হোমদেশপশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত রাখার সবরকম চেষ্টা চালাবে বিজেপি

পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত রাখার সবরকম চেষ্টা চালাবে বিজেপি

পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত রাখার সবরকম চেষ্টা চালাবে বিজেপি

jawar sirkarজহর সরকার

বিপুল ভোটে জিতে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে এই মুহূর্তে সবকিছুকে ছাপিয়ে রাজ্যে হিংসার ঘটনা খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও, ভোটের পর সংঘর্ষ, মৃত্যু এবং জখম হওয়ার ঘটনা বেড়ে চলেছে। বলা যায়, গত ৫০ বছর ধরে নির্বাচনকে ঘিরে বাংলায় হিংসার রাজনীতির যে ট্র্যাডিশন চলে আসছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। তৃণমূল বা বিজেপি, এর দায় এড়াতে পারে না কোনও রাজনৈতিক দলই।

তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। দায়িত্ব নিয়েই কড়া মনোভাব নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে শতাধিক অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তবে এর পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্বেগজনক ঘটনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

ভোটের ফল যদি বিরুদ্ধে যায়, তবে বিজেপি কী করবে, তা নিয়ে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে “প্ল্যান বি” তৈরি করে রেখেছিল কেন্দ্রের শাসক দল। শোচনীয় হারের (যা নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের মুখ পুড়িয়েছে) ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রচারের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিল বিজেপি। দেশজুড়ে তুলে ধরা হল, বাংলায় হিংসার ঘটনাবলী। যদিও করোনা থেকে নজর ঘোরাতে পারেনি গেরুয়া শিবির।

তবে দেখা গেছে, হিংসার যে সব খবর মিডিয়ার নজরে আনা হয়েছে, তার বেশিরভাগই “ফেক নিউজ” অর্থাৎ পুরোপুরি ভুয়ো। এই খবরগুলি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪তে ক্ষমতার আসার পর সংগঠিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে এভাবে ব্যবহার করে চলেছে বিজেপির আইটি সেল।

ভোটের পর বাংলাতেও একই কৌশল নিয়েছে বিজেপি। #BengalBurning এবং #BengalViolence নাম দিয়ে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে এইসব খবর ছড়ানো হচ্ছে।

এখানে একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। সাংসদ এবং বিজেপি যুব মোর্চার সভাপতি এরকম একটি পোস্টে দাবি করেছেন, “বীরভূমের নানুরে বিজেপির এক কার্যকর্তাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। নানুর থেকে ধর্ষণ ও নিগ্রহের রিপোর্ট পাচ্ছি।” বিজেপি এই খবরটি ছড়িয়ে দিতে থাকে। দলের এক প্রাক্তন সাংসদ টুইট করে লেখেন, “নানুরে ( বীরভূম জেলা) ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। হামলার হাত থেকে বাঁচতে এক হাজারের বেশি বিজেপি সমর্থক হিন্দু পরিবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। নারীনিগ্রহেরও রিপোর্ট পাচ্ছি। @AmitShah দয়া করে নিরাপত্তা বাহিনী পাঠান।”

ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন বীরভূমের পুলিশ সুপার। পরে তিনি জানান, পুরো ঘটনাটি মিথ্যে। কিন্তু এই লিঙ্কটির সূত্র ধরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একের পর এক বিভ্রান্তিকর টুইট করা হতে থাকে।
যেমন, তলোয়ার ও ছুরি নিয়ে বিজয় উৎসব উদযাপন করছে তৃণমূল। সঙ্গে “তৃণমূল গুন্ডাদের পুলিশকে আক্রমণে”র একটি ভিডিও। ভিডিওটি ওড়িশার একটি পুরনো ঘটনার ক্লিপিং। হিংসা, ঘরবাড়ি জ্বালানোর এই ধরনের আরও পুরনো ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

আর গোদি মিডিয়া বিশেষত টিভি চ্যানেলগুলি এইসব ভুয়ো ছবি দেখাতে থাকে। তবে কয়েকটি চ্যানেল ছবির সত্যতা যাচাই তবেই সম্প্রচার করেছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোনওরকম সত্যতা যাচাই না করে মিডিয়া এইসব “ফেক নিউজ ফিড” সম্প্রচার করল কীভাবে?

আসলে নির্বাচনে আগে থেকেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাংলায় ক্ষমতায় আসছে বিজেপি। মিডিয়ার একটা বড় অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, বিজেপির জয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। বিভিন্ন সমীক্ষায় এও বলা হয়েছিল, তৃণমূল যদি জেতে, জয়ের ব্যবধান হবে সামান্য।

অনেক মিডিয়া এখন মুখ বাঁচানোর পথ খুঁজছে। আর সেক্ষেত্রে একমাত্র হাতিয়ার হল হিংসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া। বিজেপির হার পিছনে চলে গেল। বদলে সামনে চলে বাংলায় হিংসার খবর।

জনতার রায়ে বিজেপিকে বিপুল ভোটে হারিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরলেও, দিল্লি এবং নানা জায়গায় বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে বিস্তর চর্চা চলছে। রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশনও পেশ করা হয়েছে। হেভিওয়েট নেতাদের ভোটের ময়দানে নামিয়েও হেরেছে বিজেপি। তবু তারা দমতে নারাজ। তাই রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি করে চলেছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। মোদী-শাহ জুটি কাশ্মীর এবং দিল্লিতে অগণতান্ত্রিক পথে যে কর্তৃত্ব কায়েম করেছে, দেশের অন্যত্রও তাঁরা একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চাইছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুব একটা শান্তিতে রাজ্যশাসন করতে দেবেন না নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, মমতা এখন জাতীয় রাজনীতিরও মুখ হয়ে উঠতে চলেছেন। একসঙ্গে এতগুলি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে লেলিয়ে দিয়েও তাঁকে হারানো যায়নি। জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে মমতা যদি সক্রিয় হন, তাহলে আগামী লোকসভার নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে যথেষ্ট বিপদের কারণ হতে পারে। এটা মোদী-শাহরা আন্দাজ করতে পারছেন। তাই ছলে বলে কৌশলে মমতাকেই তাঁরা বারবার নিশানা করবেন, তা বলাই বাহুল্য।

পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, বিজেপি ৩৮ শতাংশ পেয়েছে, যা উপেক্ষার নয়। ২০১৪তে ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই তুলনায় ৩৮ শতাংশ ভোট যথেষ্ট বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালোভাবেই জানেন, এবার তিনি শিক্ষিত, সংস্কৃতি সচেতন, মধ্যবিত্ত বাঙালির ভোট বিপুলভাবে পেয়েছেন। অন্য দলের সমর্থক হয়েও তাঁরা বিজেপিকে রুখতে মমতাকে ভোট দিয়েছেন। এই বিষয়টি অবশ্যই তৃণমূল নেত্রীকে মাথায় রাখতে হবে। এই ভোটারদের আস্থার মর্যাদা তাঁকে দিতে হবে। কঠোর হাতে তাঁকে যেমন গোষ্ঠী-কোন্দল দমন করতে হবে, তেমনই প্ররোচনার ফাঁদ এড়িয়ে চলতে হবে। সেইসঙ্গে কেন্দ্রের দিক থেকে যে আরও বেশি আক্রমণ নেমে আসবে, সে ব্যাপারে মমতাকে মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে।

# জহর সরকার প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এই আমলা।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img