হোমPlot1ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যাকে ঘিরে রয়েছে বহু অলৌকিক কাহিনী

ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যাকে ঘিরে রয়েছে বহু অলৌকিক কাহিনী

ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যাকে ঘিরে রয়েছে বহু অলৌকিক কাহিনী

সংগ্রাম দত্ত
বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের কাছে ক্ষীরগ্রামে রয়েছে যোগাদ্যা কালী মন্দির। যোগাদ্যা বাংলার এক লৌকিক দেবতা ও সতীর ৫১ পীঠের একটি। রামায়ণে উল্লিখিত মহীরাবণের আরাধ্য দেবী ভদ্রকালী হিসেবেই এখানে দেবীকে পুজো করা হয়। দেবী এখানে রত্নবেদীতে কালীমন্ত্রে পূজিতা হন। এই দেবীমূর্তি কষ্টি পাথরের তৈরি, রূপে তা মহিষাসুরমর্দিনী। 

কথিত আছে, এখানে সতীপীঠের দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন, ‘ক্ষীরগ্রামে ডানি পা’র অঙ্গুষ্ঠ বৈভব। যুগাদ্যা দেবতা ক্ষীরখণ্ডক ভৈরব।।’ ভারতচন্দ্রের একথা বলার কারণ, দেবী যোগাদ্যার ভৈরব হলেন ক্ষীরখণ্ডক। সেই থেকে এই জনপদের নাম ক্ষীরগ্রাম, যা প্রাচীন কাল থেকেই বিখ্যাত এক জনপদ। এক সময় এই জনপদের দেবী যোগাদ্যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর-দূরান্তে। বর্ধমানের অন্তত ৫০টি গ্রামে দেবী পুজোর প্রচলন থাকলেও, ক্ষীরগ্রামই দেবীর উদ্ভবস্থলের মর্যাদা পেয়েছে।

প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি হারিয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির নির্মাণ করান। এবং সম্ভবত তাঁরই আদেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর। নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটি অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদিঘির জলেই। শুধুমাত্র ৩১শে বৈশাখ তা জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত।

ক্ষীরদিঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে এল ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে গ্রামের মানুষ গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল ফিরে পাওয়া দেবী-মূর্তি। ফলে বহিরাগতরা এখন গ্রামে গেলেই দর্শন পান দেবীর। তবে সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।

ক্ষীরগ্রামে পুরনো যোগাদ্যা মন্দিরে তোরণদ্বারের স্থাপত্য দর্শকদের বিশেষ নজর টানে। জানা গিয়েছে, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। মিলেছে বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী জানিয়েছেন, এই জনপদে অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি মিলেছে। তবে তাঁর মতে, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র। কবির লিখিত কাহিনিটি ছিল এ রকম, মহীরাবণ রাম-লক্ষ্মণকে বেঁধে পাতালে নিয়ে গিয়েছেন। সেখানে দেবীর সামনে তাঁদের বলির ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু হনুমান মাছির রূপ ধরে রাম-লক্ষ্মণের পরিচয় জানিয়ে দেন দেবীকে। দেবী তখন হনুমানকে বুদ্ধি দেন, রামকে বলি দেওয়ার আগে মহীরাবণ যখন দেবীকে প্রণাম করতে বলবেন, রাম যেন তখন তাঁকে বলেন, তিনি প্রণাম করতে জানেন না। মহীরাবণ হেঁট হয়ে দেবীকে প্রণাম করতে গেলেই খাঁড়া দিয়ে তাঁর মাথা কেটে ফেলতে হবে। এমনটাই করেছিলেন রামচন্দ্র। এ তো গেল কৃত্তিবাসের কথা।

অনেক অলৌকিক কাহিনি, দেবীর নানা রূপ ধরে ভক্তদের আশীর্বাদ করার গল্প ছড়িয়ে রয়েছে ক্ষীরগ্রামের আকাশে-বাতাসে। জাগ্রত এই দেবীর আশীর্বাদ পেতে আজও তাই বৈশাখ সংক্রান্তিতে ভক্তরা ভিড় করেন।

তবে আসল উৎসব শুরু হয়  ২৭ বৈশাখ থেকেই। সেদিন থেকেই শুরু হয় দেবীর সামনে রামায়ণ গান। দেবীর বন্দনা গান হয় সমাপ্তি অনুষ্ঠানে।  দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ক্ষীরগ্রামে ছুটে আসেন।

অনেকের দাবি, এখানে দেবীর পুজো চলছে ১,৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। আর, নতুন মন্দিরটি তৈরি হয় ২০১১ সালে।

ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যা সম্পর্কে বহু পৌরাণিক কাহিনি ও জনশ্রুতি আছে। রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় রাবণপুত্র মহীরাবণ, রাম ও লক্ষ্মণকে তাঁর আরাধ্যা দেবী ভদ্রকালীর কাছে বলি দেওয়ার জন্য পাতালে বন্দি করেছিল। সেখানে মহীরাবণ বধের পর হনুমান, রাম ও লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে পাতাল থেকে বেরোতে উদ্যোগী হলে, মা ভদ্রকালী নাকি বলেছিলেন – তোমরা তো চলে যাচ্ছ, আমাকে এখানে একা ফেলে গেলে তো হবে না। আমাকে পৃথিবীর মধ্যস্থল যেখানে, সেখানে নিয়ে চলো! হনুমান সুড়ঙ্গপথে রাম-লক্ষণকে ও মা ভদ্রকালীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এই ক্ষীরগ্রামে।

কীভাবে পৌঁছবেন সতীপীঠ ক্ষীরগ্রামে?
এই মন্দিরে আসতে হলে বর্ধমান স্টেশনে এসে কাটোয়াগামী ট্রেনে চেপে নামতে হয় কৈচর হল্ট স্টেশনে। বর্ধমান থেকে কৈচর স্টেশনের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার।

এছাড়া, হাওড়া-কাটোয়া, শিয়ালদা-কাটোয়া রুটের যে কোনও ট্রেন ধরে কাটোয়া পৌঁছে  কাটোয়া থেকে বর্ধমানগামী ট্রেন অথবা বাসে করে কৈচর স্টেশন অথবা কৈচর বাসস্ট্যান্ডের নামতে হবে।

এখানে  রাত্রিবাসও করা যায়। ক্ষীরদীঘির পারে মায়ের নতুন মন্দিরের সন্নিকটেই আছে যোগাদ্যা গেস্ট হাউস।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img