ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
বর্তমান বিশ্বব্যাপী অতিমারী, যা আমাদের ছন্দে বাঁধা রোজকার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে, তার পিছনে রয়েছে কোভিড ১৯ (Covid 19) নামে অতিক্ষুদ্র একটি মারণভাইরাস। কোভিড ১৯ যা করোনা (Corona) নামেই বেশি পরিচিত, মূলত মানব শরীরের শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি, থুতু থেকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র কণা বা ড্রপলেট (Droplet) বাতাসে ভর করে অন্যের শরীরে প্রবেশ করে, প্রধানত নিঃশ্বাসের মাধ্যমে। এই ভাইরাস ফুসফুসে পৌঁছে অতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে শরীরকে কাবু করে ফেলে। করোনা রোগের প্রধান উপসর্গ জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা। এছাড়াও কোনও কিছুর স্বাদগন্ধ বুঝতে না পারা, পেটের গোলমাল, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি তো রয়েইছে।
ড্রপলেটের মাধ্যমে সরাসরি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যের শরীরে প্রবেশ ছাড়া অন্যভাবেও করোনার সংক্রমণ হতে পারে। করোনার জীবাণু টেবিল, চেয়ার, মোবাইল, ল্যাপটপ, চায়ের কাপ, কলম, চিরুনি, দরজার হাতল ইত্যাদি নানা নিত্যব্যবহার্য জিনিসের উপরে অনেকক্ষণ সজীব থাকে। কোনো ব্যক্তি করোনা রোগীর ব্যবহৃত এই ধরনের জিনিস হাত দিয়ে ছুঁয়ে, সেই হাত বা আঙুল নাকে বা মুখে স্পর্শ করলে, তারও এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। একইভাবে সেই আঙুল চোখে লাগালে বা চোখ ডললে করোনা ভাইরাস চোখে প্রবেশ করে, আর নেত্রনালীর মাধ্যমে গলায় পৌঁছে ফুসফুসকে আক্রমণ করে। এছাড়াও ড্রপলেটের মাধ্যমে নাকমুখের মত সরাসরি চোখ দিয়েও এই ভাইরাস শরীরে ঢুকতে পারে।
একথা প্রমাণিত যে চোখেও করোনা হতে পারে। করোনায় সংক্রমিত রোগীদের প্রায় ৩ শতাংশের চোখে কনজাংটিভাইটিসের লক্ষণ দেখা গেছে। সেগুলি সাধারণ কনজাংটিভাইটিস বা জয়বাংলা রোগের মতই। চোখ লাল হয়ে যায়, কড়কড় করে। এছাড়া চোখ থেকে জলপড়া, পিচুটিতে চোখের আইল্যাশগুলি জুড়ে যাওয়া, ব্যথা, আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট, ঝাপসা দৃষ্টি ইত্যাদি আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলি তো থাকেই। এই ধরনের কনজাংটিভাইটিস যথাযত চিকিৎসায় সহজেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কনজাংটিভাইটিসের সঙ্গে জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট কিম্বা ঘ্রাণের সমস্যা জাতীয় করোনার অন্যান্য উপসর্গ থাকলে ডাক্তারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। করোনার সন্দেহটা দৃঢ় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করোনা পরীক্ষা (RT PCR) করে নেওয়া দরকার।
চোখের বাইরের সাদা আবরণটি (Sclera) কনজাংটিভা নামে পাতলা ঝিল্লি বা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। স্বচ্ছ কনজাংটিভার মধ্যে অসংখ্য সূক্ষ রক্তনালী, যা খালি চোখে দেখা যায় না, চোখকে পুষ্টি সরবরাহ করে। কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া কনজাংটিভায় বাসা বাঁধলে কনজাংটিভায় রক্ত চলাচল বেড়ে টকটকে লাল হয়ে যায়। আর কনজাংটিভাইটিসের নানা উপসর্গ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। করোনা ভাইরাসের বেলাতেও একই ব্যাপার ঘটে। অর্থাৎ কনজাংটিভাইটিস, তা করোনা ভাইরাস বা অন্য যেকোনো ভাইরাসের সংক্রমণে ঘটুক না কেন, উপসর্গগুলি প্রায় একই থাকে।
তাহলে ভয় পাওয়ার কীআছে? কনজাংটিভাইটিস তো তেমন মারাত্মক অসুখ নয়? ঠিকই, করোনা কনজাংটিভাইটিস বা সাধারণ কনজাংটিভাইটিস, কোনো ক্ষেত্রেই চোখের বিশেষ ক্ষতি হয় না। প্রচলিত চিকিৎসাতেই ভালো সাড়া পাওয়া যায়। তবে কনজাংটিভা ছাড়াও চোখের পাতা, কর্নিয়া, আইরিশ ইত্যাদি অঞ্চলেও ভাইরাস নিজের ক্ষমতা জাহির করতে পারে। সেক্ষেত্রে দৃষ্টির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই সাবধানের মার নেই।
কনজাংটিভাইটিসের উপসর্গগুলি মোটামুটি সবারই জানা আছে। তবুও একবার জেনে নেওয়া যাক। চোখ টকটকে লাল হয়ে ফুলে ওঠে, চোখে কড়কড়ে ভাব, চোখ থেকে প্রচুর জলপড়ে, আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট হয়, চোখের পাতা আর আইল্যাশগুলি পিচুটিতে আটকিয়ে যায়, সবকিছু ঝাপসা দেখায়, চোখে অস্বস্তি আর ব্যাথা থাকে।
কী কী সাবধানতা?
কঠোরভাবে করোনা-প্রতিরোধ বিধি মেনে চলতে হবে।
ভুলেও চোখে হাত দেবেন না।
সবসময়ে চশমা পরে থাকুন। চশমা পরবার দরকার না থাকলেও পাওয়ারবিহীন চশমা বা সানগ্লাস পরুন।
কিছুদিনের জন্য কন্টাক্ট লেন্স এড়িয়ে চলুন। কন্টাক্ট লেন্সে সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশী।
নিজের চিকিৎসা নিজে না করে, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন।
ছোটোদের চোখে হাত না দেওয়া, অন্যদের থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি সতর্কতাগুলির প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন।
মনে রাখা দরকার আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের জল, পিচুটি ইত্যাদির মাধ্যমে করোনা সংক্রমিত হতে পারে।
কনজাংটিভাইটিসের সঙ্গে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে সময় নষ্ট না করে করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিন।
নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে রাখুন। সব সময় মাস্ক পরে থাকুন। বারবার হাত স্যানিটাইজ করে নিন।
কখন বেশী সাবধান হতে হবে ?
ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ইত্যাদি অসুখ থাকলে।
চোখের দৃষ্টি হঠাৎ কমে গেলে বা চোখে আলোর ঝলক, মাছির মত কালো বিন্দু দেখলে ।
কনজাংটিভাইটিসের সঙ্গে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে।
সম্প্রতি কোনো করোনা রুগীর সংস্পর্শে এসে থাকলে।
কী করবেন কী করবেন না
যদি চোখের হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতেই হয়, N95 বা সার্জিকাল মাস্ক পরে থাকবেন, সারাক্ষণ।
রোগীর ওয়েটিংরুমের বদলে ক্লিনিকের বাইরে বা নিজের গাড়িতে অপেক্ষা করুন।
চেম্বারের মধ্যে যথাসম্ভব কম কথা বলুন। আপনার উপসর্গ বা অন্যান্য বক্তব্য কাগজে লিখে আনুন।
যতক্ষণ ডাক্তারবাবু আপনার চোখ পরীক্ষা করবেন, কোনো কথা বলবেন না, জোরে নিশ্বাস ফেলবেন না
হাঁচি বা কাশির বেগ এলে দূরে সরে যান। হাতের কনুই বা রুমালে নাকমুখ ঢেকে নিন।
বাড়িতে নিজেকে আইসোলেট করে রাখুন।
নিজের কোনো জিনিস অন্যকে ব্যবহার করতে দেবেন না।
আপনার ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে বা ভিডিওকলে যোগাযোগ রাখুন।
ভয় পাবেন না
কনজাংটিভাইটিস হলেই আপনি করোনা-আক্রান্ত একথা ভেবে মুষড়ে পড়বেন না। মাত্র ৩ শতাংশ মানুষের কনজাংটিভাইটিস করোনার জন্য হয়ে থাকে। আর এর ফলে চোখের মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয় না। সুতরাং অযথা আতঙ্কিত না হয়ে আপনার চোখের ডাক্তারকে ফোন করুন, তার পরামর্শ মেনে চলুন ।