ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
বাল গঙ্গাধর তিলক, ভারতবাসীর মানসচর্চায় তিনি ‘লোকমান্য’ নামে অভিহিত। কোনও একজন রাষ্ট্রবাদী মানুষের মৃত্যু না হয়ে যদি তিনি আরও অনেক অনেককাল সবল, সুস্থ শরীরে ও মানসে বেঁচে থাকতেন, তবে কোন পথে, কোন দর্শনে, কোন ব্রতে তিনি এগিয়ে চলতেন, তার যথার্থ স্বরূপসন্ধানের খোঁজ করা এবং তার বাস্তবায়নের নামই দেশব্রত। কোনো ভারততাত্ত্বিক, ভারতীয় মনীষার জীবদ্দশায় যে যাবতীয় কর্মোদ্যোগ নেন, যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যে পাকাপোক্ত পথ রচনা করে যান, তাঁর মানস সরোবর মন্থন করেই তাঁর জাগতিক মৃত্যুর পর নতুনের পথে এগোতে হয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয় না, এভাবেই তিনি বেঁচে থাকেন, এভাবেই তিনি আলো দেন, এভাবেই পথ দেখান।
এগিয়ে চলার নামই ‘চরৈবেতি’। এগিয়ে চলাই জীবনের ধর্ম। নব রাজপথে সবলে-সম্মানে রাষ্ট্রীয়-লক্ষ্যে এগোতে হয়; সঙ্গে থাকে পূর্বসূরীদের জ্বেলে যাওয়া মশাল; যুগের সঙ্গে, পরিস্থিতির সঙ্গে, প্রয়োজনের সঙ্গে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া।
পুব বাংলায় একটি প্রচলিত কথা ছিল ‘আগ-দেখা’। লোকমান্য তিলকেরা আগ-দেখতে পারতেন, যার জন্য তাঁদের বলা হয় ‘ভিশনারি আর্কিটেক্ট’। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রবাহের অনুপুঙ্খ বিচার করে ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার নাম, সময়োপযোগী প্রস্তুতি নেওয়ার নামও ‘নব-জ্যোতিষচর্চা’। এর জন্য তিলকজিকে কোনো অভূতপূর্ব বিষয়ে ঘোষণা করে যেতে হয় না। এই ঘোষণা করবেন, এই লিখন লিখবেন, তাঁদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ দেশব্রতী মানুষ, তাঁদের উত্তরসূরী। আমাদের মধ্যে তাঁরা স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে আসেন। তাঁদের শুভ্র-আত্মা আমাদেরই মধ্যে দিয়ে কাজ করেন। আর কাজ করেন বলেই রাষ্ট্রবাদী অনেক কর্মকর্তা বহুবিধ বিরাট কাজ সমাধা করতে পারেন অনায়াসে। যে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উপদেশ তাঁরা দিয়ে যান নি, সমকালীন কল্পনাতে বিন্দুমাত্র বোধের উদয়ও হয় নি, তা তাঁদের আদর্শে রূপায়নের নামই তাঁদের বেঁচে থাকা।
১৮৫৬ সালের ২৩ জুলাই তাঁর জন্ম, আর ১৯২০ সালের ১ অগাস্ট তাঁর প্রয়াণ দিবস। একজন মহান পণ্ডিত ব্যক্তি, মনেপ্রাণে সমাজ সংস্কারক তিনি। ব্রিটিশ ভারতের একেবারে প্রথম দিকের স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর স্বাধীনতাস্পৃহা ব্রিটিশদের এতটাই ভীত করে তুলেছিল যে, তাঁকে ‘ভারতীয় অস্থিরতার পিতা’ বলে অভিহিত করলেন ব্রিটিশ শাসক। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘লাল-বাল-পাল’ এই ত্রয়ীর অন্যতম তিনি। পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায়, মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক এবং বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতেন ভারতপ্রেমী মানুষ। তিনি ছিলেন মানুষের দ্বারা গৃহীত, আদৃত নেতা, তাই তাঁকে সম্বোধন করা হত ‘লোকমান্য’ বলে।
চিত্রাঙ্কন : শীর্ষ আচার্য