হোমআজকের সেরা খবর২৪শে ফেব্রুয়ারি হোক পশ্চিমবঙ্গের ভাষা দিবস

২৪শে ফেব্রুয়ারি হোক পশ্চিমবঙ্গের ভাষা দিবস

২৪শে ফেব্রুয়ারি হোক পশ্চিমবঙ্গের ভাষা দিবস

হীরক কর : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি সত্যিই আমরা ভুলিনি। ভুলিনি ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।  ১৯ শে মে, ১৯৬১। কিন্তু আজ ২৪শে ফেব্রুয়ারি ক’জন মনে রেখেছি।  আমরা মনে রাখিনি। বাংলাদেশের ঢাকার মতো প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল মানভূম-পুরুলিয়ায়, যার বৃত্তান্ত ধরা আছে জনপ্রিয় লোকসংগীত টুসু গানে। পুরুলিয়ার টাড়-বাইদের জনপদে।

পশ্চিমবঙ্গে ভাষা সংগ্রাম তেমনভাবে আলোক বৃত্তে আসেনি কোনওদিন। যদিও পুরুলিয়া ছিল বঙ্গভুক্তির লক্ষ্যে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের জন্মভূমি। সেখানে বাঙালির অবজ্ঞা পরিষ্কার। অথচ ভাষা নিয়ে আন্দোলনে কোনওরকম ফাঁক ছিল না। মাতৃভাষায় কথা বলার, কাজ করার, লেখাপড়া করার অধিকার চেয়েছিল বাঙালি। সংবিধান বলে, এই অধিকার, মৌলিক অধিকার। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে শাসকের ভাষার আধিপত্য মানভূম জুড়ে হিন্দি ভাষার অগ্রাসানে সেই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করেছে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল আসামের বরাক উপত্যকায়। বাংলাভাষীরা সংখ্যাগুরু হলেও প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে অসমীয়া ভাষা আধিপত্য সেখানে বাংলাকে সরকারি স্বীকৃতি পেতে দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তানেও ছিল একই দৃশ্য। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা উর্দু ভাষা বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ায় শুরু হয়েছিল বাংলাভাষীদের ‘ভাষা-সংগ্রাম’।

বাংলা ভাষার জন্য এই তিনটে লড়াই একসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠলে স্পষ্ট হবে ভাষা দিবস উদযাপন। ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ সহ ঢাকা শহরে। ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়া সহ গোটা মানভূমে। আসামের হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, শিলচর, ইত্যাদি শহরে বাংলা ভাষার জন্য গণবিদ্রোহ ছড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৬১ সালে।

১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথ ভেসে গিয়েছিল সালাম-রফিক-বরকত-জব্বরদের রক্তে। ঠিক প্রায় ১০ বছর পর ১৯৬১ সালে আসামের তারাপুর স্টেশন সংলগ্ন রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছিল বাংলা ভাষা-সংগ্রামীর  রক্তে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ১৬ বছরের স্কুলছাত্রী কমলা ভট্টাচার্য। প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ। যাকে আজ মনে রাখিনি।

যেমন মনে রাখিনি বৈদ্যনাথ ভৌমিককে। ভয়াবহ দেশভাগের ৬ বছরের মধ্যেই তদানীন্তন বিহারের বাঙালি প্রভাবিত মানভূম এবং পূর্ণিয়ার অংশ বিশেষ পশ্চিমবঙ্গে অঞ্চল ভুক্তির দাবিতে বৈদ্যনাথ ভৌমিক ২২ দিন অনশনে বসেন। তাঁর অনশনের জন্যই আজকে পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত। এর এক বছর আগেই পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে গেছে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।‌ আর বৈদ্যনাথ ভৌমিকের অনশনের সময় কাল ১৯৫৩। গুগল সার্চ করলেও তাঁকে আর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি চলে গেছেন বাঙালির বিস্মৃতির অন্তরালে ।

বৈদ্যনাথ ভৌমিকের অনশন ব্যর্থ হয়নি। মানভূমের ভাষা আন্দোলন সাফল্য পেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা সম্প্রসারণ করেছিল এই আন্দোলন। বিহারের ‘জঙ্গলমহল’ জেলা ভেঙে ১৮৩৩ সালে মানভূম জেলা তৈরি হয়েছিল। নতুন মানভূম জেলার সদর শহর প্রথমে ছিল মানবাজার। পরে হয় কংসাবতীর ধারে পুরুলিয়ায়।

১৯৩৬ সাল পর্যন্ত পুরুলিয়া ছিল বিহার-উড়িষ্যা যুক্তপ্রদেশের অন্তর্গত।‌ পরে বিহারের অংশ। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের জেরে ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তির  সময় এই জেলার ভাগ্যে জোটে মানভূমের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। যা অন্তর্ভুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে। যদিও এই ভূমি খন্ড একটা সময় পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোগোল সীমার অন্তর্গত ছিল। এখানেই হতভাগ্য পুরুলিয়া।

কখনও বিহার, কখনও ওড়িশা, আবার কখনও এই রাজ্যের সীমানার মধ্যেই বারবার অঙ্গচ্ছেদ ঘটেছে পুরুলিয়ার। জেলা শহর বদলে গেছে কখনও বর্ধমান, কখনও বাঁকুড়া বা কখনও বীরভূমে ।‌ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অবজ্ঞা, আর প্রশাসনিক বঞ্চনা। আর এখানেই দুর্ভাগা পুরুলিয়া। আর তাই উন্নয়নের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পুরুলিয়ায় কংগ্রেস ভেঙে গড়ে উঠেছিল লোক সেবক সংঘ, যার নেতৃত্বে ছিলেন লাবণ্যপ্রভা দেবী। পরবর্তীকালে তার সুযোগ্য পুত্র অরুণ চন্দ্র ঘোষ। ভাষা আন্দোলন এবং বঙ্গভূক্তির লাগাম ছিল তাঁদেরই হাতে। লাবণ্যপ্রভা দেবী “মানভূম-জননী” আখ্যা পান। লোক সেবক সংঘের টিকিটে তিনি পুরুলিয়ার প্রথম বিধায়ক নির্বাচিত হন।

যদিও লোকসভা এবং বিধানসভায় কিছু আসন পেলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তেমন দাগ রাখতে পারেনি লোক সেবক সংঘ। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর পর্বে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো পুরুলিয়া জন্য কোন গঠনমূলক উন্নয়ন করেছে তার কোনও নজিরও নেই। পুরুলিয়া থেকে গেছে সেই তিমিরেই। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি অনেকেরই কাছে আজ স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা।

কিন্তু পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি তো সহজে হয়নি। ১৯৫৬ সালের শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের মানচিত্র থেকে পুরোপুরি মুছে দেওয়ার প্রস্তাব সরকারি ভাবে পেশ করা হয়। বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গকে যুক্ত করে নতুন রাজ্যের নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ব প্রদেশ’। ওই বছর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে ২৩শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিং যৌথ বিবৃতিতে সংযুক্তির প্রস্তাব সমর্থন করেন। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সেটা পাশ করানোর কাজটাই বাকি ছিল। বিহারে তখন চার কোটি লোকের বাস। ‌ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা আড়াই কোটি। কিন্তু এই সংযুক্তির ফলে পূর্ব প্রদেশের বাঙালিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হতো।

সংযুক্তি প্রস্তাব আসতেই বিহারে দেখা দেয় আতঙ্ক। বিহারীরা মনে করতে থাকে নতুন প্রদেশের সব চাকরি দখল করে নেবে বাঙালিরা। শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা নয়, তার ওপর আবার দলে দলে আসছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উদ্বাস্তুরা।  সরকারী ভাবে চেষ্টা হচ্ছিল এমন একটা রাজ্য যেখানে বাঙালি সংখ্যালঘু এবং নতুন রাজ্যের ক্ষমতার দখলদারিত্ব। বিহারীরা সংখ্যাগুরু অথচ আতঙ্কিত।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে দেবার চেষ্টা বিফল হয়। তৈরি হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সংযুক্তকরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ‌ আয়োজন করা হয় বাংলাভাষীদের সম্মেলন। ১ ফেব্রুয়ারি শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা গণ কনভেনশনে অংশ নেন। যার উদ্বোধন করেন বিজ্ঞানী ও লোকসভা সদস্য মেঘনাথ সাহা। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ ‘চরমপত্র দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঐদিন ২ লক্ষ ছাত্র ধর্মঘট করে। ‌২৪  ফেব্রুয়ারি বিহার বাংলা সংযুক্তির প্রস্তাব পেশ করার কথা ছিল বিধানসভায়। রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয় প্রস্তাব ফিরিয়ে না নিলে ঐদিন “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে” হিসেবে পালন করা হবে। যথারীতি ২৪ শে‌ ফেব্রুয়ারি চলে গেছে বাঙালির  স্মৃতির অন্তরালে। তীব্র বিরোধিতার সামনে সরকার সংযুক্তিকরণ থেকে নিরস্ত্র হয়। ওই প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করা যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠি লিখে জানান, প্রস্তাবের পক্ষে বড় জোর দেড়শো জন বিধায়কের সমর্থন মিলত। আন্দোলনের তীব্রতা এত ছিল যে শাসক দলের নেতারাও সংযুক্তিকরণের প্রস্তাবে সায় দিতে সাহস পাননি।

ফেব্রুয়ারি মাসে আচমকা মেঘনাথ সাহা মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে ফের লোকসভা নির্বাচন করতে হয় কলকাতার উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রে। ঘোষিত হয় উপনির্বাচন। মার্চ মাসে এক জনসভায় বিরোধী দল নেতা  জ্যোতি বসু ঘোষণা করেন ভাষা পুনর্গঠন কমিটির সম্পাদক মোহিত মিত্র হবেন নির্বাচনে তাদের প্রার্থী। সিপিআই নেতা জ্যোতি বসুর এক কথাতেই ওই উপনির্বাচনের চরিত্র পাল্টে যায়। যা ছিল লোকসভার একটি সাধারণ উপনির্বাচন, হঠাৎই তা পরিণত হয় ভাষার আধিপত্যের প্রশ্নে গণভোটে। ওই নির্বাচনী প্রতিফলিত হয় পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত। আমজনতার এই গণভোটের জোরে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যায়নি ‘পূর্ব প্রদেশ’।

যথারীতি ওই উপনির্বাচনে জিতে মোহিত মিত্র লোকসভার সাংসদ‌ হন। কংগ্রেসের ঘাঁটি মেদিনীপুরের খেজুরিতে বাম সমর্থিত প্রার্থী লাল বিহারী দাস জয়ী হন কুড়ি হাজারের বেশি ভোটে। কংগ্রেস বা সিপিআই নয়, সেদিন প্রকারান্তরে এই গণভোটে জয়ী হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। 

যথারীতি সংযুক্তিকরণ বাতিল হয়। বিধান রায়ের সরকারের পক্ষে সাধারণ মানুষের গণরায় উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ভারতের সংবিধানে গণভোটের কথা বলা নেই। ‌ তার পরেও কোনও কোনও ইস্যুতে কোনও কোনও নির্বাচন গণভোটের চরিত্র নেয়। ১৯৫৬-র আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ভাষা শুধু কথা নয়। ক্ষুধার্ত পেট, রোজগার, চাকরি এবং শিক্ষার অধিকার সব কিছুর সঙ্গেই ভাষা জড়িয়ে আছে। মাথার উপর ছাদ, পেটের ভাত, রোজগার, এগুলোই হল সংবিধানের মৌলিক অধিকার। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভাষা।

উর্দু সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে তৈরি হয়েছে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। হিন্দির আগ্রাসনের বিরোধিতায় ছোটনাগপুর থেকে পুরুলিয়া ঢুকেছে পশ্চিমবঙ্গে। ফলে নির্বাচনের মুখে, ‘কার্যকর্তা’, ‘ক্ষেত্র মন্ডল’ , এইসব শব্দ শুনলে জাতিগত অস্তিত্বের আতঙ্ক সব মানুষকেই ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। ভাষার চর্চা চলে মিছিলে, স্লোগানে‌। দেয়াল লিখনে মানুষ অস্তিত্বের সংকট বুঝতে পারেন। ফলে হিন্দি বলয়ের ভাষার আগ্রাসন রুখতে আসন্ন ২০২১-এর নির্বাচন না বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার গণভোটে পরিণত হয়। তা না হলেও, নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলা ভাষার অস্তিত্বের সংকট প্রভাব ফেলবে দু’হাজার একুশে।

পুরুলিয়ার বঞ্চনা বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সচিবালয়ের ঔদাসীন্য নয়। পুরুলিয়া নিজেও ফোকাসহীন। কিছুটা উদ্যমের অভাব। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিকে বছর বছর উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেছে ভাষা দিবস। ‌ শেষ পর্যন্ত সে আদায় করে নিয়েছে সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। প্রতি বছর উদযাপন বিশ্বব্যাপী প্রচার দিয়েছে তাদের দেশ বাংলাদেশ।

কিন্তু ১৯৫৩ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারিকে কেউ মনে রাখেনি। একুশের আলোয় ঢাকা পড়ে গেছেন বৈদ্যনাথ ভৌমিক। কেননা তাকে প্রাণ প্রদীপের আলোয় না নিয়ে এসেছে এপার বাংলার বাঙালি। না, নিজেকে পিছিয়ে পড়া বলে গর্ব করা পুরুলিয়া। তাই, ২৪ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের মাধ্যমে তার ওপর থেকে ড্রপ স্কিন উঠে যাক। স্বীকৃতি পাক পশ্চিমবঙ্গের ভাষা আন্দোলন। ২৪ শে‌ ফেব্রুয়ারি হোক পশ্চিমবঙ্গের মাতৃভাষা দিবস ।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img