দেবস্মিতা নাগ
অনেক বাঙালিরই মনে মনে একটা ইচ্ছে থাকে, সারা জীবন থেকে নিদেনপক্ষে দুটো দিন দুর্গাপুজোর সাবেকি বনেদিয়ানা, তার সেই রাজকীয় জাঁকজমক প্রত্যক্ষভাবে উপভোগ করার, ইচ্ছে থাকে কোনও শতাব্দীপ্রাচীন রাজবাড়ির দুর্গোৎসব সেখানে উপস্থিত থেকে সরাসরি স্বচক্ষে দেখার।
সেই সুযোগ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে আমদপুরের চৌধুরী জমিদার বাড়ি। তাও আবার কলকাতা থেকে মাত্র 100 কিলোমিটারের মধ্যে। বর্ধমান জেলার মেমারির কাছে ঘন সবুজের মাঝে আজও মাথা উঁচু করে জেগে আছে 400 বছরের পুরনো জমিদারবাড়ি। পুজোর সময় সেজে ওঠে এ বাড়ির টেরাকোটার সমস্ত মন্দির-দুর্গাবাড়ি, রাধামাধব মন্দির, আনন্দময়ী কালীমাতা মন্দির ও শিব মন্দির।
এ বাড়ির রথ, দীঘি, আমবাগান এবং সিংহদুয়ারটিও দেখার মতন। অট্টালিকার শীর্ষে দাঁড়ানো দুটি সিংহমূর্তির মুখ থেকে বৃষ্টির জল ফোয়ারার আকারে বেরিয়ে আসার ব্যবস্থা রয়েছে। কেবল দুর্গোৎসবই নয়, উৎসবের পসরা সাজিয়ে অট্টালিকাটি বারোমাসই অভ্যাগতদের সমাদর করে। অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় কালীপূজা, কার্তিকপূজা, রাস, সরস্বতী পূজা, দোলযাত্রা ইত্যাদি উৎসব।
চৌধুরী পরিবার ষোড়শ শতকে এই এলাকায় বসবাস করা শুরু করে। দুর্গা ও রামকে কেন্দ্র করে বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনীর চিত্র আটচালা মন্দিরগুলির গায়ে টেরাকোটার ফলকে আঁকার ভঙ্গি সেই সময়েরই সাক্ষ্য বহন করে।
রাজবাড়ির ঘরগুলোতে অতিথিদের জন্যে থাকার নানারকম ব্যবস্থা রয়েছে। কোনোটায় দুজনের, কোনোটায় তিনজনের, কোথাও বা চারজনের শয্যা রয়েছে। রাজবাড়ির কিছু বিছানা এতই উঁচু যে দুতিন ধাপ সিঁড়ি বাইতে হয়। বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হাল্কা ও সম্পূর্ণ সাবেক কালের বাঙালি ঢংয়ের। সমস্ত রান্নাই হয় হাতে বাটা মশলায়, এটাই এখানকার রান্নার বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে পোস্তর পদগুলো মোটেই ছেড়ে দেওয়া উচিত না। শেষ পাতের মিষ্টি দই হলো এখানকার বিশেষ আকর্ষণ।এখানে এসে ভোজনরসিকরা একেবারেই হতাশ হবেন না।
এখানে দীঘিতে স্নান করা এবং মাছ ধরাও যেতে পারে। মাটির ঘরে থাকার সুব্যাবস্থাও রয়েছে। সব রকমের ঘরেই এসি, সংলগ্ন ওয়াশরুম ও তাতে 24 ঘন্টা গরম জলের ব্যবস্থা রয়েছে। অট্টালিকার চারপাশের গ্রামটি হেঁটে ঘুরে দেখতে গেলে, দেখা মিলবে একটি হাজার বছরের পুরনো বটগাছের।কথিত আছে এই বটগাছের নীচে নারহরি বাবা বলে এক সাধু একটি গহ্বরে বহুদিন ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁর সঙ্গে থাকত দুটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সে গহ্বরটি আজও রয়েছে। এখানে নিশঙ্ক আশ্রম বলে একটি আশ্রমও রয়েছে।
এই রাজবাড়ি একাদশ বা দ্বাদশ শতকের শ্রীবৎস সেন শর্মার বংশের রাজবাড়ি। বংশের জমিদার কৃষ্ণ রাম সেন শর্মা মোগল আমলে চৌধুরী উপাধি পান। রাজবাড়ির দুর্গাবাড়ি বা ঠাকুর দালানটি 350 বছরের প্রাচীন। এইখানে দুর্গাপূজা 5 দিনের নয়, এই পূজা 19 দিন ধরে উদযাপনের করা হয়।
এখানে আসতে হলে হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমানগামী কোনো ট্রেন চড়ে মেমারি স্টেশনে নামলেই চলবে। কারণ সেখান থেকে জমিদারবাড়ি মাত্র মিনিট দশেকের পথ। অথবা এই করোনা আবহে একটা গাড়ি নিয়েও সপ্তাহান্তে চলে যাওয়া যেতে পারে। পুজোর কটাদিন রাজবাড়ির আতিথেয়তায় কাটালে সারাজীবনের মত ইতিহাসের পথে হেঁটে যাওয়ার একটা স্মৃতিনির্মাণ হবে।
অট্টালিকার সুবিশাল ছাদে গোধূলির আলোয় আদিগন্ত এস্টেটের সীমানায় সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মনের ভিতর চলতে থাকা প্রতিদিনের ছোট খাট হিসেব নিকেশ-ঝুট ঝামেলা।