ড. বিকাশ পাল, লন্ডন
বিবিসি-র সাংবাদিক তীর্থঙ্করবাবু একদিন অবনীর অফিসে হাজির। অবনীর দেওয়ালে তাঁরই একটি স্কেচ। তীর্থঙ্কর বেশ কিছুক্ষণ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসতে বসতে বলে ফেললেন, “অবনীদা আপনার এই স্কেচটা তো ভারী সুন্দর।
এটা কে এঁকেছেন, আপনি?”
অবনী বললেন না, না, এটা আমার এক প্রাক্তন ছাত্র, অভিষেক ত্রিবেদী এঁকেছে। তবে আপনাকে সত্যই বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী লাগছে অবনীদা। অবনী হাসতে হাসতে বললেন, “অধ্যাপকদের তো সেরকমই দেখতে লাগা উচিত। আপনি জানেন, এবছর বিশ্বের সব বিশ্ব বিদ্যালয়ের যে মেধা তালিকা বেরিয়েছে, তাতে ২০২২-এ আমরা বিশ্বে ষষ্ঠ হয়েছি।” ডঃ অবনী ঘোষাল লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তীর্থঙ্করবাবু তাঁকে বলেন গ্লোবটরটার। বলেন, কেননা অবনীবাবু তাঁর গবেষণার কাজে বিশ্বের নানান দেশে বিস্তর ঘুরে বেড়ান। তিনি এটাকে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিসপ্লে ফটো করেছেন। সেখানেও তাঁর বন্ধুরা এই ফটোটির তারিফ করেন। তখন তাঁর অভিষেকের সাথে কাজ করার দিনগুলির কথা বেশি বেশি মনে আসে।
একদিন অভিষেক অবনীবাবুর বসার ঘরে এসে বলল, “স্যার আমি দু সপ্তাহের জন্য দেশে যেতে চাই।” তখন সে অবনীবাবুর কাছে পিএইচডি করছে। কয়েকদিন আগেই তাঁর একটা গবেষণার কাজ এক বিশ্বসেরা পত্রিকা প্রকাশের অনুমোদন দিয়েছে। স্বভাতই সে বেজায় খুশি, আর তাই অবনীবাবুও।
অবনী: তা তুমি দেশে যাচ্ছ, তবে দু সপ্তাহ না গিয়ে চার পাঁচ সপ্তাহ যাও। তোমার তো বছরে ছয় সপ্তাহ ছুটি পাওনা।
অভিষেক: স্যার, আমি তিন চার মাস ছাড়া ছাড়া দুসপ্তাহের জন্য যেতে চাই।
অবনী: সেকি, তুমি লন্ডন থেকে লক্ষ্ণৌ যাবে, তা এত ঘন ঘন কেন? বাড়ির সকলের শরীর ঠিক আছে তো?
অভিষেক: হ্যাঁ, তবে আমার কিছু নিজের বিশেষ কাজ আছে স্যার।
অবনীবাবু মনে মনে ধারণা করলেন, এ ছেলে ঠিক কোনও বিশেষ বান্ধবীর সাথে দেখা করতে দেশে যাচ্ছে। তাই তিনি বাধা দেননি। মেধাবী ছেলেদের ক্ষেত্রে তিনি দেখেছেন, তাদের শর্তে কাজ করলে আখেরে তাঁরই লাভ হয় বেশি। তাই তারা যা চায়, তাতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিও দিয়ে দেন। তারা বিশ্বাসের মর্যাদাও রাখে আর বহু বছর ধরে তার মূল্যও দেয়। পরে অবনী জানতে পারলেন, সে দুসপ্তাহের এক সপ্তাহ যেত তার বাবা মায়ের কাছে লক্ষ্ণৌতে। আর এক সপ্তাহ যেত পুণেতে অতসীর সাথে দেখা করতে। ডঃ অতসী সান্যাল। এখন সে ইংল্যান্ডের একটি বেশ নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা। আর এখন অভিষেক একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যাপনা করে।
অভিষেক আর অতসী ছোট বেলার বন্ধু। দুজনেই উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরের একটি স্কুলে পড়ত। দুজনে দুজনকে পরীক্ষায় টক্কর দেওয়ার চেষ্টাও যেমন করত, তেমন একসাথে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য কাজকর্ম আর লেখালেখিও করত। এভাবে কয়েক বছর কাটার পর অতসীর বাবা কর্মসূত্রে বেনারসের ব্যাঙ্কে বদলি হয়ে পরিবার সমেত চলে গেলেন। আর যোগাযোগ থাকলো না। অতসী পরে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে স্নাতকোত্তর করে পুণেতে এক বহুজাতিক সংস্থায় কাজ শুরু করল। অভিষেক কোনও কোচিংএর সাহায্য না নিয়েই সুলতানপুর থেকে লক্ষ্ণৌ হয়ে আইআইটি দিল্লিতে বি টেক করে অবনী্বাবুর কাছ থেকে স্কলারশিপ পেয়ে এল পিএইচডি করতে। সে যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি বিনয়ী। প্রথম দু-এক সপ্তাহের একটু ঘষা-মাজাতেই অবনীবাবু বুঝে গেলেন, অভিষেক বেশ লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। খেলা জমে যাবে। হোলোও তাই। পিএইচডি-র দুবছরের আগেই বিশ্বের এক অন্যতম সেরা পত্রিকায় তার গবেষণা পত্র ছাপার অনুমোদনের খবর এসে গেল।
ওদিকে স্কুলের নীচু ক্লাসে অতসীর সাথে অভিষেকের সম্পর্কের ছেঁড়া শেকড় বহুদিন পরে হঠাৎ একদিন তার পুরানো মাটি খুঁজে পেল। সৌজন্যে অর্কুট। তখন সে আইআইটি দিল্লিতে বি টেক-এর ফাইনাল সেমেস্টারের ছাত্র বোধ হয়। আর অতসী দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে শেষের কয়েক মাস। একজনের হাতে পুণের চাকরির অফার, আর একজনের পাসপোর্ট দিল্লির চানক্যপুরীর ব্রিটিশ হাই কমিশনে ভিসার ছাপ লাগানোর জন্য জমা হয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মতো দেখা হলো দুজনের দিল্লিতে। ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে স্লগ ওভার, কিছুটা ঠিক তেমনই ।
অভিষেক লন্ডনে এল। অতসী বলল, মন দিয়ে পিএইচডি করিস। যোগাযোগ রাখিস। অভিষেক ঠিক করল অতসীর সাথে তার ছোট বেলার বন্ধুত্বটা আবার যেন না কাটে। অতসীও হয়ত তাই চাইত মনে মনে। এ প্রসঙ্গে একটা বাংলা গানের কথা মনে এল অবনীবাবুর। তিনি আবার মান্না দে-র গানের ভীষণ ভক্ত। সে অবনীর জন্মেরও আগে মান্নাবাবু একটি গান গেয়েছিলেন, কথাগুলি এইরকম :
“হাজার বদল হোক পৃথিবী,
পুরনো হবে না প্রেম কখনও
পারো যদি ফিরে এসো,
তোমারি থাকবো আমি তখনও”
হয়ত বা ঐ ‘যোগাযোগ রাখিস্ ‘ কথাটার মধ্যেই অতসীর মনের কথা তার মনের অবচেতনে লুকিয়েছিল। অভিষেক দেশ ছাড়ার আগে সে সবের আভাস পায়নি। সে কথা অনেক পরে সে অবনী্বাবুকে জানিয়েছিল। ঐ যা হয়, ছেলে ফটাফট অঙ্ক করতে পারে, কিন্তু প্রেম ভালোবাসার ইঙ্গিত ইশারা বুঝতে তার মাথা অত ঝটপট কাজ করে না।
বছর দুয়েক দুজনের যোগাযোগ মেলেই চলতে থাকল। অভিষেক অতসীকে জানাল তার গবেষণা পত্র আমেরিকাতে বের হয়েছে। সে দেশে আসছে দু সপ্তাহের জন্য। অতসী খুশীর খবর পেয়ে বলল সে অভিষেককে এর জন্য একটা গিফট দেবে। অভিষেক বলল, সেটা সে পছন্দ করতে পারে কিনা। অতসী বলল, আচ্ছা তাই হবে। সে তখন চাকরি করে পুণেতে। অভিষেকের পছন্দের গিফট কতই বা আর দামী হতে পারে অতসী ভাবছে। এভাবেই এসে গেল দেখা হওয়ার দিন। হঠাৎ একদিন পুণের একটি হোটেল থেকে অতসীর মোবাইল ফোনে অভিষেকের গলা ভেসে এল। সে বলল সে কয়েক দিনের জন্য পুণেতে এসেছে। অতসী এতটা আশা করেনি কিন্তু আঁচ করতে পারল। সে হোটেলে এল। দু একদিন এভাবেই লবিতে সন্ধ্যায় গল্প, শহরের রেঁস্তোরায় খাওয়া দাওয়া চলতে লাগল। অভিষেক মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে এবারেই সে কথাটা অতসীকে বলে দেবে। কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। অভিষেক গবেষণা পেপারের কপিটা অতসীকে দেখাল। শেষ পাতায় তার আর অবনীবাবুর ছবি। অতসীকে সে বলল, “জানিস আমার স্যার বাঙালী।”
অতসী শুনে খুশি হল। সে অভিষেককে বলল, “বাঙালিদের সবাই ভেতো বলে, দ্যাখ বাঙালিরা কেমন করছে।” অতসী প্রবাসী বাঙালী হলেও বাংলায় বেশ সড়গড়।
অতসী: কী গিফট নিবি বললি না তো ? মলে যেতে হবে যে।
অভিষেক বলল, “আমি যে গিফট চাই তার জন্য কোনো টাকা পয়সা লাগবে না।”
অভিষেক একথা বলার সাথে সাথেই অতসী কিছুটা ধরতে পারলো। অভিষেক মাঝে মধ্যে অবনীবাবুর গ্রুপের ছেলে মেয়েদের পার্টি , কনফারেন্সের ছবি পাঠিয়েছে অতসীকে। সেখানে ইরানের সারা, ইটালির ক্লদিয়া, জার্মানির স্টেফানী, গ্রিসের জর্জ, কলকাতার অঙ্কুর, কেরালার লিনাশ, শোলাপুরের যশোধন, ইন্দোনেশিয়ার হুসনি, নাইজিরিয়ার অনিয়েমারা আছে।
অতসী: লন্ডনের কত মেয়েদের কনফারেন্সের ছবি দেখলাম । সকলের সাথে কত মজা করছিস। এক সাথে কাজ করছিস। তোর ব্যাপার স্যাপার বোঝা মুস্কিল।
অভিষেক: যাদের ছবিতে দেখছিস ওরা আমার বন্ধু, কেউ বিশেষ বন্ধু নয়। ওরা আমার আবেগ, কিন্তু এখন যার সাথে কথা বলছি সে আমার আগ্রহ। বলেই, যা বলতে লন্ডন থেকে পুনেতে এসেছে, তা একেবারে খুলামখুল্লা করে বলেই ফেলল।
অতসী পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না, তবে সে তখন অভিষেককে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন যে দেখত না, তাও নয়। তাই কিছুদিন সময় নিয়ে সে তার সম্মতি দিয়ে দিল। অভিষেক এর পর বার দুয়েক লন্ডন থেকে দেশে গেল, কিন্তু খুব বেশি হলে দু একদিন লক্ষ্ণৌ, বাকি সময় তার পুণের হোটেলেই কাটত। ওদিকে বেনারসের সান্যাল আর লক্ষ্ণৌয়ের ত্রিবেদী পরিবার ঘোরতর আপত্তি জানালেন ওদের দুজনের ঘর বাঁধার প্রস্তাব তাঁদের কাছে আসার পর। অভিষেকের মা চাইছেন না, তাঁর ছেলের বাঙালি বউ হোক। হোলই বা অতসী সান্যাল বামুনের মেয়ে, কিন্তু বাঙালি বামুন তো মাছ মাংস খায়। ত্রিবেদী পরিবার ঘোরতর নিরামিষাশী। অভিষেকের মায়ের বেশ আপত্তি, ছেলে না আবার মাছ মাংস খাওয়া শুরু করে দেয়। অভিষেকের বাবার খাওয়ার দাওয়ার নিয়ে ততটা চিন্তা নেই যতটা পিএইচডি-তে কোনও ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তা নিয়ে। ভাবছেন এসব করতে গিয়ে পিএইচডিটা আবার যেন না কেঁচিয়ে যায়।
অনেক চেষ্টা করেও যখন অভিষেক তার মায়ের সম্মতি পেল না , তখন সে মাথা নিচু করে মাকে জানাল: মা বিয়ে করলে আমি অতসীকেই করবো। আর তা নাহলে সারা জীবন একা থাকতেও রাজি।
এদিকে অতসীর বাবা তরুণ কান্তি সান্যাল বাবুর হয়েছে অন্য দুশ্চিন্তা। তিনি যেন ঘর পোড়া গরু, তাই এই বিয়ের প্রস্তাবে সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেয়ে গেছেন। তাঁর বড় মেয়ে তানভী তার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করেছিল। বিপিন ত্রিপাঠী নামের বেনারসের সেই ছেলেটি কানপুর আইআইটি থেকে বি টেক আর আমেরিকায় এমএস করে নর্থ ক্যারোলিনাতে এক বিরাট কম্পিউটার কোম্পানিতে কাজ করত। বিয়ের দু বছরের মধ্যেই তাদের সম্পর্কে বাঁক দেখা দিল। তানভী বেনারসে শাস্ত্রীয় সংগীতের বহুদিন তালিম নিয়েছিলো। সে চ্যাপেল হিলে এসব অভ্যাস করতেও পারল না। বিপিনের সাথে তার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে তাদের ভালোবাসার সম্পর্ক একসময় তলানিতে পৌঁছল। আমেরিকা তার ভাল লাগলো না। সে আর বিপিন আপসেই এই সম্পর্কে ইতি টানল। তবে দুজনের কেউই মামলা মোকদ্দমার রাস্তায় হাঁটল না। তানভী বেনারসে বাবা মায়ের কাছে ফিরে এল। তরুণবাবু আর কল্পনাদেবী অনেক চেষ্টা করে আবার এই কয়েক মাস হল তানভীর বিয়ে দিয়েছেন। তানভী এখন তার স্বামীর সাথে দিল্লিতে থাকে। তবে এখনও তানভীর সুখী জীবনের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। অভিষেকও আইআইটির বি টেক। সেও বিলেতে পিএইচডি করে বিদেশেই থেকে যাবে। এ যে তানভীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অতসীর এই বিয়েটা হোক, তিনি কিছুতেই চান না। অতসীর মায়েরও এতে সায় নেই । এভাবেই কয়েক মাস কেটে গেল। অতসী পুনেতে কাজ করতে লাগলো। সেও তার মাকে বলল: মা অভিষেককেই আমার পছন্দ,অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না। ছেলে মেয়ে দুজনেই ধনুরভাঙ্গা পণের কথা জানিয়ে দিয়ে মনমরা হয়ে যে যার জায়গায় চলে গেল।
অভিষেক লন্ডন ফিরে এলো। কিন্তু তার গবেষণায় মন নেই। তার কাজের গতি কমে গেল। অবনীবাবুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সে এড়াতে পারল না। অবনীবাবু ডেকে জানতে চাইলেন, সে এত হতোদ্যম হয়ে গেল কেন। অভিষেক জানাল, সে চাকরি করবে, পিএইচডি শেষ না করেই। অবনীবাবু এবার ফ্যাসাদে পড়লেন, এই প্রজেক্ট শেষ হতে মাত্র বছর খানেক বাকি। তীরে এসে না তরী ডুবে যায়।
তিনি বললেন: তুমি তো আশ্চর্য ছেলে হে, পিএইচডি-র শেষ প্রান্তে আছো। এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ো না। বুঝিয়ে বোলো তোমাদের বাবা মাকে। অবাঙালির সাথে বাঙালির বিয়ে তো সেই কোন কাল থেকেই তো আকছার হচ্ছে। আমি বাঙালি। কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্ম পশ্চিম বাংলাতে হলেও, তারা তো আদতে ওড়িশার লোক। সে তো বাড়িতে যত বড় মাছই আমি আনি না কেন, তার হয় আমচুর, নয় তেঁতুল মাছের টক বানিয়ে দেয়। আমি তো মানিয়ে নিয়েছি, ঐ টক খেয়েই বেঁচে আছি। জীবনে ভালো কিছু করতে চাও, না এসব ক্ষুদ্রতার গণ্ডি আর তুচ্ছতার বেড়াজালের মধ্যে থাকতে চাও সে তোমাকেই ঠিক করতে হবে অভিষেক।
অবনীবাবু গত আড়াই বছরে যেভাবে অভিষেককে দেখেছেন, তাতে তাঁর তাকে বেশ ভাল লেগেছে। সে বিনয়ী, দায়িত্বশীল এক বুদ্ধিমান ছেলে। ছেলে বা মেয়ের বাড়ির লোকজন একে অন্যের সাথে না মিশেই না করে দিল, এটা ভেবে তিনি তাঁদের এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাঁদের ওপর মনে মনে একটু বিরক্ত হলেন। ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে ভাবলেন, কী করা যেতে পারে অভিষেকের জন্য। পরের দিন আবার অভিষেককে অবনীবাবু ডাকলেন, বললেন, সে যদি চায় , তাহলে তিনি তার আর অতসীর বাবার সাথে কথা বলবেন। অতসীরা বাঙালি, তাঁর মত বিলেতে প্রতিষ্ঠিত এক বাঙালি অধ্যাপকের কথা অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য হবে তরুণবাবুদের কাছে, এরকম একটা ভাবনা তাঁর মনে এলো। ঠিক করলেন চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি। অভিষেক বেশ খুশি হল সে প্রস্তাবে। কেননা সে অতটা আশা করেনি তাঁর স্যারের থেকে। দু এক দিনের মধ্যেই অভিষেক আর অতসী তাদের মা বাবাকে অবনীবাবুর প্রস্তাব দিল।
কয়েকদিনের মধ্যেই অবনীবাবু অভিষেকের বাবার সাথে ফোনালাপ করলেন। জানালেন, তাঁর ছেলে খুব ভালো কাজ করছে, তিন চার মাসের মধ্যেই সে থিসিস লেখা শুরু করবে। আর তার দু তিন মাসের মধ্যেই তা জমা হয়ে যাবে। তার দু মাসের মধ্যে তার শেষ মৌখিক পরীক্ষাও হয়ে যাবে। কাজেই সব কিছুই আয়ত্তের মধ্যে আছে। আলাদাভাবে অতসীর বাবা মাকে অভিষেকের সম্পর্কে তিনি যে ধারণা করেছেন, সে সব বললেন। তিনি তাঁদের কাছে ছেলেটির নানান গুণপনা করলেন। তিন মাস পরে তিনি ভারত আর ব্রিটিশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে দিল্লিতে এনার্জি কো-অপারেশান কনক্লেভে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা চাইলে দিল্লিতে তাঁর সাথে দেখা করতে পারেন হোটেলে। অতসীর মা বাবার প্রস্তাবটা ভাল লাগলও। তাহলে দিল্লিতে তানভী কেমন আছে সেটাও দেখতে পাওয়া যাবে। ব্যাঙ্কে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে তরুণবাবু তাঁদের বড় মেয়ে তানভীর কাছে কয়েকদিন দিল্লিতে থেকে অবনী বাবুর সাথে একদিন সন্ধেবেলায় তাঁর হোটেলে দেখা করলেন। অবনীবাবু, তরুণবাবু, কল্পনা দেবী, আর তানভী হোটেলের নীচে রেস্তোরাঁতে চা আর স্ন্যাক্স খেতে খেতে কথাবার্তা বললেন । ছেলে হিসেবে অভিষেকের তিনি আবার প্রশংসা করলেন। অভিষেকের বাবার সাথেও যে তিনি কথা বলেছেন, সেটা তাঁদের জানালেন। অবনীবাবুর সাথে মুখোমুখি কথা বার্তা বলতে পেরে তাঁরা অভিষেকের ব্যাপারে অনেকটা আশ্বস্ত হলেন।
পরে দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হোল। আর তার ৮-৯ মাস পরেই সান্যাল আর ত্রিবেদী পরিবার ব্যবস্থা করে অতসী আর অভিষেকের বিয়ের অনুষ্ঠান ধুমধাম করে সম্পন্ন করলেন। অভিষেকের থিসিস জমা দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার আগেই দেশে এসে বিয়ে করে ফেলল, সে অবনীবাবুর কাছেই পোস্টডক করবে অন্য প্রজেক্টে এসব পাকাপাকি করে এসেছিল। অবনী বাবু দুই দিক থেকেই নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু তিনি বিলেত থেকে আসতে পারবেন না, তা জানালেন । তাঁকে আমন্ত্রণের জন্য তাঁদের ধন্যবাদও জানালেন। অভিষেক অতসীকে লন্ডনে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই অবনীবাবু ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। তবে তাঁর জীবনে ঐ প্রথম ঘটকালীর অভিজ্ঞতাটা যে তিনি তখন ভালোই উপভোগ করেছিলেন, সেটা তিনি তার দু একজন বন্ধুকে বলেছিলেন।
বিয়ের কিছুদিন পরে অতসী পুনের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অভিষেকের সাথে লন্ডনে এল । একদিন অভিষেক অবনীবাবুর জন্য লক্ষ্ণৌ চিকনের কাজ করা একটি সুন্দর আকাশী নীল (সে জানত এটা অবনীবাবুর পছন্দের রঙ) শেরওয়ানী, মিষ্টির প্যাকেট আর সঙ্গে একেবারে লাল টুকটুকে বউ নিয়ে অবনীবাবুর বসার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “মে আই কাম ইন স্যার ?” “ইয়েস কাম ইন।”
ঘরে ঢুকেই অতসীকে দেখিয়ে বলল, “সি ইজ অতসী, মাই ওয়াইফ।”
সঙ্গে সঙ্গে অবনীর মুখ থেকে বেরোল, “ওহ্ মাই গড।”
অমনি হৈ হৈ করতে করতে তিনি তাঁর সব ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে ওদের সাথে চা কফি কুকিজ খেতে চলে গেলেন। সারা , স্টেফানী , যশোধন , অঙ্কুর , লিনাশ, হুসনী, ওনিয়েমারা অভিষেকের প্রেম আর বিয়ের গল্প শুনে মুখ চেপে হাসতে লাগল। কফি আর কুকি শেষ করতে দেরি হল।
এসেই অতসী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্সে পিএইচডি শুরু করল। তার পর অভিষেক চাকরি নিয়ে লন্ডনের বাইরে লিঙ্কনশায়ারে চলে গেল। লিঙ্কনশায়ারে স্যার আইজাক নিউটনের গ্রামের বাড়ি, যে বাড়ির বাগানের আপেল গাছের থেকে আপেল পড়া দেখে স্যার নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিস্কার করেছিলেন ১৬৮৬-৮৭ সালে। সেখানে ওরা একদিন ঘুরে এসেছে, নিউটনের বাড়ি বাগান সবই আছে , তবে সেদিনের আপেল গাছটা আর নেই।
ছোট থেকেই অভিষেকের আঁকার নেশা । পাঁচ বছর বয়সে, পাঁচ টাকার নোটের ছবি এঁকে সে সুলতানপুরের নার্সারি স্কুলে পুরস্কার পেয়েছিল । অভিষেক পি এইচডি পোস্টডক সেরে চলে যাওয়ার আগে অবনীবাবু আবার একদিন ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। ওরা সেদিন অবনীবাবুর বাড়িতে এল। আর সঙ্গে আনল অবনীর ঐ ছবিটার একটা স্কেচ। সেটাই অবনীবাবু তাঁর অফিসের দেওয়ালে রেখে দিয়েছেন।
অবনীর কাছে অভিষেকের ভালোবাসা তাঁর জীবনে এক বিরল ও মধুর প্রাপ্তি। তাই অভিষেকের শিল্পী সত্ত্বা আর ওঁর প্রতি অভিষেকের শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে সন্মান জানানোর জন্য অবনী ঐ স্কেচটাকে ডিসপ্লে ফটো করেছেন। তাছাড়া অবনীর হোয়াটসঅ্যাপে ঐ ধরনের একটা ছবি থাকাতে তাঁর একটা বড় ফ্যান ক্লাব হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারেন । লোকমান্যতা তিনি ভালই উপভোগ করেন। তাই ওটাই রেখে দিয়েছেন ।