হোমআন্তর্জাতিকCRIME REPORTER : শিশু চিনিয়ে দিল তার পূর্ব জন্মের খুনিকে

CRIME REPORTER : শিশু চিনিয়ে দিল তার পূর্ব জন্মের খুনিকে

CRIME REPORTER : শিশু চিনিয়ে দিল তার পূর্ব জন্মের খুনিকে

(CRIME REPORTER: এই পর্বে শোনানো হবে নানা অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী । বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প ,আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : নতুন কোনও জায়গায় গিয়ে আমাদের অনেকেরই মনে হয় জায়গাটা কতদিনের চেনা। পাহাড়, নদী, সমুদ্র যেন আমাদের আপনজন। নতুন কাউকে দেখলেই মনে হয়, কত কাছের লোক। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে গল্প করে সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় তাঁকে যেন আগে কোথাও দেখেছি। আবার যাকে চিনি না, জানি না, এমন অচেনা, অজানা মানুষকে দেখে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি জ্বলে ওঠে।

প্যারা সাইকোলজিস্টরা বলছেন, এসব পূর্ব জন্মের ফল। পূর্ব জন্মের কিছু কিছু ঘটনা আমাদের অবচেতন মনে রয়ে যায়। কিন্তু মনে করতে পারি না। যাদের স্মৃতিতে পুরোপুরি রয়ে যায়, যারা মনে করতে পারেন, তাঁদেরই বলা হয় জাতিস্মর। এদের বয়স সাধারণত দুই থেকে সাত বছরের মধ্যে হয়। সাত বছর বয়স পর্যন্ত পূর্বজন্মের কথা এদের মনে থাকে। এবং পূর্বজন্মের পরিবারের সঙ্গে বর্তমান জন্মের পরিবারের কোন সম্পর্ক অথবা পরিচয় থাকে না। যেমন কলকাতার দেবলীনা, উত্তর প্রদেশের সুনীল। আজ অবশ্য সেই গল্প বলব না । আজ একেবারে সাম্প্রতিক 2008-এর ঘটনা। চলে যাব সুদূর সিরিয়ায় ।

ষাটের দশকে এক জাতিস্মর বালককে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উৎসাহেই কলকাতায় তৈরি হয় প্যারাসাইকোলজি সোসাইটি। অফিস ছিল লালমোহন ভট্টাচার্য রোডে। উত্তমকুমারের মতো সত্যজিৎ রায়ও ছিলেন এই সোসাইটির আজীবন সদস্য। সোসাইটির কাজকর্মের মধ্য দিয়েই সত্যজিতের সঙ্গে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাকা, বিমল চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় ঘনীভূত হল। সোসাইটির মাধ্যমে হেমেনবাবুর গবেষণা বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ রায়ও।

সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতেও জাতিস্মর মুকুলের আড়ালে লুকিয়ে ছিল প্রভু নামের রাজস্থানের একটি ছেলে, আর প্যারাসাইকোলজিস্ট ড. হেমাঙ্গ হাজরার মধ্যে ধরা পড়েছিল জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি। আর গাজা স্ট্রিপের হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন ডঃ ল্যাসচ।

গাজা স্ট্রিপের স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডঃ ল্যাসচ। প্যারাসাইকোলজি নিয়ে তাঁর আছে বিস্তর পড়াশোনা আর গবেষণা। ড্রুজ আদিবাসী এক শিশুর খবর পেয়ে তিনি প্রচণ্ড উৎসাহী হয়ে পড়েন। শিশুটির পরিবারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শিশুটিকে নিয়ে সটান চলে এসেছিলেন সিরিয়ায়। দুটি গ্রাম দেখার পর তৃতীয় গ্রামটি চিনতে পেরেছিল জাতিস্মর শিশুটি। যে গ্রামে ছিল তার বাড়ি। যেখানে তাকে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল।

গ্রামের কাছে এসেই শিশুটি ডঃ ল্যাসচের হাত ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে দৌড়তে শুরু করেছিল। গ্রামের একটি বাড়ির সামনে গিয়ে একজনের নাম ধরে ডেকেছিল। এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসেছিলেন। শিশুটি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছেন, আর তাঁর শ্বাসকষ্ট এখনও আছে কিনা। বৃদ্ধা মহিলা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “কে তুমি, কী করে জানলে আমার এই রোগ আছে?”

এরপর শিশুটি গড়গড় করে গ্রামের বাসিন্দাদের নাম বলতে থাকে। কোনটা কার বাড়ি বলে দিতে থাকে। উপস্থিত গ্রামবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে যান। ডঃ ল্যাসচের টিম সব তথ্য লিখে নিতে থাকে। শিশুটির চোখ, এর পর ঘুরতে থাকে ভিড়ের ভেতর। কাকে যেন সে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ শিশুটি একজন লোকের নাম ধরে ডেকে তার জামা টেনে ধরে। বছর চল্লিশের লোকটিও গ্রামবাসীদের কাছে স্বীকার করেছিল, শিশুটি ঠিক নাম ধরেই ডেকেছিল।

ক্রোধে শিশুটির মুখ চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, “আমি তোমার প্রতিবেশী ছিলাম। আমাদের মধ্যে মারপিট হয়েছিল। তুমি আমাকে কুঠারের ঘা মেরে খুন করেছিলে।” শিশুটির কথা শোনা মাত্র লোকটির মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল আতঙ্কে।

শিশুটি এরপর লোকটিকে নিজের পূর্বজন্মের নাম বলেছিল। এ বারও স্তম্ভিত হয়ে যান গ্রামবাসীরা। সেই নামে সত্যিই একজন লোক ওই গ্রামে বাস করতেন। কিন্তু লোকটি গত চার বছর ধরে নিরুদ্দেশ। শিশুটি তার পূর্বজন্মের খুনিকে বলেছিল, “আমার মনে আছে তুমি আমাকে কোথায় কবর দিয়েছিলে” বলেই শিশুটি দৌড়াতে শুরু করেছিল। পিছন পিছন দৌড়াতে শুরু করেছিলেন ডঃ ল্যাসচের গবেষক দলটি ও গ্রামবাসীরা।

গ্রাম থেকে দূরে, একটা মাঠে সবাইকে নিয়ে গিয়েছিল শিশুটি। সেখানে পাথর দিয়ে তৈরি করা একটি স্তূপের কাছে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে শিশুটি জানিয়েছিল, “লোকটি আমার দেহ এই খানে কবর দিয়েছিল। আর কুঠারটি ওখানে পুঁতে রেখেছিল।”

পাথর সরিয়ে কবর খোঁড়া শুরু হয়। বেরিয়ে আসে একটি কঙ্কাল। গায়ে চাষীর পোশাক। কঙ্কালটির মাথার খুলি দুভাগ হয়ে গেছে। সুষ্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে কুঠার জাতীয় কোনও অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত হানা হয়েছিল। শিশুটির দেখানো অপর জায়গাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় খুনে ব্যবহৃত কুঠারটিও।

সাজা পায়নি তথাকথিত খুনি, কারণ বিজ্ঞানের কাছে জাতিস্মর বিষয়টিই অবৈজ্ঞানিক। তবে
গ্রামের লোক চেপে ধরতেই খুনি তার অপরাধ স্বীকার করেছিল। কিন্তু সিরিয়ার পুলিশে তাকে গ্রেফতার করেনি। কারণ জাতিস্মরের ভাষ্য বিজ্ঞানের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে খুনির সাজা হয়নি। ছেলেটি ও খুনির নাম আজও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। পুলিশও বেওয়ারিশ লাশ প্রাপ্তির মামলা দায়ের করে দায় সেরেছিল।

ডঃ ল্যাসচ মারা গিয়েছিলেন ২০০৯ সালে। তাঁর পরে আর কেউ বিষয়টা নিয়ে কোনও অনুসন্ধান করেননি। তবুও চাঞ্চল্যকর এই কাহিনীটি জাতিস্মর বিতর্ক আবারও উসকে দিয়ে গেছে। যাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়তো সম্ভব নয়।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img