হোমফিচারChilli : লঙ্কা কেন ঝাল? বিবর্তনের অজানা গল্প

Chilli : লঙ্কা কেন ঝাল? বিবর্তনের অজানা গল্প

Chilli : লঙ্কা কেন ঝাল? বিবর্তনের অজানা গল্প

suman pratihar সুমন প্রতিহার

রাবারের গ্লাভসটা হাতে গলিয়ে নিলেন, তারপর লঙ্কার লাল প্রলেপ হাঁটুর ব্যথায় লাগিয়ে দেওয়া হল। প্রলেপ থাকবে যতক্ষণ না তীব্র গরমের অনুভূতি হয়। পিঠে ব্যথার জন্যও আছে লঙ্কার প্রলেপ লাগানো ব্যান্ডেজ। ক্যাপসাইসিন চিকিৎসা পদ্ধতি। ক্যাপসাইসিন (Capsaicin) হলো সেই রাসায়নিক, যার উপস্থিতিতে লঙ্কার ঝালের বাহার। তবে ক্যাপসিকাম (capsicum) গণের গাছগুলোকে ঝালের এই রাসায়নিকটি তৈরি করার জন্য মূল্য চোকাতে হয়েছে। বিবর্তনের বহু চরাই-উতরাই পেরিয়ে পৃথিবী জুড়ে আজ লঙ্কার (Chili Pepper) দাপটে চোখে জল।

প্রায় সাত হাজার বছর আগে আমেরিকায় আধুনিক মানুষের পূর্ব পুরুষেরা আসেন। অদ্ভুত সে ভূখণ্ড। প্রাণী হিসেবে অদ্ভুত আর্মাডিলো, খাদ্য হিসেবে আলু আর ছোট গাছে লাল হয়ে থাকা ফলগুলো দেখে অবাক হয়েছিল। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে আদি আমেরিকানরাই শুরু করেন লঙ্কার বাগান। চিলি, কলম্বিয়াতে সম্ভবত শুরু হয়েছিল পৃথিবীর আদিমতম মশলা – লঙ্কা চাষ। ধীরে ধীরে ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়ে মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকোতে।

আবার অন্য একটা মতে দাবি, আট হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে শুরু হয়েছিল লঙ্কার রোপন। লঙ্কার গাছগুলির উৎপত্তি সম্ভবত এক থেকে দুই কোটি বছর আগে টম্যাটো, তামাক জাতীয় গাছ থেকে।

বিবর্তনের সঙ্গেই গাছগুলোকে খুঁজতে হয়েছিল তাদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিনব কোনও পদ্ধতি। বংশ বিস্তারের জন্য সফলভাবে বীজ ছড়িয়ে দিতে পারলেই সাফল্য। সেই সঙ্গে নিতে হয়েছিল ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার কৌশলও। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নতুন হাতিয়ার, তৈরি হল ক্যাপসাইসিন – লঙ্কার বীজের চারিদিকে একটি বিশেষ কলার আবরণ।

ঠিক কীভাবে এই ক্যাপসাইসিন সংশ্লেষ শুরু হয়েছিল, তা বোঝা না গেলেও, সম্ভবত জিন ডুপ্লিকেশন এই ঘটনার সহায়ক ছিল। বেশ বড় আকারের যৌগ ক্যাপসাইসিন। আবার তৈরি করতে অনেক নাইট্রোজেনের (Nitrogen) প্রয়োজন হয়। গাছেদের দিক থেকে বিচার করলে বেশ ব্যয়বহুল। খরার সময় ক্যাপসাইসিন যুক্ত গাছগুলোর বিস্তর সমস্যা। তৈরি হয় কম বীজ, ক্যাপসাইসিনহীন গাছগুলোর থেকে প্রায় অর্ধেক। মানে কম জলে গাছগুলির বংশ রক্ষা করা বেশ সমস্যার।

হোক সে সমস্যা, কিন্তু টিকে তো থাকতে হবে এবং সেইসঙ্গে বংশগতির তাগিদে গাছগুলিকে ক্যাপসাইসিন উৎপাদন পদ্ধতি বজায় রাখতে হয়েছিল। সমস্যাটা শুরু হলো ক্যাপসাইসিন যে ঝালের অনুভূতি নিয়ে আসে। ঝাল কোনো স্বাদ না, নেই এর জন্য কোনো বিশেষ স্বাদ কোরকও, ঝাল মানে একটা তীব্র জ্বালা এবং গরমের অনুভূতি – স্নায়বিক।

বিপদে পড়লো লঙ্কার গাছ গুলো। কোন প্রাণী লঙ্কা গাছের ফল খেতে এগিয়ে এলো না। বংশবিস্তারে শুরু হল সঙ্কট। সঙ্কট যদি আসে প্রকৃতিতে, বিবর্তন বলে দেয় উত্তর। এক্ষেত্রে প্রকৃতির বার্তাবাহক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল পাখিকে। তবে কি পাখির ঝাল লাগে না!

পাখিদের ঝালের অনুভূতি নেই। সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীর শরীরে রয়েছে TRPV-1 নামে একটি রিসেপ্টর, এরা প্রান্তীয় এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রয়েছে। এই রিসেপ্টরগুলোর সঙ্গে ক্যাপসাইসিন রাসায়নিকটি যুক্ত হলে তীব্র গরম এবং জ্বালা ও যন্ত্রণার অনুভূতি নিয়ে আসে। বিবর্তনে এই বিশেষ রিসেপ্টরটি পাখিদের ক্ষেত্রে অচল ফলে তারা লঙ্কা তো খায় কিন্তু ঝালের টের টি পায়না। পাখিদের দাঁত নেই, পরিপাকতন্ত্রে বীজগুলো নষ্ট হয় না। উপরন্তু বিস্তীর্ণ এলাকায় লঙ্কার বীজগুলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।

পাখির ডানায় ভর করে লঙ্কার বিশ্ব পরিক্রমা শুরু হয়েছিল। ক্যাপসাইসিন রাসায়নিকটি লঙ্কার গাছগুলিকে পোকামাকড় এবং ছত্রাকঘটিত রোগ থেকে সুরক্ষা দিতেও সক্ষম হয়েছিল। ঠিক সেই কারণেই প্রাণঘাতী ছত্রাকের বিস্তৃতি লঙ্কার উপরে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। অন্যদিকে মানুষ খাদ্যদ্রব্য সতেজ ও ছত্রাকমুক্ত রাখতে লঙ্কার ব্যবহার শুরু করেছিল। সাড়ে 6 হাজার বছর আগে ভুট্টা খাদ্যশস্যের সঙ্গে লঙ্কার উপস্থিতির প্রমাণ বিজ্ঞানে রয়েছে।

কিন্তু মানুষ লঙ্কা খায় কেন। মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে, সহ্য করেছে লঙ্কার তীব্র দহনের অনুভূতি। তবুও? TRPV-1 রিসেপ্টরগুলোতে ক্যাপসাইসিন রাসায়নিক যুক্ত হওয়ার পরে, ক্যালসিয়াম চ্যানেল খুলে যায়। পর্যায ক্রমিক কিছু ঘটনা ক্রমান্বয়ে নিয়ে আসে তীব্র অনুভূতি। মস্তিষ্কে ক্ষরণ হয় দুটো হরমোন। এনডরফিন যা জ্বালা, যন্ত্রণা ভোলাতে কাজে লাগে, আর ক্ষরিত হয় ডোপামিন। লঙ্কা খাবার পরে ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্ককে বোঝাতে থাকে এই প্রাথমিক দহন সহ্য করতে পারলেই রয়েছে মানসিক সন্তুষ্টি ও আনন্দাভূতি।

আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছি লঙ্কার প্রেমে। আর এই প্রীতির কারণে আমরা আজ পাখিদের হারিয়ে এক নম্বরে। সারা পৃথিবীতে মানুষই এখন লঙ্কার বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাথমিক কাজটি করে। চোদ্দো শতকের শেষের দিকে কলম্বাসের আমেরিকা আগমনের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে লঙ্কার ঝাঁঝালো প্রকাশ শুরু হয়। কলম্বাসের আদেশে দক্ষিণ আমেরিকায় গোলমরিচ ও দারুচিনির সন্ধানে একটি দল লঙ্কার খোঁজ পায়।

তবে ভারতে লঙ্কার প্রবেশ ভাস্কো-দা-গামার হাত ধরে, যা সময়ের সঙ্গে ইংরেজদের কাছে জনপ্রিয় হতে শুরু করে লঙ্কার লালে “ম্যাড্রাস কারী” হিসেবে। উত্তর আমেরিকায় লঙ্কার প্রবেশ আফ্রিকার এক দাসের হাত ধরে। জনৈক সেই ব্যক্তি উত্তর আমেরিকায় নিজের কুঁড়ে ঘরের বাইরে লঙ্কার বীজ বপন শুরু করেছিল। লঙ্কা পৌঁছলো চিনেও পর্তুগীজদের সৌজন্যে। সিল্করুটেও লঙ্কার ঝাঁঝ ছিল। ঝাঁঝ তো বললেই হলো না। মাপতে হবে।

স্কভায়িল স্কেল (scoville scale) লঙ্কার “হটনেস”-এর মানদণ্ড। আমরা যে লঙ্কা খাই, মানদণ্ডে তার স্কোর মেরেকেটে পঁচিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার। তবে অরুণাচল প্রদেশ চাষ হওয়া ভূত জলকীয়া (Ghost pepper) বিশ্বে হটনেসে তৃতীয়। স্কোর দশ লক্ষ। ক্যারোলিনা রিপার ( Carolina reaper) কুড়ি লক্ষ স্কোর নিয়ে পয়লা নম্বর। আমেরিকার ক্যারোলিনা প্রদেশ এদের ঠিকানা। যা প্রাণঘাতীও হতে পারে। তবুও আধুনিক মানুষের লঙ্কা প্রীতির কারণটা তো বোঝা গেল না। শুধুই কি অনুভূতি, আনন্দ নাকি সবটাই ডোপামিনের ম্যাজিক। স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও লঙ্কার ঝাল আর হরর মুভি অনেকটা সমগোত্রীয় নয় কি।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img