হোমরাজ্যআরও এক বিধায়কের বিজেপি ত্যাগ, প্রশ্নের মুখে শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

আরও এক বিধায়কের বিজেপি ত্যাগ, প্রশ্নের মুখে শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

আরও এক বিধায়কের বিজেপি ত্যাগ, প্রশ্নের মুখে শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

দলে ভাঙন আটকাতে আচমকা দিলীপ ঘোষকে বঙ্গ বিজেপির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তড়িঘড়ি রাজ্য সভাপতি করা হয়েছিল সুকান্ত মজুমদারকে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে কই?
এবার দল ছাড়লেন রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী। দলের বিধায়ক সংখ্যা এখন ৭০-এ নেমে এসেছে। এবার জল্পনা তৈরি হয়েছে খড়গপুরের বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। রাজনৈতিক মহলের খবর, দিলীপ ঘোষের তাঁর মুখ দেখাদেখি নাকি বন্ধ। দলের কোনও কর্মসূচিতেও তৃণমূলত্যাগী হিরণকে দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূল শিবিরের দাবি, “আরও অনেক বিধায়ক লাইনে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, এমন নেতাও দল ছাড়তে পারেন, যা কল্পনাও করতে পারবে না।”

দিলীপবাবু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে সফল রাজ্য সভাপতি। কেন তাঁকে মেয়াদ ফুরনোর আগে এভাবে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া হল? এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা চললেও, পাশাপাশি উঠে আসছে আরও একটি প্রশ্ন। তা হল, দিলীপবাবুকে সরিয়ে বিজেপির আদৌ কোনও ফায়দা হবে কি? এই অপসারণ রাজ্যে বিজেপির সংগঠনকে কি আরও ব্যাকফুটে ঠেলে দেবে? শুভেন্দু অধিকারীকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি বাংলায় দলকে আরও ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন? এই সব প্রশ্ন নিয়েও রাজ্য পদ্মশিবিরের অন্দরে জোর আলোচনা চলছে।

একথা ঠিক, দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বেশ কয়েকজন নেতার সংঘাত বারেবারে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন, শুভেন্দু অধিকারী, স্বপন দাশগুপ্ত, তথাগত রায়, বাবুল সুপ্রিয়, মুকুল রায়, রাহুল সিনহা প্রমুখ। দিলীপের সঙ্গে এই নেতাদের বিরোধই রাজ্যে বিজেপির মধ্যে একধরনের অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। ভোটের পর মুকুল তৃণমূলে ফিরে গেছেন। এরপর জোড়াফুলে নাম লিখিয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তাই বিজেপি এমন একজন খোঁজ করছিলেন, যিনি সব শিবিরের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন।

বিজেপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ২ বারের বেশি সভাপতি পদে থাকতে পারেন না। সেই হিসেবে আগামী নভেম্বরে দিলীপের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ মাত্র ২ মাস সময়। তারপরই স্বাভাবিক নিয়মে তাঁকে সরে যেতে হত। কিন্তু এই সময়টুকু কেন অপেক্ষা করতে পারলেন না অমিত শাহ-জে পি নাড্ডারা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি করা হয়েছিল। মুকুলের ওই পদে এখন দায়িত্ব ভার সামলাবেন দিলীপ ঘোষ।

রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, “দিলীপ ও শুভেন্দুর মধ্যে যে বনিবনা হচ্ছে না, তা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরে এসেছে। বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর পর দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছেন শুভেন্দু। দলের একের পর এক সাংসদ, বিধায়ক যেভাবে তৃণমূলে চলে যাচ্ছেন, তা আটকাতে শুভেন্দুর ওপরই বেশি ভরসা করছেন শাহ-নাড্ডারা। তাই শুভেন্দুর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করতে পারবেন, এমন নেতাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।”

নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির অধ্যাপক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আর এস এস) তাঁর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। ২০১৯-এ তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন এবং বালুরঘাট থেকে বিজেপির সাংসদ নির্বাচিত হন। ‘লো প্রোফাইলে’ থাকা মৃদুভাষী সুকান্তবাবু কি দিলীপের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারবেন?

এ নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত হল, সভাপতি হিসেবে সুকান্তবাবু কতটা সফল হবেন, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে তিনি যে আরএসএসের মদত পুরোপুরি পাবেন, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বারবার বেফাঁস মন্তব্য করে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন দিলীপ। সেদিক থেকে সুকান্তবাবু শব্দচয়ন বা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংযত হবেন বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।

সুকান্তকে যেমন আকস্মিকভাবে রাজ্য সভাপতি করা হয়েছে, অনেকটা একইভাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন দিলীপ। দীর্ঘকাল আরএসএসের সঙ্গে জড়িত থাকার পর ২০১৪তে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন দিলীপ। তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫তে তিনি দলের রাজ্য সভাপতি হন। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত করেন কংগ্রেসের জ্ঞান সিং সোহন পালকে। আর ২০১৯-এর ভোটে লোকসভার সদস্য হন তিনি।

২০১৫-র ডিসেম্বরে দিলীপবাবু রাজ্য বিজেপির সভাপতি হয়েছিলেন। ২০১৮-র ডিসেম্বরে তাঁর প্রথম দফার কার্যকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরের বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ২০২০-র জানুয়ারিতে ফের সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই হিসেবে ২০২৩-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁর কার্যকালের মেয়াদ ছিল। দলের একটি অংশের বক্তব্য, ২০১৮-র ডিসেম্বর থেকেই দ্বিতীয়বার সভাপতি কাজ শুরু করেছেন দিলীপবাবু। তাই এ বছরের নভেম্বরে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

দিলীপের অপসারণের কারণ হিসেবে দলের কেউ কেউ রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তীর সম্পর্কের অবনতির কথা উল্লেখ করছেন। অন্যদিকে আরএসএসের প্রচারক অমিতাভর সঙ্গে
সুকান্তর যথেষ্ট ভালো বোঝাপড়া রয়েছে।

রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব উত্তরবঙ্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই উত্তরবঙ্গের একজন সাংসদকে সভাপতি করা হয়েছে।

সাংসদ জন বার্লা সহ একাধিক নেতা পৃথক উত্তরবঙ্গ গড়ার দাবি তুলেছেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের সময় উত্তরবঙ্গের দুজন সাংসদকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। এর পিছনে বিশেষ অঙ্ক কাজ করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। রাজ্যে ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে উত্তরবঙ্গে রয়েছে ৮টি। আর ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে উত্তরবঙ্গে রয়েছে ৫৪টি। এবারের ভোটে উত্তরবঙ্গে ৩০টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি নেতার বক্তব্য, সুকান্তবাবুকে রাজ্য সভাপতি পদে বসানো নিয়ে দলের মধ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ না থাকলেও, শুভেন্দু অধিকারীকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাতে রীতিমতো রুষ্ট দলের একটা বড় অংশ। এঁদের বেশিরভাগই দিলীপ ঘোষের অনুগামী। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার মতে, শুভেন্দু যেভাবে জামাই আদর পাচ্ছেন, তাতে আদি বিজেপি নেতারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

দলের চাপে শুভেন্দুকে বিরোধী নেতা হিসেবে মেনে নিলেও, বিধায়কদের বড় অংশ বিদ্রোহের পথে হাঁটবেন না, এমন নিশ্চয়তা কিন্তু মিলছে না। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিতে আগামী শুভেন্দুর গুরুত্ব কতটা বজায় থাকবে, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।

সুকান্তবাবু রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর দিল্লিতে সর্বভারতীয় জে পি নাড্ডার সঙ্গে যে বৈঠক করতে গিয়েছিলেন, তাতে ডাক পেয়েছিলেন দিলীপ ঘোষও। কিন্তু সেই বৈঠকেশুভেন্দুকে ডাকা হয়নি। এর থেকে স্পষ্ট, বিধানসভায় শুভেন্দুকে বিরোধী দলনেতার আসনে বসানো হলেও, আগের মতো তাঁকে ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। একের পর এক বিধায়কের দল ছাড়ায় ঘটনায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিধায়কদের ওপর শুভেন্দুর তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই।

নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রীকে হারানোর পুরস্কার হিসেবে তাঁকে বিরোধী দলনেতা করা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শুভেন্দু এখন আর ততটা আস্থাভাজন নন। তৃণমূলের ঘর এলোমেলো করার ছক কষেই শুভেন্দুকে মদত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছেন, শুভেন্দু আসলে কাগুজে বাঘ ছাড়া কিছুই নন। যতটা গর্জন করেছিলেন, বর্ষণ কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি।

তবে তাঁকে দলে গুরুত্বহীন করার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে। সুকান্ত এবং দিলীপ, দুজনেই আর এস এস থেকে উঠে আসা নেতা। দুজনে যতটা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারবেন, শুভেন্দুর পক্ষে তা সম্ভব হবে না। তাই অভিজ্ঞ দিলীপবাবুই সুকান্তর কাছে বেশি গুরুত্ব পাবেন। শুধু তাই নয়, বিজেপির পুরনো নেতাকর্মীদের তিনি যে বাড়তি গুরুত্ব দেবেন, তা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সবশেষে বলা যায়, বিধায়কদের দলত্যাগ এখন শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img