(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার রহস্য উন্মোচনের নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর-এর কলমে।)
হীরক কর : এমন কিছু কাহিনী রয়েছে, যা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। আবার কিছু কাহিনী আছে, যার জায়গা আইনে নেই। কিন্তু পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়, ‘যা চোখে দেখা যায় না’। ওইসব জিনিসের ব্যাপারে আইনকেও মান্যতা দিতে হয়। কিন্তু কোনো-না-কোনোভাবে আইন, যা কিনা প্রমাণ এবং সাক্ষীর উপর নির্ভরশীল, সে যদি প্রমাণ পেয়ে যায়, তাহলে আইনও সে জিনিসকে মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু যার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাকে চোখেই দেখা যায় না। কি অদ্ভুত না! এমন এক সত্য ঘটনা নিয়ে ১৯৮৬ সালে হলিউডে তৈরি হয় একটি ছবি। নাম যার, ‘ভয়েস অফ গ্রেভ’।
এই কাহিনী ওই ছবির নেপথ্যের সত্য ঘটনা নিয়ে। সেই সময় আমেরিকার ফেডারেল পুলিশের অফিসার এবং গোয়েন্দারা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন এমন একটা মার্ডার কেস, যা ‘ভূত’ সমাধান করেছে। রহস্য উন্মোচন করেছে এক ‘আত্মা’। এত পারস্পরিক প্রমাণ ছিল যে, তা পুলিশকেও মানতে বাধ্য করে। আইন সাধারণত এইসব অতিমানবীয় ব্যাপার-স্যাপার মানে না। কিন্তু এটা এমন কেস, যা পুলিশ মানতে বাধ্য হয়েছিল। কেননা তদন্ত করে পুলিশ রহস্য সমাধানে কোনো আশার আলো দেখতে পাইনি।
টেরেসিটা বাসা নামে এক তরুণী, যাঁর জন্ম ফিলিপিন্সে। বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে, লেখাপড়ায় ভালো। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য সে আমেরিকার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার মা-বাবা বাসার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। তাই কালবিলম্ব না করে ওই তরুণী ফিলিপিন্স থেকে সোজা পৌঁছে যায় আমেরিকার শিকাগো শহরে। শিকাগোতে যাওয়ার পর সে মিউজিক নিয়ে মাস্টার্স করে। পিয়ানো বাজানোর শখ ছিল বলেই সে মিউজিক নিয়েই মাস্টার্স করতে চেয়েছিল। একসময় তাঁর মনে হয় মিউজিকের পাশাপাশি ডাক্তারি পড়া দরকার। রেস্পেক্টিভ থেরাপিস্ট হিসেবে সে পড়াশোনা সম্পন্ন করে। এবং স্থানীয় এক হাসপাতালে যোগ দেয়। তার বয়ফ্রেন্ড ছিল, কিন্তু সেটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। একলা থাকলেও সে ভীষণ হাসি খুশি ছিল।
এ কাহানী ১৯৭৭-এর। আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগের। তখন টেরেসিটার বয়স প্রায় ৪৭। বিয়ে করেননি, একজন থেরাপিস্ট হিসেবে হসপিটালে কাজ করছিলেন। বাকি সময় তিনি যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন, সেখানকার বাচ্চাদের পিয়ানো শেখাতেন। বন্ধু খুব কম ছিল। কিন্তু তাঁর জীবন এগোচ্ছিল তাঁর নিজের মত করেই।
২১ ফেব্রুয়ারি,১৯৭৭। সন্ধে সাড়ে ৭টার সময় ওই তরুণী তার এক বন্ধুকে ফোন করে। যার নাম ছিল রুথ রয়েব। যাকে আকছার সে ফোন করত। যে কয়েকজনের সঙ্গে সে কথা বলত, তার মধ্যে একজন ছিল এই রুথ। পনেরো বিশ মিনিট কথা হওয়ার পর আচমকা ওই তরুণী বন্ধুকে বলে, “একজন গেস্ট আসবে। আমার কিছু জরুরি কাজ আছে। ফোন রাখছি।” কোন অতিথি আসবে, তা রুথ তাকে জিজ্ঞেসও করার সুযোগ পায়নি, তার আগেই লাইন কেটে যায়। এটাই টেরেসিটার কারোর সঙ্গে শেষ কথা ছিল।
এর ঠিক এক ঘণ্টা পর, সাড়ে আটটা নাগাদ টেরেসিটা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতো, সেই বিল্ডিং থেকে ধোঁয়া বেরোনো শুরু হয়। আশপাশের লোকজন তা দেখেন। তারা আগুন লেগেছে মনে করে বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি গার্ডকে খবর দেন। সিকিউরিটি গার্ড সঙ্গে সঙ্গেই দমকল এবং পুলিশকে কল করেন। কিছুক্ষণ পরেই দমকল এসে পড়ে। এবং আগুন নেভানোর জন্য ওই অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে। যেখানে টেরেসিটা থাকতেন। দমকলকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর দমকলকর্মীরা টেরেসিটার অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন। বোঝার চেষ্টা করেন ওই ঘরে কে কে আছে। ড্রইং রুমে গিয়ে দেখেন, একটা কার্পেট থেকে তখনও কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কিন্তু কার্পেটটা গোটানো।
কার্পেট খুলতেই তারা অবাক হয়ে যান। দেখেন কার্পেটের ভেতরে এক অর্ধদগ্ধ তরুণী, যার শরীরে কোনও কাপড় নেই। প্রথম নজরে দেখেই মনে হয়েছিল এটা খুনের মামলা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও পৌঁছেছিল। যেহেতু শরীরের কোনও কাপড় ছিল না, তাই পুলিশের ধারণা হয়, খুনের আগে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। প্রমাণ লোপাট করার জন্য মৃত মহিলাকে কার্পেটে গুটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কার্পেট থেকে ধোঁয়া বাইরে পৌঁছেছিল। এবং অ্যাপার্টমেন্টেও আগুন লাগে। পুলিশ লাশকে নিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা মৃতদেহটিকে টেরেসিটা বাসা বলেই সনাক্ত করেন। পোস্টমর্টেম হয়।
ময়না তদন্ত রিপোর্টে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়, তরুণীর দেহে কাপড় না থাকলেও তাকে কোনোভাবেই ধর্ষণ করা হয়নি। পুলিশ যখন টেরেসিটার ঘরে ঢুকেছিল তখন সমস্ত ঘর ছিল লন্ডভন্ড। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, কোনও কিছুই খোয়া যায়নি। টেরেসিটার পরিবার ফিলিপিন্স থেকে আসে। প্রতিবেশী, টেরেসিটার বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু, কোন আশার আলো দেখা যায় না। এই সময় পুলিশ টেরেসিটার ঘরের মধ্যে এক টুকরো কাগজ পায়, যাতে লেখা ছিল “গ্রেট থিয়েটার টিকিট ফর এ, এস”। কিন্তু এমন কিছু পাওয়া যায় না, যার থেকে কোনও তথ্য প্রমাণ মেলে। ধর্ষণ হয়নি। ঘর লন্ডভন্ড ছিল। মনে হয়েছিল লুটপাট। কিন্তু কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু মেলে এক টুকরো কাগজ, যাতে লেখা “গ্রেট থিয়েটার টিকিট ফর এ, এস”।
তাই পুলিশের কাছে প্রশ্ন ছিল এই এ এস কে ? অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন, বন্ধু-বান্ধবদের টানা জিজ্ঞাসাবাদ চলে। যে হাসপাতালে কাজ করতেন, সেখানকার সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করা হয়। এমনকি পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়ে যে বাচ্চাদের টেরাসেটা পিয়ানো শেখাত, তারাও।
কিন্তু এ এস নামের কাউকেই পাওয়া যায় না। পুলিশ কোনো দিশা পায় না। তবুও গোয়েন্দারা লেগেই থাকেন। দিন পেরিয়ে যায়, সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, মাসের পর মাস চলে যায়। কিন্তু, কোন সূত্র পাওয়া যায় না। এমন কিছু পাওয়া যায় না যে, টেরেসিটার খুনের ব্যাপারে যা আলোকপাত করতে পারে।
টেরেসিটার খুনের তদন্তভার ছিল ফেডারেল পুলিশের ডিটেকটিভ মিস্টার জোয়ের ওপর। খুনের প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার কাছাকাছি এক সন্ধ্যায় জো তাঁর দফতরে যান। দফতরে পৌঁছে দেখেন তাঁর টেবিলে একটা নোট পড়ে আছে। আর ওই নোটে লেখা ছিল, “টেরেসিটার কেসে এক প্রত্যক্ষদর্শী মিলেছে। সে কিছু বলতে চায়। তাই আপনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।” ডিটেকটিভ জো ওই নোট পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ স্টেশনে পৌঁছন। থানার আধিকারিকদের জিজ্ঞেস করেন এতদিন বাদে কি এমন প্রত্যক্ষদর্শী সামনে এলেন ? আধিকারিকরা বলেন, “এক ডাক্তার আমাদের কাছে এসেছিলেন। ওই ডাক্তারের নাম, জোসে চুয়া। আদপে তিনি ফিলিপিন্সের বাসিন্দা। কিন্তু শিকাগোতে যে হাসপাতালে টেরেসিটার কাজ করতেন, সেখানেই তিনি ডাক্তারি করেন। উনি এসে বলেন, টেরেসিটার খুনের মামলার ব্যাপারে আমি কিছু আলোকপাত করতে পারি।” যেহেতু ডিটেকটিভ জো এই মামলার তদন্ত করছিলেন, তাই তাকে ডেকে পাঠায় স্থানীয় থানার পুলিশ।
ডিটেকটিভ জো ডক্টর জোসের কাছে যান, জানতে চান আপনি কি জানেন ? জবাবে ডঃ জোসে এক কাহিনী শোনান। বলেন, “আমি হাসপাতালে কাজ করি, কিন্তু আমি সেই অর্থে টেরাসিটাকে চিনতাম না। কিন্তু কয়েকদিন হল আমার স্ত্রী রোমি আজব কাণ্ডকারখানা করছে। ও ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে। রাতে যখন কথা বলে, তখন তার আওয়াজ বদলে যায়। এগুলো আগে কখনো ছিল না। কিন্তু কিছুদিন ধরেই এরকম হচ্ছে। শুরুতে আমি পাত্তা দিইনি। যেহেতু আমি চিকিৎসক, তাই এইসব ব্যাপারে গুরুত্ব দিই না। গতকাল রোমি শুয়েছিল এবং খুব জোরে জোরে বিড়বিড় করছিল। ওর কণ্ঠস্বর ঠিক আমার স্ত্রীর মত ছিল না। ওর মুখ দিয়ে যেন অন্য কারো আওয়াজ বের হচ্ছিল।”
ডিটেকটিভ বলেন, এর মধ্যে রহস্য কোথায়? ডাক্তার জানান, “এরপরেই আমার স্ত্রী আমার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে থাকে। বলতে থাকে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।” ডিটেকটিভ বলেন, কি বললেন আপনার স্ত্রী? ডাক্তার বলেন, “স্ত্রী তো আমার। কিন্তু, কণ্ঠস্বর ছিল অন্য কারোর। আচমকা বলে, আমাকে খুন করা হয়েছে। আর আমাকে যে খুন করেছে তার নাম অ্যালেন শাহরিয়া। ও আমার ঘরে টিভি ঠিক করার জন্য এসেছিল। টিভি ঠিক হয়ে যাবার পর সে আমাকে খুন করে। পুরো ঘর তছনছ করে। যাতে মনে হয় কেউ লুটপাট করতে এসেছিল। তারপর সে চলে যায়।”
ডাক্তার বলেন, “আমি রোমির কাছে ঘটনাটা শুনি ।সকালে উঠে আমার মনে হয় এটা ভ্রম। স্ত্রী হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের কথাই আমাকে বলছিলেন। এরকম ভুলভাল স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে। তাই ওর কথায় আমি ভরসা করছিলাম না ।তারপর বিষয়টা ভুলে যাই।”
তাহলে আপনি আমার কাছে কেন এলেন? ডাক্তার বলেন, “তারপরের দিন আমার স্ত্রী ফের বলে, আমাকে খুন করেছে এলেন। শুধু খুন করেনি, আমাকে কার্পেটে মুড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তুমি একথা গিয়ে ডিটেকটিভ জো-কে জানাও । যাতে আমার খুনির সাজা হয়।” কিন্তু ডাক্তারের মনে হয়, এইসব ভ্রম। অলৌকিক ব্যাপার। এইসব নিয়ে পুলিশের কাছে গেলে, পুলিশ তো বটেই আশেপাশের লোকজনও হাসাহাসি করবে। তাই তিনি পুলিশের কাছে যাননি। বিষয়টিকে পাত্তা দেননি।
কিন্তু, ওই রাতেই রোমি আবারও বিড়বিড় করতে থাকেন। এবং এবার প্রচন্ড ক্ষুব্ধ দেখায় তাকে। সে রেগে গিয়ে ডাক্তারের নাম ধরে বলতে থাকে, “তোমাকে আমি আমার খুনের কথা গতকালও বলেছিলাম। পুলিশের কাছে যেতে বলেছিলাম। তুমি আমাকে পাত্তা দাওনি। এটা ঠিক করোনি। আমি তোমাকে আমায় সাহায্য করতে বলছি মাত্র। তুমি পুলিশের কাছে না গিয়ে যদি আমায় সাহায্য না করো, তাহলে তোমার স্ত্রীকে ভুগতে হবে।” ডাক্তার বলেন, “খুব সাহস করে আমি এবার ডিটেলসে কথাবার্তা বলতে চাই। জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আমার স্ত্রী নও, তাহলে তুমি কে ? তুমি কি চাও?”
অন্য কারো আওয়াজে রোমি বলে, “আমি তো আগেই তোমাকে বলেছি আমার খুন করা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় সাড়ে আটটার সময় জনৈক অ্যালেন আমার ঘরে টিভি সারাই করতে এসেছিল। সে আমাকে খুন করে আগুন ধরিয়ে দেয়।”
ডাক্তার বলেন, “আমি এইসব কথা পুলিশকে গিয়ে বললে তারা হাসাহাসি করবে। কী করে বিশ্বাস করাবো তাঁদের। কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ আছে কি, যা নিয়ে গিয়ে আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলব।” ওই কণ্ঠস্বর বলে, “ঠিক আছে আমি প্রমাণ দেবো।তাহলে তো তুমি আমাকে মদত করবে?” ডাক্তার কথা দেন, হ্যাঁ, সহায়তা করব।
সে বলে, “আমাকে খুন করার পর অ্যালেন আমার বাড়ি থেকে যাবার সময় কিছু জুয়েলারি সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল। পরে ওই জুয়েলারি অ্যালেন তার গার্লফ্রেন্ডকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। ওই জুয়েলারি এখন অ্যালেনের গার্লফ্রেন্ডের ঘরেই আছে। আপনি ওখানে পুলিশকে নিয়ে তল্লাশি চালালে ওই জুয়েলারি পাওয়া যাবে। কিন্তু, ওই অলঙ্কার আমার কিনা, সেটা কী করে প্রমাণ হবে। এজন্য আমি কিছু নাম এবং ফোন নম্বর দিচ্ছি।আমাকে ভালোভাবে চেনে, জানে, আমার এমন বন্ধু এবং পরিবারের লোকদের সেখানে নিয়ে যান, যারা ওই অলঙ্কারগুলো শনাক্ত করবে। ওগুলো সব এই মুহূর্তে আমার খুনির প্রেমিকার কাছে আছে।” সে তাদের নাম এবং ফোন নম্বর ডক্টরকে লিখিয়ে দেয়। ডাক্তার তখন পুলিশের কাছে যেতে রাজি হন।
ওই অচেনা কণ্ঠস্বর বলে, “আপনি আমাকে সাহায্য না করলে এর ফল ভোগ করবে আপনার স্ত্রী।” ডাক্তার ডিটেকটিভকে বলেন, এরপরে আমি স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারপর আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এবার আমি আপনার সামনে। কী করবেন করুন।
সব শুনে ডিটেকটিভের মনে হয় এ কেমন বোকার মত কথাবার্তা। কিন্তু, পরক্ষণেই ভাবেন, এক বছর হয়ে গেল টেরেসিটার মার্ডার কেসের তো সমাধান হয়নি। ডাক্তারের কথা শুনে একটু খতিয়ে দেখা যাক না। এখানে তো বেশকিছু ক্লু দিচ্ছে টেরেসিটার আত্মা নিজেই। যেমন, টেরেসিটার ঘরে মেলা চিরকুট, যাতে লেখা ছিল এ এস। ডক্টরের স্ত্রীর মুখ দিয়ে টেরেসিটার আত্মা তাঁর খুনির নাম বলেছিল অ্যালেন শাহরিয়া। এ ফর অ্যালেন, এস ফর শাহরিয়া। ডিটেকটিভ তদন্ত করে দেখেন, আদৌ ওই অ্যাপার্টমেন্টে টিভির কোন সমস্যা ছিল কিনা। হ্যাঁ, দেখা যায় টেরেসিটার টিভি খারাপ ছিল। একজন টিভি ঠিক করতে এসেছিল। টিভি ঠিকও হয়ে গিয়েছিল।
যখন আত্মার দেওয়া দুটো প্রমাণ মিলে যায়, তখন পুলিশের লোম খাড়া হয়ে যায়। পুলিশ বুঝতে পারে, ডাক্তারের স্ত্রীর আজব কণ্ঠস্বর সত্যি কথাই বলছে। পুলিশ খুব সহজেই অ্যালেনের ঠিকানা খুঁজে পায়। অ্যালেন ওই হাসপাতালে চাকরি করতো, যেখানে টেরেসিটার থেরাপিস্ট ছিলেন। সাদা পোশাকে পুলিশ অ্যালেনের কাছে গিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করে আপনার কি কোন গার্লফ্রেন্ড আছে? অ্যালেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে আছে। কেন? পুলিশ বলে, ও কোথায় থাকে। অ্যালেন কোনো সন্দেহ না করে গার্লফ্রেন্ডের ঠিকানা পুলিশকে দিয়ে দেয়। পুলিশ খুঁজে খুঁজে ওই গার্লফ্রেন্ডের ঘরে পৌঁছয়। তাকে জিজ্ঞেস করে, সাম্প্রতিককালে অ্যালেন কি আপনাকে কোন অলঙ্কার প্রেজেন্ট করেছে। গার্লফ্রেন্ড চমকে যায়। বলে, হ্যাঁ, আমাকে উপহার দিয়েছে।
–দেখাবেন ?
সে অলঙ্কার পুলিশকে দেখায়। পুলিশ টেরেসিটার পরিচিত বন্ধু এবং পরিবারের এক সদস্যকে ডেকে পাঠায়। অলঙ্কার তাদের সামনে রাখতেই তাঁরা ওগুলো টেরেসিটার বলে চিহ্নিত করেন। এবার পুলিশের মধ্যে কোনরকম দ্বিধা ছিল না। সরাসরি অ্যালেন শাহরিয়াকে গ্রেফতার করে।
কিন্তু বিচিত্র সমস্যার মুখে পড়ে যায় পুলিশ। অ্যালেনকে তো পুলিশ তুলে নিয়ে লকআপে ভরেছে। কিন্তু সাক্ষী হচ্ছে এক আত্মা। আর সে এক ডাক্তারের স্ত্রীর মুখ দিয়ে বলছে সবকিছু। আইনে আত্মার সাক্ষী স্বীকৃত নয়। আদালতে তো টেরেসিটার আত্মা সাক্ষী দিতে আসতে পারবে না। তবে উপায় !
কিন্তু, আত্মা বলেছিল খুনির নাম এ এস। সেটা মিলে গেছে। টেরেসিটার অলঙ্কার আছে অ্যালেনের গার্লফ্রেন্ডের কাছে, সেটাও প্রমাণিত। আদালতে অ্যালেনের উকিল বলেন, সে অলংকার চুরি করেছে ঠিকই। কিন্তু খুন করেনি। ও যখন অলঙ্কার চুরি করেছে, তখন টেরেসিটা জীবিত ছিল। সেই অবস্থাতেই অলঙ্কার চুরি করে অ্যালেন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায় । ফলে তাকে চুরির মামলায় অভিযুক্ত বললেও খুনি বলা যাবে না। কেননা খুনের সময় কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। খুনের কোনও প্রমাণও নেই। এই অবস্থায় পুলিশ অ্যালেনকে বেশিদিন নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারে না ।তাই, উপায়ন্তর না দেখে তাকে ছেড়ে দিতে হয়।
অ্যালেন পুলিশ হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই টেরেসিটার আত্মা ডাক্তারের স্ত্রী রোমিকে কব্জা করে নেয়। ডাক্তারকে জানায়, তাকে কীভাবে খুন করা হয়েছে। ডাক্তার বলেন, “এবার আমি কী করবো। অ্যালেনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু, খুনের কোন প্রমাণ নেই। তাই ,তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। খুনের প্রমাণ কোথা থেকে জোগাড় করবো। আর আত্মার কথা আইন মানে না।”
এর পরেই টেরেসিটার আত্মা ক্ষেপে ওঠে এবং যারা যারা এই কেসের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের পিছনে লেগে পড়ে। বলে, “আমাকে ইনসাফ দিলাও”। এরপর ফরেনসিক টিম ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করে। পুলিশের মনে হয়, টেরেসিটার বাড়িতে অ্যালেন টিভি সারাই করতে গিয়েছিল। সে নিজেই তা স্বীকার করেছে। স্বীকার করেছে, গয়না চুরির কথা। তাহলে সে যে খুন করেছে সেটা কি করে এড়িয়ে যাওয়া যায়। ফলে ফের অ্যালেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ফের তদন্ত শুরু হয়।
আবার আদালতে মামলা ওঠে। এ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক অদ্ভুত মামলা। যে মামলার ভিত্তি ছিল একটি আত্মার সাক্ষীর ওপর। যা একজন ডক্টরের স্ত্রী রূপে প্রকাশিত হচ্ছিল। খুনের প্রমাণ ছিল না।কিন্তু, শুনানি শুরু হয়েছিল। জুরি মেম্বাররা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের এক দলের মত ছিল, অ্যালেনকে খুনের দোষী সাব্যস্ত করতে গেলে, যে উপযুক্ত প্রমাণ দরকার তা নেই। তাই, আদালত অ্যালেনকে রেহাই দিয়ে দেয়। অ্যালেন রেহাই পেয়ে যায়। কিন্তু কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে না।
আদালতের রায়ে অ্যালেন শাহরিয়াকে জেল থেকে ছাড়া হয়েছিল। ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে হঠাৎ করে সে বদলে যায়। ডিটেকটিভ জোকে ডেকে পাঠায়। সে জেলার, আইনজীবী, ডিটেকটিভ জো, সকলের সামনে দোষ স্বীকার করে। বলে, হ্যাঁ, আমি টেরেসিটাকে খুন করেছি। এতদিন মিথ্যা কথা বলছিলাম।
জবানবন্দিতে বলে, “আকছার টেরেসিটার সাথে আমার দেখা হাসপাতালেই হত। কিন্তু ১৯৭৭ -এর ২১ ফেব্রুয়ারি সাড়ে আটটায় আমি বাসার অ্যাপার্টমেন্টে যাই। যখনই ওর ঘরে কোনও ইলেকট্রনিক্স গেজেট খারাপ হতো, তখন টেরেসিটার আমাকে মেরামত করার জন্য আসতে বলতো। তারপর কফি খেতে খেতে আমরা আড্ডা মারতাম। ওই দিন হাসপাতালে টেরেসিটার বলে, আমার ঘরের টিভিটা খারাপ হয়েছে। আমি বলি, ঠিক আছে আজ সাড়ে আটটার সময় গিয়ে ঠিক করে দেব। ওই সময় গিয়ে আমি টিভিটা মেরামতও করে দিই। কিন্তু হঠাৎ করে যেন আমার মাথাটা ঘুরে যায়। আমার টাকার দরকার ছিল। মনে হল, টেরেসিটার অ্যাপার্টমেন্টে টাকা এবং জুয়েলারি থাকবে। তখন আমার নজর অলঙ্কারের ওপরেই পড়ে। কিন্তু গয়না চুরি করতে গেলে টেরেসিটার আমাকে ধরে ফেলে। আমার মনে হয়, এতে আমার মান-সম্মান খোয়া যাবে। বাজারে বদনাম হবে। ফলে, রাগের মাথায় আমি টেরেসিটার গলা টিপে ধরি। ফুলদানি দিয়ে মাথায় আঘাত করি। যাতে এটা খুন নয়, ধর্ষণের কেস মনে হয়, তাই, টেরেসিটার সমস্ত পোশাক খুলে ফেলি। এবং মেঝের কার্পেটে মুড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিই, যাতে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়।
অ্যালেনকে টেরেসিটার খুনের ঘটনায় আদালত রেহাই দেওয়ার পর হঠাৎই সে পুলিশকে ডেকে স্বীকারোক্তি দেয়। ফলে ‘রি-ট্রায়াল’ শুরু হয়। রি-ট্রায়ালে টেরেসিটার বাসা খুনের মামলায় অ্যালেন শাহরিয়াকে ওই জুরিরাই কুড়ি বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি শোনায়। এরপর কুড়ি বছর সে জেলের সাজা ভোগ করে।
না, এখনো এই কাহিনী শেষ হয়নি। প্রথমবার যখন আদালত অ্যালেনকে রেহাই দিয়েছিল, তখন টেরেসিটা বাসার আত্মা জেলে পৌঁছে যায়। অ্যালেনকে ভয় দেখাতে শুরু করে। তুমি পুলিশ এবং আদালতের কাছে স্বীকারোক্তি দাও, না হলে তোমার অবস্থা খারাপ হবে। এই কারণেই অ্যালেন আচমকা ডিটেকটিভ এবং জেলারকে ডেকে সত্যি ঘটনা বলে। টেরেসিটার খুনের দায় নিজের কাঁধে নেয়। পরে এক ইন্টারভিউয়ে ডিটেকটিভ জো বলেন, সাধারণত আইন এবং পুলিশ ভূত প্রেত আত্মা মানে না। কিন্তু এই মামলায় বলা যায় টেরেসিটার আত্মাই ওই খুনের রহস্য উন্মোচন করেছিল। বহু তথ্য-প্রমাণ আত্মার মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে ছিল। ওই সময় শিকাগো পুলিশ এর নাম দিয়েছিল ‘ভয়েস ফ্রম গ্রেভ’ অর্থাৎ ‘কবর থেকে কণ্ঠস্বর’ ।