ডুবোজাহাজকে ধ্বংস করেছিল। পাকিস্তানে থাকা কোনও এক এজেন্ট গুরুত্বপূর্ণ খবর পাঠাচ্ছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন ভারতীয় নৌসেনার আধিকারিকরা। কিন্তু এই এজেন্ট যে সেহমত, সে খবর জানতেন উচ্চপদস্থ কয়েকজন আধিকারিক। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ভারতের কাছে পাকিস্তানের নতিস্বীকারের পিছনে সেহমতের মতো আরও অসংখ্য গুপ্তচরের অবদান ছিল। কিন্তু তাঁরা রয়ে গিয়েছেন আড়ালেই। হয়তো সেহমতও থেকে যেতেন তাঁদের মতো অনুচ্চারিত। যদি না সিক্কার সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে দেখা না হত তাঁর ছেলের।

যদিও একমাত্র সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধনে কোনওদিন বাঁধা পড়েননি সেহমত। ভারতে এসে জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর এবং ইকবালের সন্তানের। কিন্তু তাঁকে বড় করেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, এই ছেলের পরিবারের পরিজনদের তিনি খুন করেছেন। রক্তাক্ত হাতে মাতৃত্ব নিতে চাননি তিনি।

নিজের হাতে সবসময় রক্তের দাগ দেখতে পেতেন সেহমত। তাঁর ছেলেকে লালন পালন করে বড় করেছিলেন অভিনব। তিনি সেহমতের জন্য সারা জীবন বিয়ে করেননি। সেহমত দেশে ফেরার পর অভিনব নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সেহমতকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেহমতের সম্মতি পাননি। 

ইকবাল-সেহমতের ছেলে বড় হয়েছেন অভিনবের কাছে। নামের পিছনে ‘খান’ পদবি এবং ইসলাম ধর্মবিশ্বাস, কোনও কিছুতেই তাঁর স্বাধীনতা হরণ করেননি অভিনব। তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত, দিল্লিবাসী। চান না, তাঁর বা সেহমতের আসল পরিচয় প্রকাশিত হোক। সিক্কাকে তিনি বাধা দিয়েছেন সেহমতের প্রকৃত নাম সামনে আনতে।

সেহমতের ছেলে সমর ( পরিবর্তিত নাম) ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন কয়েক বছর। কিন্তু তারপর নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে অবসর নিয়ে মন দেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে। শুধু ছেলের সঙ্গেই নয়, সেহমত বাকি পৃথিবীর সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। 

ভারতে ফিরে চরম অবসাদের শিকার হয়েছিলেন। এক শিখ সাধকের সান্নিধ্য তাঁকে ধীরে ধীরে অবসাদমুক্ত করে। বাকি জীবনটা শিখ ধর্ম ও ধর্মগুরুদের নিয়ে গভীর পড়াশোনা করেছেন সেহমত। সিক্কা দেখেছিলেন, তাঁর ঘরে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান এবং শিখ—সবরকম ধর্মাচরণের সহাবস্থান। সেহমতের মা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ফলে শৈশব থেকেই উদার সহাবস্থানে বড় হয়েছিলেন তিনি। 

তাঁর জীবনের কথা আট বছর ধরে লিখেছেন সিক্কা। সেহমত পাণ্ডুলিপি পড়তেন এবং বেশির ভাগ অংশ আন্ডারলাইন করে বাদ দিতে বলতেন। বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন পছন্দ করতেন না। ২০০৮ সালে প্রথম বার প্রকাশিত হয় ‘কলিং সেহমত’। ২০১৮-তে মুক্তি পায় ‘রাজি’।  ছবিতে সহমতের চরিত্রে আলিয়া ভাট যেমন ভারতীয় গুপ্তচর হয়ে নিজের দেশের প্রতি অবিচল দায়িত্ব পালন করেছেন, ঠিক তেমন ভাবেই সেহমতের স্বামী ইকবাল একজন পাকিস্তানি ফৌজি তাঁর স্ত্রীয়ের পাশে থেকে স্বামীর কর্তব্য পালন করেছেন। ছবিতে ইকবাল তাঁর বাবাকে বলেন , “সেহমত যা করেছে সেটা তাঁর মুল্কের জন্য করেছে। আর আমরাও যা করি সেটা আমাদের মুল্কের জন্য।”

তার আগে সেহমতের কথায় সিক্কা তৈরি করেন ‘নানক শাহ ফকির’। সেহমতের কথামতো এই ছবির লভ্যাংশ দান করে দিয়েছিলেন সিক্কা। পরে ‘রাজি’-র কাহিনীকার হিসেবেও মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক তিনি দান করে দিয়েছিলেন, সেহমতের ইচ্ছাকে সম্মান দিতেই।

সিক্কা চেয়েছিলেন তাঁর গল্প পরিচালনা করুন গুলজার। কিন্তু তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন বর্ষীয়ান পরিচালক। শেষে অক্ষয়কুমারের সূত্রে সিক্কার সঙ্গে আলাপ হয় গুলজার কন্যা মেঘনার। তিনি পরিচালনা করেন ‘রাজি’। তবে ছবিটি নিয়ে ভাল লাগার পাশাপাশি সিক্কার মনে ক্ষোভও আছে। তাঁর কথায়, সেহমত যখন দেশে ফেরেন তখন দিল্লি বিমানবন্দরে লাল কার্পেট ও গোলাপবৃষ্টি করে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। তিনি কার্পেট গুটিয়ে জাতীয় পতাকার সামনে নতজানু হয়ে দেশের মাটি স্পর্শ করেছিলেন। সিনেমায় এই অংশ দেখানো হয়নি বলে ক্ষুব্ধ সিক্কা। তা ছাড়া ছবির সঙ্গে তাঁর নামও কোথাও জড়িয়ে নেই বলে মেঘনাকে দোষারোপ করেন সিক্কা।

নামের পরোয়া কোনওদিন করেননি সেহমত নিজে। তিনি জানতেন, গুপ্তচরের কাজ দেশের সেবা করে যাওয়া। কিন্তু দেশ তাঁকে কোনওদিন বাকি দেশপ্রেমী বা শহিদের মতো স্বীকৃতি দেবে না। বরং, ধরা পড়লে দেশ হয়তো তাকে অস্বীকার করবে। এই অস্বীকৃতিকেই ঈশ্বরের দান বলে মাথায় করে নিয়েছিলেন সেহমত। ভারতে ফিরে নিজের বাবার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তির প্রায় সবটাই দান করে দিয়েছিলেন।

জীবনের শেষ দিন অবধি মালেরকোটলায় সেহমতের বাড়ির ছাদে উড়ত ভারতের জাতীয় পতাকা। ঠিক এ ভাবেই পতাকা উড়ত তাঁর বাবা হিদায়েতুল্লার সময়েও। শ্রীনগরে তাঁদের অট্টালিকার উপরে। আড়ালে থেকে এ ভাবেই দেশকে ভালবেসে গিয়েছেন সেহমত।

আলিয়া ভাটকে তাঁর পছন্দ হয়েছিল নিজের চরিত্রে। যদিও সিক্কার অভিমত, আলিয়ার সঙ্গে সেহমতের চেহারাগত সাদৃশ্য নেই। আলিয়াও চেয়েছিলেন তাঁর ছবি দেখতে। কিন্তু সিক্কা দেখাননি। কথা রেখেছেন সেহমতের। সেহমত চাননি, তাঁর পরিচয় বা ছবি প্রকাশিত হোক। আলিয়া চেয়েছিলেন এক বার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সে সুযোগ একটুর জন্য হারান তিনি। ‘রাজি’-র শুটিং সেটে এক দিন গিয়েছিলেন সেহমত। আলিয়া খবরও পান, একজন অতিথি এসেছেন দেখা করতে। কিন্তু তিনি যে সেহমত, সেটা জানতেন না আলিয়া। তিনি মেক আপ রুম থেকে বাইরে বার হতে দেরি করেছিলেন। তত ক্ষণে অন্তরালবাসিনীর গাড়ির ঘুরে চলে গিয়েছিল অন্যদিকে। পরে আলিয়া বলেন, এই আক্ষেপ তাঁর জীবনভর রয়ে যাবে।

সেহমত অবশ্য সব ক্ষোভ-আক্ষেপের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন। ভারতে ফেরার পরে জীবনের বাকি তিন দশকের বেশি সময় সন্ন্যাসজীবন কাটিয়ে, রাতের ঘুমের মধ্যেই তিনি পাড়ি দেন জীবনের কাঁটাতার পেরিয়ে অনন্তের পথে। ২০১৮-র এপ্রিলে, ‘রাজি’-র মুক্তির কয়েক দিন আগে। মা, তেজি খানের (নাম পরিবর্তিত) পাশে ঘুমিয়ে আছেন তাঁর একমাত্র আদরের মেয়ে, সেহমত। জীবনের পরেও নিরাপত্তার কারণে গোপন সেহমতের শেষ আশ্রয়ও। সেই সেহমত, যাঁকে দেখে সিক্কার মনে হয়েছিল এ রকম অপূর্ব ও নিষ্পাপ সুন্দরীর হাতে মানুষ তো দূর অস্ত, একটা মাছিকেও মারতে পারবে না।

তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন সেহমতকে, “কেন আপনি এই ত্যাগস্বীকার করলেন?” স্মিত হেসে অতীতের গুপ্তচর বলেছিলেন, “কারণ দেশের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে আর কিছুই নয়।”

এখনও দেশের কেউ জানেন না এই মহিলা গুপ্তচরের আসল পরিচয়। এখনও প্রকাশ্যে আসেনি তাঁর ছবি। কে তিনি? কেমন দেখতে তাঁকে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়ত পাওয়া যেতে পারে কোনও একদিন। উদ্যোগ নিয়েছেন খোদ লেখক হরিন্দর সিক্কা। তিনিই প্রকাশ্যে আনতে চলেছেন গোয়েন্দা সেহমতের আসল পরিচয়। তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রদর্শনী করারও পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। কথা বার্তা অনেকটাই এগিয়েছে সেহমতের ছেলের সঙ্গে। যিনি, তেমন ভাবে কোনও দিনও কাছে পাননি নিজের মা’কে। যাঁদের মধ্যে তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি মা-ছেলের সম্পর্ক।

১৯৭১-এ ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় ভারত থেকে বিয়ে করে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন সেহমত। সেখানে গিয়ে পাক নৌসেনার অনেক গোপন তথ্য ভারতীয় সেনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। যা যুদ্ধে অত্যন্ত কাজে এসেছিল দেশের। তবে এক সময় এইসব ভাল লাগছিল না সেহমতের। মন চাইছিল সব ছেড়ে দিতে। কিন্তু পারেননি। লেখক হরিন্দর সিক্কা জানান, পাকিস্তানে থাকাকালীন একটি কবিতা লিখেছিলেন সেহমত। সেখানে একটি লাইনে তিনি লিখেন, ‘আমি অন্যের ইচ্ছায় বাঁধা পড়েছি। আমার মন চাইছে মুক্ত হয়ে উড়তে।’

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img