হোমফিচারউড়োজাহাজ : অপূর্ণ স্বপ্নের বিষাদ- গাথা

উড়োজাহাজ : অপূর্ণ স্বপ্নের বিষাদ- গাথা

উড়োজাহাজ : অপূর্ণ স্বপ্নের বিষাদ- গাথা

  শিশির ভট্টাচার্য, সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা

রাষ্ট্র চায় না তার নাগরিক স্বপ্ন দেখুক। কিছু করার স্বপ্ন, হয়ে ওঠার স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখাকে ভয় পায় রাষ্ট্র। তাই সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, নানা তকমায় নেমে আসে পীড়ন। নাগরিককে বাধ্য করা হয় স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা না করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নাট-বল্টু হয়ে উঠতে।বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত উড়োজাহাজ ছবিটি দেখে তাই মনে হচ্ছিল।

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, যাঁর সিনেমা মানেই বারে বারে ঘুরেফিরে আসে পুরুলিয়া।

মনে হচ্ছিল, এ তো আমাদের চেনা ছবি। প্রতি দিন আমাদের চারপাশে সংবাদপত্রে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আমরা তো এরই প্রতিফলন দেখছি। সাধারণ মানুষ গরীব ঘরের মানুষ, অবহেলিত নীচু জাতের মানুষ, তারা স্বপ্ন দেখবে? দেখলে সন্দেহ হবে না! এ যে একেবারে অনধিকার চর্চা। সুতরাং রাষ্ট্র বৃহত্তর নাগরিকসমাজের স্বার্থে ব্যবস্হা নিতে বাধ্য হয়। উড়োজাহাজ ছবির protagonist সন্ত্রাসবাদী, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। পুলিশ তাঁকে পীড়নের জন্য, তাঁর উপর অত্যাচার চালানোর জন্য ধরে নিয়ে যায়। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। যায় কি? ছবির প্রায় শুরুতেই আমরা দেখি অসংখ্য অতৃপ্ত আত্মারা উঠে আসছে। তাদের কেউ চেয়েছিল প্রেম, কেউ ভালোবাসা কিংবা আর্থিক স্বচ্ছলতা। কিন্তু কারোরই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তারা আত্মহত্যা করে স্বপ্ন দেখার দায় মুক্ত হয়েছে। তারা আজও ভাবে , আবার যদি জন্ম নেয় , তখন কি স্বপ্ন পূরণ হবে? বুঝতে পারে না স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন সফল হওয়া এক নয়। স্বপ্ন দেখা বিপজ্জনক। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র, কেউই স্বপ্ন দেখা পছন্দ করে না।

উড়োজাহাজ সিনেমার একটি দৃশ্যে

কিন্তু অবুঝ protagonist বাচ্চু মন্ডল তবু স্বপ্ন দেখে ,একদিন উড়োজাহাজ নিয়ে আকাশে উড়ে যাবে। তার ভালোবাসার বৌ আর আদরের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে অসীম শূন্যে পাড়ি দেবে। সে এক মুক্তির অনাবিল আনন্দ ।

উড়োজাহাজ সিনেমার একটি দৃশ্যে

গরীব মোটর মেকানিক সে উড়োজাহাজ পাবে কোথায়! কিন্তু একদিন তারও সন্ধান মিললো। জঙ্গলে একটি পরিত্যক্ত যুদ্ধ বিমানের সন্ধান পেলো সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যবহৃত একটি জাপানি যুদ্ধ বিমানের ভাঙ্গা কাঠামো পড়ে আছে শুধু। চলল এটি সারিয়ে নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করার কাজ। ঘর সংসার, মোটর সারানোর কাজ, সব ছেড়ে চলল বিমানটিকে নতুন করে তৈরির চেষ্টা। ধীরে ধীরে বিমানটি রূপ পেতে শুরু করে। দিন যায়। আমরা দেখি ভাঙ্গা বিমানটি উড়বার উপযোগী হয়ে উঠছে। যদিও অতৃপ্ত প্রেতাত্মারা শেক্সপীয়ারের নাটকের ডাইনিদের মতো তাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়ে যায় সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সফল হয় না। ব্যর্থতা এবং আত্মহত্যাই তার পরিণতি। কিন্তু protagonist তার লক্ষ্যে স্থির থেকে বিমানটি পুনর্নির্মাণের কাজ চালিয়ে যায়। শব্দের যাদু আর দৃশ্যের বর্ণময়তায় পরিচালক আলো আঁধারির রহস্যে গড়ে তোলেন এক “যাদুবাস্তব”। আমরা দর্শকরা বিমুগ্ধ হই ।

সিনেমার মুখ্য ভূমিকায় চন্দন রায় সান্যাল ও পার্নো মিত্র।

প্রথম গোল বাঁধল কাজের জায়গায় অনুপস্থিতি, বাড়ি ছেড়ে দিনের পর দিন সকলের অগোচরে জঙ্গলে বিমান তৈরির কাজে মগ্ন হওয়ায়। সকলের সন্দেহ, ও কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নাকি! কেউ তাকে মনে করে পাগল, ভালোবাসার মানুষের মনে জাগে সন্দেহ। বাচ্চু মন্ডল স্বপ্ন পাগল, ভালোবাসা পাগল একটি মানুষ। তাই তার ঘরের জানালা- দরজা- দেওয়াল সব অদৃশ্য হয়ে যায়। খোলা হাওয়ায় স্বপ্নেরা খেলা করে, ভালোবাসা ডানা মেলে। কবি বুদ্ধদেব এক কাব্যময় পরিবেশ তৈরি করতে কলম ছেড়ে ক্যামেরাকে হাতিয়ার করেন।

উড়োজাহাজ সিনেমার একটি দৃশ্যে

পরবর্তী গোলমালের শুরু বিমানের জন্য প্রয়োজনীয় ইঞ্জিনের খোঁজ করতে থাকা। ইঞ্জিন পাবে কোথায়? এটি একটি বহুমূল্য সামগ্রী। এই সত্য স্বপ্ন পাগল যুবকটি বুঝতেই পারে না। সমাজের চারপাশের মানুষের কাছে ব্যঙ্গর পাত্র হয়ে ওঠে। সমাজের বিত্তশালী, বুদ্ধিমান মানুষেরা তাকে বুঝিয়ে দেয় , তার মত একজন সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখা কৌতুকের বিষয় মাত্র। কোথায় পাবে সে এত অর্থ! কি আছে তার কারিগরি জ্ঞান! স্বপ্ন পাগল বাচ্চু এসব কিছুই বুঝতে পারে না।

‘উড়োজাহাজ’-এর দৃশ্য

একদিন পুলিশের কাছে খবর যায়, তার এই অদ্ভুত খেয়ালের ব্যাপারে। পুলিশ হয়ে ওঠে সন্দিহান। বাচ্চু কি কোনো বিদ্রোহ বা সন্ত্রাসের পরিকল্পনা করছে? যুক্তি কার্যকারণের কোনও স্থান নেই। রাষ্ট্র সবাইকে সন্দেহ করে। পুলিশ উড়োজাহাজটি নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। রাষ্ট্র তার দখলদারী কায়েম করে। protagonist এর উপরে শুরু হয় দমন, পীড়ন। কেন সে উড়োজাহাজ নিয়ে উড়ে যাবার স্বপ্ন সফল করতে পারবে না, বূঝতেই পারে না। সমাজ, রাষ্ট্র কেউ তাকে সাহায্য করতে উৎসাহী নয়। নাছোড়বান্দা সেও। তার স্বপ্ন সফল করবেই। শেষ পর্যন্ত পুলিশ যখন তাকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবেই বন্দি করে প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাচ্ছেল, পুলিশকে ভুল বুঝিয়ে পালাতে গেলে,পুলিশ তাকে গুলি করে মারে। কিন্তু স্বপ্ন? Protagonist কিন্তু আত্মহত্যা করল না। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। পরিচালক শেষ দৃশ্যে এক চমক দেওয়া প্রতীকের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন
দমন-পীড়ন স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারে না। পুলিশের গুলির নির্মমতা উপেক্ষা করে protagonist এক সমুজ্জ্বল রানওয়ে দিয়ে অসীম আকাশে নীল নীলিমায় উড়ে গেল। ঠিক যেন একটা উড়োজাহাজ নিয়েই উড়ে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল এক ঝাঁক স্বপ্ন। বিমূঢ় দর্শকদের কাছে রেখে গেল বুক ভরা বেদনা আর স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img