হোমঅন্যান্যএক মুঠো শান্তির খোঁজে বিয়াসের দেশে

এক মুঠো শান্তির খোঁজে বিয়াসের দেশে

এক মুঠো শান্তির খোঁজে বিয়াসের দেশে

দীপঙ্কর বসু
হেমন্তের বিকেলে ঝরা মেপল পাতায় লাল হয়ে যাওয়া সুদূর ইতালীর এক অচেনা পথ। পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে ফোর্নো (FORNO) রেস্তোরাঁ। ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছিল। আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারলাম না। চারদিকে সবুজের সমারোহ। এ কোন প্রকৃতি! আমি তখন আর এক কোণে নিরালায় রেস্তোরাঁর আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলেই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সুদূর ভারতের বিপাশার তীর।

মনে হয় আবার ছুটে যাই সেই সবুজ উপত্যকায়। শুধু সবুজ আর সবুজ, উফ!! এ এক পরম শান্তি!! এই সবুজের পরশে, ইতালিয়ান চা পানের মাঝে শুনতে পাই চিরন্তন প্রেয়সী-বিয়াস কলতান করে বলছে আমাকে কিন্তু ভুলে যেও না!! আমি মনে মনে বলি-তুমি তো বড্ড হিংসুটে গো!!

এই যে এতক্ষণ তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে এলাম, তার বেলা!! তুমিই তো আমার ভালোবাসা, ভালোলাগার সব কিছু। তোমাকে আমি ভুলতে পারি! তোমার টানেই তো ছুটে আসি বারে বারে!!

জন্ম উত্তরবঙ্গে। তাই সেই ছেলেবেলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে খুব সহজেই কাছে পেয়েছি। কিন্তু ট্যুরিস্ট হিসেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাকে নিরাশ করেছে বহুবার। বহু প্রতীক্ষার পরও মেলেনি দেখা।
কতবার মহারাজের দর্শন না পেয়ে বিফল মনোরথে ফিরে এসেছি!! আর বাদবাকি উত্তরবঙ্গকে আমার একই রকম লাগে!

আপনারা উত্তরপ্রেমীরা আবার যেন আমার গিন্নির মতো রেগে যাবেন না! তিনি তো এই কথা শুনে আমাকে মাঝে মাঝেই বলে, তুমি একটা খ্যাপা পাগলা! কি পাও বিয়াসের দেশে! আমি বলি ও তুমি বুঝবে না- খুঁজি আমি পরশ পাথর!!
বিশ্ব কবির কথায় তাকে বলি–

“মাথায় বৃহৎ জটা, ধুলায় কাদায় কটা,
মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।
রাজ সম্পদের লাগি নহে সে কাতর,
একবার পেতে চায় পরশ পাথর!!”

মায়াবী ইতালীয় রেস্তোরাঁয় বসেও স্বদেশের ভুবনমোহিনী সেই রূপের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই পাহাড়ী সন্ধ্যা নেমে এলো। পাহাড়ে ঠিক এমনি করেই সূর্য হঠাৎ দিগন্তে লুকিয়ে পড়ে। উপত্যকায় নেমে আসে রাত। সেই রাতটা ছিল দীপাবলির রাত। ইতালীর রেস্তোরাঁয় ভারতীয় হোটেল ম্যানেজারের দীপাবলির শুভেচ্ছা মনে করিয়ে দিল সহস্র ক্রোশ দূরে আলোকমালায় সেজে ওঠা আমার স্বদেশের উৎসবময়ী রূপকে।

আমি তো ভগবান কে প্রশ্ন করি,তুমি আমাকে সুন্দর আকাশ, সুন্দর একটা সকাল ক্ষণিকের জন্য দিয়েছো! কিন্তু এত অন্ধকারময় রাত কেন দাও, যা কিনা শেষ হতেই চায় না! আমাকে একবার একটা সুন্দর রাতের ঠিকানা দাওনা প্রভু! আসলে আমি সব কিছুই একটু দেরীতে পাই।

আজ আমি অনেকটা পেয়েছি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে এবার একটু আনমনা হয়ে গেছি। মনে মনে “শচীন দেববর্মনের” দু কলি গান গাইছি- “লেগেছে চোখের নেশা–দিক ভুলেছি আমি!” আস্তে আস্তে পাহাড় অন্ধকারের দিকে ঢলে পড়ছে। পাহাড়ে রাত এভাবেই ঝুপ করে নেমে আসে। অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ পাহাড় জুড়ে আলো ঝলমল করে উঠলো!

পাহাড় যেন বলে উঠলো, পৃথিবীর অভিশপ্ত রাত বিদায় হোক-নতুন আলোর উদয় হোক! আমি তো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি, রাতের এ কি রূপ দেখছি আমি! কথা হারিয়ে ফেলি। মনে মনে বলে উঠলাম, ইউরেকা! ইউরেকা! খ্যাপা পেয়েছে পরশ পাথরের সন্ধান! আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই! ভগবান কে শতকোটি প্রনাম জানিয়ে বললাম, হে প্রভু আমি এরকম একটি রাত্রি তো চেয়েছি!!

এবার ওঠার পালা, চললাম হোটেলের পানে। নিবিড় নিস্তব্ধ বনানীর মাঝে আমি একাকী, এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের ভাগ আমি কাউকে দেব না!! এটা আমার একান্তই নিজের!!

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img