হীরক কর : হাজারো বৈচিত্র্যের দেশ ভারত। নানা ভাষা এবং সংস্কৃতির মানুষের বসবাস ভারতকে অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে করেছে স্বতন্ত্র। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর পটপরিবর্তন গোটা ভারতকে ভেঙে তিন টুকরো করলেও এখনো বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে ভারত বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা সৌন্দর্যের দাবিদার। দেশটির একদিকে যেমন আছে ঊষর মরুভূমি, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে বরফাচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ভারতকে নিয়ে প্রাচীন পৃথিবীতে রহস্যের অন্ত ছিল না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে ভারত ছিল তান্ত্রিকদের পুণ্যভূমি। আবার ইউরোপবাসীর কাছে ভারত ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এক অঞ্চল, যেখানে বুনো মানুষের বসবাস। কিন্তু যুগের হাওয়ায় এসব রহস্য এখন আর হালে পানি পায় না। এখন ভারতের সঙ্গে বিশ্বের সব উন্নত দেশের রয়েছে বাণিজ্যিক যোগাযোগ এবং কূটনৈতিক সংযোগ। প্রতিদিন প্রচুর বিদেশি পর্যটক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করতে আসছেন। কিন্তু তারপরেও, এই দেশের কিছু কিছু অঞ্চলকে ঘিরে মানুষের মাঝে আজও রহস্য ঘুরপাক খায়। তেমনি একটি অঞ্চল হলো হিমালয়ের রূপকুণ্ড হ্রদ।
হিমালয়ের কোলে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় ওয়ান গ্রামে অবস্থিত এই লেক, যাকে বলা হয় রূপকুণ্ড। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তে থাকা ত্রিশুল (৭১২০ মিটার ) ও নন্দাঘুটি (৬৩১০ মিটার) বেসক্যাম্পের কাছেই, হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে আছে দু মিটার গভীর এই রহস্যময় হ্রদ রূপকুণ্ড। হ্রদটির উত্তরে আছে জুনারগলি কল। ৪০০ মিটার চরাই ডিঙিয়ে পথ চলেছে হোমকুণ্ড হয়ে রন্টি স্যাডলের দিকে। রূপকুণ্ডের পূবে রয়েছে চন্দনিয়া কোট। রূপকুণ্ড তার বুকে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে এক রহস্য।
যত দিন পেরিয়েছে এই রহস্যময়তা ততই ঘনীভূত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। কোথাও শুনতে পাওয়া যায় যে, এই হ্রদে এমন কিছু স্থান আছে যেখান থেকে মানুষ আর কখনো ফিরে আসে না। আবার এমনও শোনা যায় যে, এই হ্রদের জলে স্নান করতে পারলে সব পাপ তো দূর হবেই । পাশাপাশি অমরত্বও মিলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটাই এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ২৯ মিটার উঁচুতে এই হ্রদের অবস্থান হওয়ায় সাধারণের পক্ষে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এই হ্রদে যাওয়া সম্ভব নয়।
মহাদেব কি তৈরি করেছিলেন রূপকুণ্ড? উত্তরাখণ্ডের লোকগাথা তাই বলে। বহুকাল আগে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার নৌটি গ্রামে বাস করতেন নন্দাদেবী। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল স্বয়ং মহাদেবের। রীতি অনুযায়ী তাঁকে স্বামীর বাড়ি হোমকুণ্ড যেতে হয়েছিল। শোভাযাত্রা সহকারে নন্দাদেবীকে যখন তাঁর স্বামীর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন হঠাৎ নন্দাদেবীর তৃষ্ণা পায়। ত্রিসীমানায় কোনও জলের উৎস ছিল না। তৃষ্ণার্ত নন্দাদেবী তখন মহাদেবকে স্মরণ করেন।দৈববলে মহাদেব তাঁর তৃষ্ণার্ত স্ত্রীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক ছোট্ট হ্রদ বেদিনি কুণ্ড। নন্দাদেবী ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই বেদিনি কুণ্ডের জল পান করেছিলেন। এরপর আবার এগিয়ে চলেছিল শোভাযাত্রা। স্ত্রীর আবার জল পিপাসা পেতে পারে ভেবে মহাদেব যাত্রাপথে তৈরি করে দিয়েছিলেন আরেকটি হ্রদ। এটিই হল রূপকুণ্ড।
রহস্যময় হ্রদ রূপকুণ্ড স্থানীয়দের কাছে ‘কঙ্কাল হ্রদ’ নামেও পরিচিত। এই নামের পিছনেও কিছু কারণ আছে। সম্প্রতি ভারতের উত্তরাখণ্ডের এই এলাকায় বরফের তলা থেকে প্রায় ৬০০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে এই হ্রদের কাছাকাছি এত কঙ্কাল এলো তার কোনো কিনারা এখনো হয়নি। আর এই রহস্য সুরাহা না হওয়ার কারণে স্থানীয়রা একে ঐশ্বরিক বলেও দাবি করছেন। কিন্তু এই হ্রদের সবচেয়ে জনপ্রিয় রহস্য হলো, বছরের সবসময় এই হ্রদটিকে দেখা যায় না। অনেক পর্যটক এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ মানচিত্র ঘেঁটে এবং বছরের পর বছর অনুসন্ধান চালিয়েও হ্রদটির সন্ধান পায়নি। আবার এমনও হয়েছে যে, অল্প একটু চেষ্টাতেই অনেকে দেখতে পেয়েছেন হ্রদটিকে। আর তাই তো স্থানীয়রাও বলেন, যারা পুণ্যবান তারাই কেবল এই হ্রদটির দেখা পান।
রহস্যময় এই হ্রদ বছরের প্রায় আট মাসই থাকে বরফে ঢাকা থাকে। এক সময়ে বরফ গলতে শুরু করলেই এই জলাশয়ের আশপাশে একের পর এক কঙ্কালের দেখা মিলত, যা নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় পর্যটক ও স্থানীয়দের মধ্যে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬,৪৯৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই লেকের জলে এত কঙ্কাল কীভাবে এল ?
১৯৪২ সালের গরমকাল। ব্রিটিশ ভারতের ফরেস্ট অফিসার হরি কৃষান মাধওয়াল এবং তাঁর সঙ্গীরা ১৬,৪৭০ ফুট উচ্চতায় হিমবাহের জলে পুষ্ট একটি হ্রদ দেখতে পান। টলটলে স্বচ্ছ জলের কাছে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন মাধওয়াল। জলের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শয়ে শয়ে মানুষের কঙ্কাল, নর করোটি ও হাড়গোড়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঠের কারুশিল্প, লোহার তৈরি বল্লমের ডগা, চামড়ার চটি ও ধাতব রিং সহ আরও অনেক কিছু।
বিস্মিত মাধওয়াল বিশদভাবে সব লিখে জানান তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তাদের। মাধওয়ালের পাঠানো রিপোর্ট পড়ে ব্রিটিশরা অনুমান করেছিল, ওই কঙ্কালগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত জাপানি সেনাদের হতে পারে। জাপানি সেনারা সম্ভবত জুনারগলি গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছিল। প্রবল তুষারঝড়ের কবলে পড়ে তারা প্রাণ হারায়।
তবে ১৯৪২ সালের দিকে আর একজন বনরক্ষী হঠাৎ এই হ্রদ এবং অনেক গণকবর আবিষ্কার করেন। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, কঙ্কালগুলো ১২ থেকে ১৫ শতকের সময়কার। কিন্তু মানুষের মনে আজও ভাবনা ঘুরপাক খায় এই ভেবে, কেন ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে সেই নয় শতকের সময়কার একসঙ্গে এতগুলো মানুষের কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা কঙ্কালগুলো এবং গয়না পরীক্ষা করে জানান, এগুলো কোনো রাজকীয় বাহিনী বা একদল তীর্থযাত্রীর। এমনও হতে পারে, এই মানুষগুলো কোনো তীব্র তুষারঝড়ের কবলে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হাজির করেন একদল নৃতত্ত্ববিদ। তাদের মতে, ওই অঞ্চলে বসবাসরত কোনো গোষ্ঠী গণহারে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই হলো মূল রহস্য।
পরে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদরা হাড়গুলো পরীক্ষা করে দাবি করেন, হাড়গুলো জাপানি সৈন্যদের হতেই পারে না, কারণ এই হাড়গুলো অনেক প্রাচীন।স্থানীয়দের অনেকে দাবি করেন, এখানে এক সময়ে পালা করে আত্মহত্যা করত এক দল লোক। আত্মহত্যার নাকি প্রথাও ছিল এক সময়। রটে যায়, প্রেতাত্মারা নাকি এই লেকে বাস করে। কোনও কোনও পর্যটক তো এর পর রূপকুণ্ড অভিযানে যেতেই ভয় পেতেন।
রহস্য সমাধানে ২০০৪ সালে রূপকুণ্ড অভিযান করা হয়। জানা যায়, এগুলো ৮৫০ শতকের কঙ্কাল। বিজ্ঞানীদের অন্য একটি দল অবশ্য দাবি করেন, হাড়ের বয়স ২০০ বছরের কাছাকাছি। মারাত্মক ঠান্ডার কারণে হাড়, মাংস সবই প্রায় অক্ষত থেকেছে বছরের পর বছর। কিছু কঙ্কালের গায়ে মাংস লেগে থাকার কারণেই প্রথমে এই কঙ্কালগুলোর বয়স বোঝা যায়নি। এদের মধ্যে দু’টি দলকে শনাক্ত করেন বিজ্ঞানীরা।
জানা যায়, একটি দলের সদস্যরা একই গোত্রের, অপর দল একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর। স্থানীয় এক উপকথা অনুযায়ী, এক দেবী রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেওয়ায় শিলাবৃষ্টি নেমে এসেছিল। যার ফলে ওই এলাকার সব বাসিন্দা মারা যান। এই দেবীকে নন্দা দেবী বলেন স্থানীয়রা। অন্য এক উপকথা অনুযায়ী, যশোদ্ধল নামে এক রাজার অন্তঃসত্ত্বা রানির গর্ভস্থ ভ্রূণ পড়ে গিয়েছিল রূপকুণ্ডে। সেই আত্মাই নাকি পর্যটকদের আক্রমণ করে মেরে ফেলত। সেই মৃত পর্যটকদেরই কঙ্কাল এগুলো।
বিজ্ঞানীর কিন্তু বলছেন অন্য কথা। বহু বছর আগে স্থানীয় গাইডদের সাহায্যে তীর্থযাত্রায় এসেছিল একটি দল। আচমকা মারাত্মক শিলাবৃষ্টির কারণে মৃত্যু হয় গোটা দলটির। প্রতিটি খুলির মাঝে ফাটল, এটা ছিল কঙ্কালগুলোর বৈশিষ্ট্য। ছোট কিন্তু এই গভীর আঘাত থেকেই মৃত্যু হয়েছিল বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।
১৯৫৬ সালে ভারতীয় সরকার সেখানে সার্ভে টিম পাঠায়। তাঁরা সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আনেন। রেডিও কার্বন ডেটিং করে জানা যায় এগুলো অন্তত ১২ থেকে ১৫ শতাব্দীর। তখন অনেকে ধারণা করলেন এরা মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সেনাবাহিনী হবে যারা তিব্বত দখল করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ১৯৫৬ সালের পদ্ধতি ছিল অনেক ত্রুটিপূর্ণ। অনেকে ধারণা করেন এরা কোনো মহামারীর শিকার হয়েছেন।
প্রচলিত আছে যে, প্রাচীনকালে কনৌজের রাজা যশোয়াল এখানে আসেন নন্দাদেবীর উপাসনা করতে। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে আসেন বাইজি। এতে এই স্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়। হঠাৎ শিলাবৃষ্টি হয় এবং তারা হ্রদের ভিতর নিক্ষিপ্ত হয়।
অধিকাংশ মানুষ লোককাহিনীকে গালগল্প বলে ধরে নিলেও এর ভিতর ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, কনৌজের রাজা যশোয়াল, তার রানি ও পরিষদবর্গসহ নন্দা দেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার জন্য গেছিলেন।
আজও প্রতি ১২ বছর পরপর রূপকুণ্ডে নন্দা দেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হয়। তবে কোনো কিংবদন্তিতেই এই হ্রদের কথা উল্লেখ নেই। স্থানীয় আদিবাসী তো বটেই, গোটা বিশ্ববাসীর কাছেই রূপকুণ্ড একটি মৃত্যু বিভীষিকার নাম। ২০০৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের উদ্যোগে একদল গবেষক এই রহস্য ভাঙার উদ্যোগ নেন। এর নেতৃত্ব দেন জার্মানীর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাঙ্। দলটিতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। তাঁরা নানা হাড়গোড়ের নমুনা সংগ্রহ করেন। দলটি একটি বিশাল সাফল্য লাভ করে যখন তাঁরা একটি অক্ষত দেহ উদ্ধার করেন। হিমালয়ের বরফশীতল তাপমাত্রা দেহটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। এতে তাঁরা ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করার সুযোগ পেলেন।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা কঙ্কালের খুলিতে অগভীর আঘাতের চিহ্ন পেলেন। পুনের ডেকান কলেজের প্রফেসর ডা. সুভাষের মতে, এই অগভীর আঘাতের কারণ কোনো তুষারধস নয় বরং গলফবলের মতো ছোট কঠিন বস্তুর আঘাতের ফলাফল। একই সঙ্গে কয়েকশ’ মানুষ মাথায় একই রকম আঘাত পেল এবং মারা গেল ! এটা নিশ্চয়ই ওপর থেকে আঘাত করেছে । তাদের ধারণা, এটা শিলাবৃষ্টি হবে। প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাঙ্ স্থানীয় একটি পালাগানের কথা স্মরণ করেন। যেখানে বলা হয়েছে, রুষ্ট দেবী পাপীদের উপর এমন শিলা নিক্ষেপ করেন যা পাথরের থেকেও ভারী। এ ছাড়াও বিজ্ঞানীরা কাপড়, জুতো, কাচের চুড়ি, বাঁশের লাঠি উদ্ধার করেন। এ থেকে বোঝা যায় তাঁরা তীর্থযাত্রী ছিলেন। সেখানে এখনো বরফের নিচে ৬০০ দেহ চাপা পড়ে থাকতে পারে।
এই নমুনাগুলো ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও কার্বন এক্সিলেটর ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখানকার গবেষকরা জানান, নমুনাগুলো ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বের। যা ১৯৫৬ সালের রিপোর্টের আরও বহু আগে আবিষ্কৃত হয় ।
কেউ বলেছেন, এঁরা হতে পারেন ব্যবসায়ীর দল। যাঁরা তিব্বত থেকে পণ্য নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তখনকার দিনে পশুর পিঠে করে ভিনদেশ থেকে পাহাড়ি গিরিপথ ধরে বিক্রয়যোগ্য পণ্য আসত ভারতে। হ্রদের জলে থাকা মানুষের কঙ্কালের সঙ্গে কোনও জন্তুর কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই কঙ্কালগুলো ভিনদেশী ব্যবসায়ীদেরও নয়। তাছাড়া এই পথে ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের কোনও রেকর্ডও নেই।
ভারতীয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায়, রূপকুণ্ড হ্রদটিকে কেন্দ্র করে খিস্ট্রের জন্মেরও আগে থেকেই রহস্য চালু ছিল। তখন অনেক মুনি-ঋষির নামে বিভিন্ন গল্প চালু ছিল।
কিন্তু মানুষের মনে আজো ভাবনা ঘুরপাক খায় এই ভেবে যে, কেন ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে সেই নয় শতকের সময়ে একসঙ্গে এত মানুষের কবর দেওয়া হয়েছিল।
এ নিয়ে সাম্প্রতিকতম যে গবেষণা হয়েছে তারপরই চূড়ান্ত ঘোষণাটি করেছেন হায়দরাবাদের সেন্টার ফর সেলুসার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজির কুমারস্বামী থঙ্গরাজ। তাঁর দাবি, হ্রদের জলে যে হাড়গোড় মিলেছে, তা দু’টি পৃথক মানবজাতির। পৃথক পৃথক সময়ে এ দেশে তাদের অস্তিত্ব ছিল। একদল ভারতে তথা রূপকুণ্ডে এসেছিল অষ্টম শতকে। অন্য দলটি এসেছিল সপ্তদশ শতকে। এই দ্বিতীয় দলটি এসেছিল ভূমধ্যসাগরীয় কোনও দেশ, যেমন গ্রিস থেকে।
থঙ্গরাজের আরও দাবি, এই হ্রদে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পরপর দু’বার কোনও ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল। আর তার জেরেই প্রাণ হারান সকলে। তবে এত কিছু বললেও ঠিক কী কারণে পৃথক পৃথক এই জনজাতি রূপকুণ্ডে এসেছিল, তা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি থঙ্গরাজ।
থঙ্গরাজের আগে এই একই বিষয় নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে আসছে লখনউয়ের বীরবল সাহানি ইনস্টিটিউট অফ প্যালেওসায়েন্সেস (বিএসআইপি)-এর বিজ্ঞানীরা। প্রতিষ্ঠানের ডিএনএ ল্যাবের এক সিনিয়র বিজ্ঞানী নীরব রাইয়েরও দাবি, হ্রদ ও তার সন্নিহিত এলাকায় অষ্টম এবং সপ্তদশ শতকে দু’ধরনের মানবজাতির আগমন ঘটেছিল। তাই দুটি ভিন্ন সময়ের দু’ধরনের হাড়গোড় মিলেছে সেখানে। এ নিয়ে তাই আর কারও মনেই কোনও জটিলতা থাকা উচিত নয়।
লখনউয়ের পালিওসায়েন্সেসের বীরবল সাহানি, ইনস্টিটিউটের ডিএনএ বিশেষজ্ঞ নীরজ রাই এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ববিদ ডেভিড রেইচ কয়েক ডজন কঙ্কালের নমুনা গুলো থেকে ডিএনএ সনাক্ত করে ২৩জন পুরুষ এবং ১৫ জন মহিলাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।
গাড়ওয়াল কুমায়ুনের বিভিন্ন লোকগাথার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলো রহস্যময় রূপকুণ্ড। রূপকুণ্ডের বরফে জমে যাওয়া মানুষগুলো কারা, তা বলে দিয়েছিল চামৌলির লোকগান ও লোকগাথা। তবে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে লোকগাথার দেওয়া তথ্যের কোনও মিল ছিল না। থাকার কথাও নয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা সেগুলোই বিশ্বাস করেছিল।লোকগাথা গুলো পরবর্তীকালে বিভিন্ন এলাকায় পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হলেও সব কাহিনির অন্যতম চরিত্র হয়ে আছেন কনৌজ রাজ যশদয়াল সিং।
রাজা যশদয়াল সিং ও রানি বালামপার উপাখ্যান কয়েকশো বছর আগের কথা। রাজপুরোহিতের নির্দেশ অনুসারে ত্রিশুলী তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিলেন কনৌজ রাজ যশদয়াল সিং ও তাঁর সন্তানসম্ভবা রানি বালামপা। সঙ্গে ছিল বিরাট একটি দল। দলে ছিলেন মন্ত্রী, সান্ত্রী, পাচক,পরিচারক, মালবাহক, ডুলিবাহক, এমনকি রাজনর্তকীরাও।
রূপকুণ্ড ট্রেক রুটে আজ যেখানে পাথর নাচুনি নামে এলাকাটি আছে, সেখানেই থেমেছিল দলটি। ডুলি থেকে নেমেছিলেন রাজা আর রানি। পথশ্রমে ক্লান্ত রাজার ইচ্ছে হয়েছিল আমোদ প্রমোদের। রাজার তাঁবুতে নাচ ও গান শুরু করেছিলেন রাজনর্তকীরা।
তীর্থযাত্রায় এ হেন অধর্ম মেনে নিতে পারেননি নন্দাদেবী। তাঁর অভিশাপে নৃত্যরত অবস্থায় পাথর হয়ে গেছিলেন রাজনর্তকীরা। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয়ে যায় পাথর নাচুনি। আজও সেখানে গেলে কিছু অদ্ভুত আকৃতির পাথর দেখতে পাওয়া যাবে। সেগুলিই নাকি সেই অভিশপ্ত নর্তকীদের প্রস্তরীভূত রূপ।
নন্দাদেবীর রুদ্ররূপে ভীত রাজা ও রানি ক্ষমা চেয়েছিলেন দেবীর কাছে। শান্ত হয়েছিলেন নন্দাদেবী। ক্ষমা করেছিলেন রাজাকে। প্রতি ১২ বছরে একবার তীর্থ যাত্রা করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন রাজাকে। রাজ্যে ফিরে এসেছিলেন যশদয়াল সিং। তীর্থযাত্রা অসমাপ্ত রেখে। কিন্তু কয়েক বছর পর নন্দাদেবীর আদেশকে অমান্য করে রাজা আবার গিয়েছিলেন হোমকুণ্ডের পথে। সে বছরও সঙ্গে ছিলেন রানি ও কয়েকজন নর্তকী। রূপকুণ্ড পেরিয়ে দলটি যখন জুনারগলির ওপরে, ঠিক সেই মুহূর্তে নন্দাদেবীর অভিশাপে শুরু হয় প্রবল শিলাবৃষ্টি। একই সঙ্গে ফণা তোলে প্রবল তুষারঝড়।
ঝড়ের ঝাপটায় অসহায়ভাবে তীর্থযাত্রীরা একে একে জুনারগলি থেকে রূপকুণ্ডের বুকে আছড়ে পড়েছিলেন। জীবন্ত অবস্থায় তুষার সমাধি ঘটেছিল রাজা রানি সহ সম্পূর্ণ দলটির। গাড়ওয়াল, কুমায়ুনের লোকবিশ্বাস অনুসারে, রূপকুণ্ডের কঙ্কালগুলো কনৌজ রাজের দলটির সদস্য সদস্যাদের।
কেউ কেউ বলেন, কঙ্কালগুলো ডোগরাদের সেনাধ্যক্ষ জোরাওয়ার সিং ও তাঁর সৈন্যদলের। ১৮৪১ সালের মে মাস থেকে ১৮৪২ সালের অগাস্ট মাস পর্যন্ত চলেছিল ডোগরা-তিব্বতীদের মধ্যে যুদ্ধ। জোরাওয়ার সিং-এর তত্ত্ব খারিজ হয়ে গিয়েছিলো, কারণ ইতিহাস বলছে তিব্বতীদের সঙ্গে মিসসারের যুদ্ধে তিনি প্রাণ হারান। এই পথে তাঁর আসার কোনও সম্ভবনাই ছিল না।
এত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেও রূপকুণ্ডের কঙ্কাল রহস্যের সমাধান করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীদের নেওয়া সিদ্ধান্তের মধ্যে দেখা গেছে বিস্তর ফারাক। আজও জানা যায়নি ওরা কারা। আজও সেটা অনুমান হয়েই রয়ে গেছে|কঙ্কালগুলোকে ঘিরে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু জানে রূপকুণ্ড ও জুনারগুলি কল। কিন্তু তারা ভাষাহীন। তাই কয়েকশ হতভাগ্যের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তাই রূপকুণ্ড রহস্য আজও অমীমাংসিত।
রহস্যময় হ্রদ রূপকুণ্ড যাই হোক না কেন, যতদিন যাচ্ছে ততই আরো দুর্ভেদ্য হয়ে উঠছে হ্রদটি। দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক এই হ্রদটি দেখার জন্য প্রতি বছর ভিড় করেন। যাদের রয়েছে পর্যাপ্ত সাহস এবং শারীরিক শক্তি তাদেরই উচিত এই হ্রদ অনুসন্ধানে যাওয়া। কারণ প্রকৃতির অপার রূপ দেখতেও যে প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন হয় তার সাক্ষী তো খোদ হিমালয়।