হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিকেন বছরভর হরেকরকমের ব্রত? শুধুই পরিবারের মঙ্গলকামনা নাকি অন্যকিছু?

কেন বছরভর হরেকরকমের ব্রত? শুধুই পরিবারের মঙ্গলকামনা নাকি অন্যকিছু?

কেন বছরভর হরেকরকমের ব্রত? শুধুই পরিবারের মঙ্গলকামনা নাকি অন্যকিছু?

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
সুবচনী ব্রত: ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’ গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন নানান লোকায়ত ব্রত বিষয়ে, বিস্তারিত আলোচনায় সমকালীন গ্রামীণ পরিবেশ, পারিবারিক সম্পর্ক এক লহমায় উঠে আসে। গ্রামের উন্মুক্ত বিলের ঘাটলার উপর পৈঠাতে রয়েছে লাল রঙের পুতুলের মতো শোয়ানো তিনটি তেল-সিঁদূরে পুরু হয়ে ওঠা ‘সুবচনী’-র ত্রয়ী মূর্তি — আকলি, সুমতি, ভগবতী এই তিন বোন, একত্রে সুবচনী; ছোটো ছেলের মানুষ আঁকার মতো সে পুতুল, একটা গোলাকার মাথা, দুপাশে উর্ধ বাহুর মতো দুই হাত, হাঁটু ভেঙ্গে দাঁড়ানোর ভঙ্গি। লোকবিশ্বাস, এরা গৃহস্থকে সুখবর এনে দেন — সংসারের স্বামী, সন্তানেরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকে; সংসারে অসুখবিসুখের জ্বালাযন্ত্রণা, প্রতিনিয়ত অঘটন-দুর্ঘটন আর তখনই কাছের জনের সংবাদ না পেলে মা-মাসির বুক কাঁপে।

কুশল খবর এনে দেবার জন্য মায়েরা সুবচনীকে ডাকেন আর কুশল সংবাদ পেলে সবচাইতে আগে স্মরণ করেন তাঁকে। ব্রতের সেই উপাদান খুবই সামান্য — পিতলের রেকাবিতে পান-সুপারি সিঁদূর, ছোটো বাটিতে সামান্য তেল সাজিয়ে গৃহকর্ত্রী আসেন ঘাটলায়; দেওয়া হয় উলুধ্বনি, সুসংবাদের বার্তা পেয়ে গ্রামবাসী ছুটে আসেন, যোগ দেন সুবচনীর ব্রতকথায়। মানতকারিণী সুবচনীকে তেল-সিঁদূর মাখিয়ে, তিন বোনকে তিনটি গোটা সুপারি বাতাসা দিয়ে, ফুল-দূর্বা হাতে নিয়ে ঘিরে বসেন। ব্রতকথা চলতে থাকে — এক জন্মদুঃখী অনাথ ছেলে ‘দুইখ্যা’-র অতীব দুঃখে দিন কাটে, বনেবাদাড়ে ঘোরে, কচুঘেঁচু খায়। এদিকে সুবচনীর তিন বোন হিজলতলায় দাবা পাশা খেলেন।

একদিন তিন বোনের দেখা পায় দুইখ্যা, আর তাদের দয়া। সেই দয়ার সংবাদ জগতে ছড়িয়ে দিতে সুবচনীর ব্রত চালু হয়। এ ভাবেই যেন অকূলে পড়লে পারে তোলেন সুবচনী, বর দেন। ব্রত শেষ হলে পুনরায় উলুধ্বনি পড়ে। ব্রতকারিণী সকল নারীর মাথায় আশীর্বাদী তেল ছোঁয়ান, হাতে দেন পান সুপারি, সধবাদের কপালে সিঁদূর পরানো হয়। ছোটোরা ব্রতকথা শুনে দু’টো বাতাস পায়। সকলে মঙ্গলানন্দে গৃহে ফেরেন। একজনের সুখবরে পাঁচজন আনন্দিত হন, এ এক অন্তরঙ্গ গ্রামীণ সম্পর্ক ছিল সে সময়। বিবাহের অনুষ্ঠান, গাঁয়ের মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে, সবই জানানো হয় সুবচনীকে। সঙ্গে উলুধ্বনির শুভ-সংকেত।

লালুব্রত
রানী চন্দ উল্লেখ করেছেন ‘লালুব্রত’-র কথাও, এরই নাম ‘লাউল্যার বর্ত’। এই ব্রতের উৎসাহী ও পৃষ্ঠপোষক তাঁর দিদিমা। ব্রতের জন্য ছোটো-ছোটো দুটি কাঠের পিঁড়ি গড়িয়ে দেন দুই বোনকে। পিঁড়ির উপর শীতের বিকেলে পুকুরপাড়ের নরম মাটি দিয়ে স্তূপ গড়া হয়, সেটাই লালু — না শিব না মন্দির। দুই বোনে বিকেলে রঙ-বেরঙের ফুল তোলে, যা সারারাত তাজা থাকবে, ভোরেরও সতেজ দেখাবে। প্রদীপের আলোয় বসে সন্ধ্যায় দুই বোন সেই ফুল দিয়ে লালু সাজায়, ফুলে ফুলে লালুর সর্বাঙ্গ ঢেকে যায়, একটুও গা দেখানোর জো নেই। হলুদ অতসীর বোঁটা লালুর গায়ে গাঁথা হয়, গাঁদা-টগর-কলকে ফুলে সজ্জিত হয় লালুর দেহ ও পিঁড়ি।

সাজানো হয়ে গেলে খাটের নীচে ঠেলে দুই বোন ঘুমাতে যায়। পরদিন ভোরবেলা দিদিমা ডেকে তোলেন তাদের, গাঁয়ে গিঁট দিয়ে শীতের কাঁথা বেঁধে দেন, ঘুম-ভরা চোখ নিয়ে লালুর পিঁড়ি সঙ্গে করে কুয়াশা ঠেলে দুই বোন গাঁয়ের পথ চলে, দিদিমার হাতে ফুলের সাজি — শিশিরে ভেজা মাটিতে সকলের পা ভিজে যায়; ভোরের শুকতারা তখন জ্বলজ্বল করছে। পুকুরের ঘাটলায় জলের ধারে সিঁড়িতে লালু বসানো হয়; তখন জলের উপর ঘন কুয়াশার পরত, এই কুয়াশাই ব্রতচারিণী ভাঙ্গবে, তবেই সূর্যদেব ঝিকিমিকি দিয়ে পুবের আকাশে উঠবেন — এটাই হল লালুব্রত। অন্য বাড়ির বালিকারাও একে একে আসে। এক একটি ছড়া সুর করে কেটে ফুল নিয়ে জলে ফেলা হয় — “উঠো উঠো সূর্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া,/না উঠিতে পারি মোরা শিশিরের লেইগা।” নীচ থেকে ধীরে ধীরে উঁচু গাছে কুয়া উঠে যায়, ভোর ছেড়ে সকাল হয় বিশ্ব।

এই যে কনকনে শীতের জড়িমা ছেড়ে উঠার প্রশিক্ষণ, এই যে সাজানোর নান্দনিকতা বাংলার মেয়েদের দেওয়া শুরু হত সেই অল্প বয়সে তা যেন প্রকৃতির সঙ্গে খাপখাওয়ানোর এক ট্রেনিং, নন্দনতত্ত্বের শিক্ষা — যার নেতৃত্বে থাকতেন দিদিমা-ঠাকুমারা, ছাত্রী তৃতীয় প্রজন্ম। এমন করেই শীতের একমাস ধরে রোজ রোজ লালু গড়া হয়, ফুল তোলা হয়, লালু সাজানোর পালা চলে আর ভোরের আলো-আঁধারিতে ঘাটলার ধারে নিত্য আচার-আচরণ। কার লালু কত সুন্দর, কত কেরামতির — সেও এক প্রতিযোগিতা — সুনিপুণ গৃহিণী হয়ে উঠার শিক্ষা! বাংলার নারী এভাবেই গড়ে উঠেছে বাল্যকাল থেকে।

ব্রত কাকে বলে?
কোনো কিছু কামনা ও চেষ্টা করে, আশা-আশঙ্কা করে প্রকৃতিকে অনুকরণের মাধ্যমে যে লৌকিক-সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, তাকেই বলে ব্রত। এই কামনার প্রতিচ্ছবিতে আলপনা মূর্ত হয়ে ধরা দেয়, প্রকাশ পায় লোকায়ত পরত। এ এক পূজারি-তন্ত্রমন্ত্র বর্জিত লোকায়ত অনুষ্ঠান, যার সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে পূজানুষ্ঠানের। পূজা সুনির্দিষ্ট সময়ে হয় সকলের জন্যই তার অনুষ্ঠান, ব্রতটি অনুষ্ঠিত হয় কোনো কিছু কামনা করে, ব্রতিনীর জন্যই এই অনুষ্ঠান। যতক্ষণ না পর্যন্ত কামনার পরিসমাপ্তি হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রত চলতে থাকে। কামনার শেষে ব্রতের উৎযাপন হয়।

ব্রতের প্রকারভেদ
অবনীন্দ্রনাথ উল্লেখ করছেন ব্রত দুই প্রকার — ১. শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক ব্রত এবং ২. মেয়েলী ব্রত। মেয়েলী ব্রত দ্বিবিধ — কুমারী ব্রত এবং নারী ব্রত (বিয়ের পর যা পালিত হয়)। পৌরাণিক ব্রতগুলি হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়েছে। মেয়েলী ব্রতগুলি পুরাণের পূর্বেকার বলে উল্লেখ করেছেন অবনীন্দ্রনাথ, যার মধ্যে প্রাক-হিন্দু ও হিন্দু ধর্মের একটা আদান-প্রদান চলেছিল বলে তিনি বিশ্বাস করেছেন।

শাস্ত্রীয় ব্রতে সামান্য কাণ্ড, ভূজ্জি-উৎসর্গ এবং ব্রাহ্মণ-দক্ষিণার পর ব্রতকথা-শ্রবণের আয়োজন করা হয়। ব্রত কেন পালন করা হবে, কীভাবে ব্রত পালনে রুচি আসবে — সে কারণেই ব্রতকথা শোনার আয়োজন। নারীব্রত হল শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় — এই দুই অনুষ্ঠানের সমন্বয় বা যুগলমূর্তি। এতে যেমন বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা বিলুপ্ত হয়েছে, পাশাপাশি লৌকিক সরলতা হারিয়ে উদয় হয়েছে পূজারী ব্রাহ্মণের অংশগ্রহণ; তাই ন্যাস-মুদ্রা-তন্ত্র-মন্ত্রের প্রাধান্য ঘটেছে। বরং লৌকিক সরলতার খাঁটিভাব পরিলক্ষিত হয় কুমারী ব্রতের মধ্যে। এ যেন হিন্দুধর্মের সুলভ সংস্করণ কুমারীর মনোজগতে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা! খাঁটি মেয়েলী ব্রতের ছড়ায় আর আলপনায় একটি জাতির মন, চিন্তা ও চেষ্টার ছাপ রয়ে যায়।

স্বামী নির্মলানন্দ ব্রতগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন —
১. কিছু ব্রত নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও চরিত্র গঠনের সহায়ক; যেমন কুমারী ও সধবা ব্রতের অনুষ্ঠান।
২. কিছু ব্রত শান্তিময় পারিবারিক জীবন গঠনের সহায়ক।
৩. কিছু ব্রত সামাজিক ও জাতীয় কল্যাণ সাধনের অভীপ্সাকে বাস্তবায়ন করার প্রেরণাদায়ক।
৪. কিছু ব্রত উৎযাপন গভীর আশ্বাস ও অভয়ের সহায়ক।
৫. কিছু ব্রত প্রবৃত্তির উদ্দাম প্রবাহ থেকে প্রত্যাবৃত্তের এবং নিবৃত্তির সহায়ক।

নানান মাসের ব্রতানুষ্ঠান
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পালিত হয় বসুধারা ব্রত। উদ্দেশ্য বসুধা বা পৃথিবীকে উর্বরা এবং শস্য-সবুজ করে তোলা। ফসলের জন্য জল লাগে, জলের জন্য বৃষ্টি, বৃষ্টি কামনায় এই ব্রত।
বৈশাখ মাসের আর একটি ব্রত হল দধিসংক্রান্তি। এটি সৌরজগত বিষয়ক একটি ব্রত। এছাড়া কলাছড়া ব্রত, ঘৃত সংক্রান্তি ব্রত, আদর সিংহাসন ব্রতও বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
অরণ্যষষ্ঠী/জামাইষষ্ঠী/বাঁটাষষ্ঠী ব্রত উৎযাপিত হয় জ্যৈষ্ঠমাসে। সুসন্তান কামনার এই ব্রত।
আষাঢ়মাসে নাগপঞ্চমী ব্রত অনুষ্ঠিত হয়; তাতে পূজিতা হন দেবী মনসা। সর্প পূজা এই ব্রতের অঙ্গ, ব্রত উৎযাপন করলে সর্পভয় নিবারিত হয়।
ভাদ্র মাসের একটি ব্রত হল ভাদুলি। বিদেশ-বিভূয়ে পরিবারের বাবা-দাদা-ভাইরা নিরাপদে থাকুক, ফিরে আসুক সুস্থ শরীরে, সেজন্যই এই ব্রতের উৎযাপন।
আশ্বিন মাসে পালিত হয় কোজাগরী পূর্ণিমা ব্রত (ধনসম্পদ লাভের ব্রত)।
অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাসে উৎযাপিত হয় রা’লদুর্গা ব্রত (সুখ, সম্পদ, ঐশ্বর্য ও মনস্কামনা পূরণের ব্রত)
মাঘ মাসে কুলাই ব্রত (বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য), শীতলা ব্রত (বসন্ত রোগ নিবারণের জন্য ব্রত),
চৈত্র মাসের ব্রতানুষ্ঠানের মধ্যে মহাবিষুব সংক্রান্তি ব্রত, ঘেঁটু ব্রত (চর্মরোগ নিবারণের জন্য ব্রত) উল্লেখযোগ্য।

বসুধারা ব্রত
ভারতের নারীরা পারিবারিক মঙ্গলের জন্য চৈত্র সংক্রান্তি থেকে টানা একমাস তুলসীমঞ্চতে তুলসীধারার ব্যবস্থা করেন। একটি মাটির হাঁড়িতে তলায় ছোটো একটি ফুটো করে, তাতে পলতের কাপড় প্রবেশ করিয়ে অতি ধীর ধারায় সেচের বন্দোবস্ত করেন তারা, একে বিন্দুপাতি সেচ বলা যেতে পারে, ইংরাজীতে Drip Irrigation। ভারতীয় নারী যে বসুধারা ব্রত পালনের অঙ্গ হিসাবে স্নান সেরে সেই ঝারায় জল ঢালেন এবং তুলসী পূজন করেন তাও তুলসী নামক এক পবিত্র ও ভেষজ উদ্ভিদের প্রতি ধন্যবাদাত্মক চিন্তন।

বাংলার নারী আবৃত্তি করেন, “তুলসী তুলসী নারায়ণ / তুমি তুলসী বৃন্দাবন /তোমার শিরে ঢালি জল/ অন্তকালে দিও স্থল।” যেন জীবনকালে এ এক মহার্ঘ ভেষজ আর অন্তিমকালেও জীবনের মায়াজাল থেকে মুক্তির মহৌষধি; বাংলার ব্রতেও তারই পুণ্য-পূজন। কবি অক্ষয় কুমার বড়াল ‘এষা’ কাব্যগ্রন্থে লিখছেন, “তোমার নিঃশ্বাসে / সর্বরোগ নাশে/যায় দুঃখ পলাইয়া।” নানান ব্যাধিতে বনবাসী কৌম সমাজ তুলসীর ব্যবহার করে থাকে; কখনো এর ব্যবহার সর্দিকাশিতে, কখনো লিউকোডারমা-র চিকিৎসায়, কখনো দাঁদের ক্ষত দূর করার জন্য কখনো বা ম্যালেরিয়া ঘটিত জ্বরনাশক রূপে।

প্রস্তুত প্রবন্ধে একটি ব্রতের বিস্তারিত আলোচনা করে ব্রতের উদ্দেশ্য, তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা যাক।

মাঘমণ্ডলের ব্রত
সাবেক পূর্ববঙ্গে প্রচলিত এবং প্রতি মাঘ মাসে পালিত পাঁচ বৎসর ব্যাপী সূর্যোপাসনা মূলক একটি কুমারীব্রত হল মাঘমন্ডল। এই ব্রতের দুটি মূল কৃত্য হল পঞ্চগুঁড়ির রঙ্গিন আলপনা অঙ্কন এবং ‘বারৈল’ বা ‘লাউল’ নামক মৃত্তিকা-প্রতীক নির্মাণ, ফুল-দূর্বা দিয়ে তার সাজসজ্জা ও পূজন। মাঘমন্ডল ব্রতে আঙ্গিনায় অঙ্কিত হয় ব্রতমন্ডল; তার উপরে গোলাকার সূর্য আর নীচে অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রকলা; মাঝে অয়ন-মন্ডল। অয়ন-চিহ্নের সংখ্যা দ্বারা উপলব্ধ হয় ব্রতের পূর্ণতার বৎসর।

আমার মা’র বাপের বাড়ি গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন, “এক বছরে এক গোলের আলপনা, দু’ বছরে দু গোলের। এক গোলের গায়ে আর একটি বৃত্ত দাগা…তিন বছরে তিনটি বৃত্ত, চার বছরে চারটি — আর পাঁচ বছরে পরপর রেখা টানা পাঁচটি বৃত্তের প্রকান্ড একটা আলপনা।”

মাঘ মন্ডলের ব্রতে পিটুলি গোলার আলপনা দেওয়া হয় না, দিতে হয় চালের গুঁড়ির সঙ্গে হলুদ, সিঁদুর, ধানের পোড়ানো তুষ, শুকনো বেলপাতার গুঁড়ো মিশিয়ে নানা বর্ণে রঞ্জিত করে রঙিন আলপনা। রোজই দেওয়া হয় এই আলপনা, দু’ আঙুলের টিপে গুঁড়ি নিয়ে আঙুল সামান্য নাড়িয়ে ঝুরঝুর করে ফেলে আঁকা হয় লতাপথ। পৌষের সংক্রান্তি থেকে মাঘের সংক্রান্তি পর্যন্ত চলে এই ব্রত।

‘হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান’ গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখছেন, “প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করিয়া ব্রতিনীকে দূর্বাগুচ্ছের সাহায্যে চোখে ও মুখে জল ছিটাইতে হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘চউখে মুখে পানি দেওয়া’। সূর্য উঠিলে পাঁচালি গান করিয়া ‘বারৈল’ ভাসান হয়।…বারৈল দুইটিকে ফুল দূর্বা দিয়া সাজাইয়া একখানি ছোটো তক্তার উপর বসাইয়া পুষ্করিণীর জলে ভাসাইতে হয়। ইহার পর মন্ডলের উপর ফুল দিতে হয়। পাঁচালিতে সূর্যের পূর্বরাগ ও বিবাহের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।”

গ্রামের কিশোরীরা কাকভোরে মাথা-ঘাড়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘন কুয়াশা ঠেলে তাদের মা কিংবা দিদা-ঠাকুমার সঙ্গে দু’পাশের ঝোপ ছাড়িয়ে, শিশিরে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে চলে ঘাটলায়। কে আগে ঘাটে যাবে যেন তার প্রতিযোগিতা চলে। জলের কাছে ঘাটে রাখা হয় বারৈল বা লাউল। তার সর্বাঙ্গ অতসী, টগর, কলকে, গাঁদা অথবা নানান বুনো ফুলে ঢাকা, কারণ তার গা দেখা গেলেই দোষ। আগের রাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল এই বারৈল।

“সূর্য উঠবেন, তাই তার পথ প্রশস্ত করতে কিশোরীরা সাজির ফুল জলে ছুঁড়ে সুর করে গায়, “খুয়া ভাঙ্গি খুয়া ভাঙ্গি এ্যাচলার আগে,/ সকল খুয়া গেল বড়ই গাছটির আগে।” ধীরে ধীরে বড়ই বা কুল গাছের মাথা পরিষ্কৃত হয়ে কুয়াশা দূরীভূত হয়, সূর্য ওঠে, তার আলোকিত করুণায় পৃথিবী সচল হয়। ‘বারো মাসে তেরো পার্বন’ গ্রন্থে স্বামী নির্মলানন্দ লিখছেন, “তিনি উদিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধোপা, নাপিত, কামার, কুমোর, তাঁতি, সুরি, তিলি, মালী সকলকে জাগিয়ে তোলেন, সকলের গৃহই তিনি আলোকিত করেন, তখন প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্তব্যে ব্রতী হয় — সমগ্র জগৎ কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণ বধূ উপবীত, তন্তুবায় বধূ বস্ত্র, কর্মকার বধূ মাল্যাদি সরবরাহে ব্যস্ত হয়। ব্রতের ছড়ার ভিতরে এ দৃশ্যের এক চমৎকার বর্ণনা পরিস্ফুট। সামাজিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের একটা পরিষ্কার ছবি কুমারীদের অন্তরে স্বতঃ জাগ্রত হয়। ব্রতের ছড়ার মধ্যে এ রকম অনেক শিক্ষাই আছে।”

সূর্যের মত এক পাত্র পেলে মাধবের আপত্তি থাকার কথা নয়, তাই সুসম্পন্ন হয়ে গেল তাদের শুভবিবাহ। সূর্য পেলেন অজস্র দান সামগ্রী। কী নেই তাতে; আর হবেই বা না কেন? মাধব যে লক্ষ্মীপতি! অতএব বিয়ের পর চন্দ্রকলা চললেন পতিগৃহে; আর এখানেই দেখানো হয়েছে বিচ্ছেদ আর মিলনের বেদনা-সুখের আনন্দঘন মুহূর্ত, পল্লী বাংলার চিরায়ত আবেগসঞ্চার। ব্রতিনীদের জীবনেও আসবে এই দিন; মা-বাবা-ভাই-বোন, প্রিয়জন, ক্রীড়াসহচরীদের ছেড়ে যেতে হবে স্বামীগৃহে। আবার মিলনসুখ অপেক্ষা করছে সেখানে, মিলনানন্দের আবেগ, লোকলাজ — সব মিলিয়ে এ এক দুঃখ-সুখের যুগলবন্দী!

মাঘমন্ডল ব্রতের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন-অঙ্কে বিভক্ত ব্রতের ছড়ার অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন,”এই মাঘমন্ডল-ব্রতের প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে যে সূর্য যা, তাঁকে সেই-রূপেই মানুষে দেখছে এবং বিশ্বাস করছে যে, জলের ছিটায় কুয়াসা ভেঙে দিলে সূর্য-উদয়ের সাহায্য করা হবে। এখানে কামনা হ’ল সূর্যের অভ্যুদয়। ক্রিয়াটিও হ’ল কুয়াসা ভেঙে দেওয়া ও সূর্যকে আহ্বান।

দ্বিতীয় অংশে চন্দ্রকলাকে দীর্ঘকেশ গোল-খাড়ুয়া-পায়ে একটি মেয়ে এবং সূর্যকে রাজা বর এবং সেই সঙ্গে সূর্যের মা ও চন্দ্রকলার বাপ কল্পনা করে মানুষের নিজের মনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি যে-সব ছবি আছে, সূর্যের রূপকের ছলে সেইগুলোকে মূর্তি দিয়ে দেখেছে।

তৃতীয় অংশে সূর্য-পুত্র বা রায়ের পুত্র রাউল বা লাউল, এক-কথায় বসন্তদেব; টোপরের আকারে এঁর একটি মূর্তি মানুষে গড়েছে, এবং সেটিকে ফুলে সাজিয়ে মাটির পুতুল হালামালার সঙ্গে বিয়ের খেলা খেলেছে। এখানে কল্পনার রাজ্য থেকে একেবারে বাস্তবের রাজ্যে বসন্তকে টেনে এনে, মাটির সঙ্গে এবং ঘরের নিত্যকাজের এবং খুঁটিনাটির মধ্যে ধরে রাখা হলো”।

মাটির সঙ্গে সূর্যের ছেলে বসন্তদেব বা লাউলের বিয়ে আর মিলনের পালাও শেষ। ঋতুরাজ পৃথিবীকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। তাকে যেতেই হবে, একলাই, আবার শীতের মধ্যে বসন্ত হয়ে ফিরবেন, এখন বিদায়।

ঋতুরাজকে বিদায় দিতেই হল — “আজ যাও লাউল,/কাল আইসো।/নিত নিত্য দেখা দিও।/বছর বছর দেখা দিও।”
অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে দেখা যায় মৎস্যজীবী মালো মেয়েরা নিষ্ঠা ভরে মাঘমন্ডলের ব্রত করছে। মাঘমাসের প্রতিদিন সকালে কুমারী মেয়েরা স্নান করে ভাঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জলে সিঁড়ি পুজো করে উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র আওড়ায়। বিবাহের কামনাতেই এই ব্রত।

ব্রতের শেষদিন তৈরি হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি, সেই চৌয়ারি মাথায় করে ভাসানো হয় তিতাসের জলে। অক্ষত চৌয়ারির দখল নিতে কিশোরেরা হুল্লোড় করে ওঠে। উঠোন জোড়া আলপনার মাঝে কিশোরী ছাতা মেলে বসে, তার মা ছাতার উপর ছড়িয়ে দেয় খই-নাড়ু, আর তা কাড়াকাড়ি করে খায় কিশোরেরা।

লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img