হোমআজকের সেরা খবরCRIME REPORTER: এক রাতে ৩ খুন, যে হত্যাকাণ্ড নাড়া দিয়েছিল বাংলাকে

CRIME REPORTER: এক রাতে ৩ খুন, যে হত্যাকাণ্ড নাড়া দিয়েছিল বাংলাকে

CRIME REPORTER: এক রাতে ৩ খুন, যে হত্যাকাণ্ড নাড়া দিয়েছিল বাংলাকে

(CRIME REPORTER: এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : ২০০৩-এর ফেব্রুয়ারির কথা। পশ্চিম মেদিনীপুরের জামবনি। এক কুখ্যাত ক্রিমিনাল গ্যাং বহু ক্রাইম করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যথারীতি তার পেছনে পড়ে ছিল পুলিশ। ওই গ্যাংয়ের একজন আচমকা পুলিশের হাতে পড়ে যায়। একটা ডাকাতির ঘটনায় তাকেও পুলিশ খুঁজছিল। তাকে পাকড়াও করার পর জানা যায় তার নাম, শেখ রাজু। আগেই পুলিশের জানা ছিল, শেখ রাজু বলে একটি ছেলে ওই গ্যাং-এর সাথে যুক্ত। ‌এবং স্থানীয়ভাবে সে প্রচুর অপরাধ করে বেড়াছে। মেদিনীপুর পুলিশ শেখ রাজুকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর ডাকাতির অভিযোগে তাকে কোর্টে পেশ করা হয়। ‌ আদালত বিচারবিভাগীয় হেফাজতে তাকে মেদিনীপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়। ‌

এরপর মার্চ, এপ্রিল, তিন মাস দেখতে দেখতে কেটে যায়। ‌ শেখ রাজু তখনও মেদিনীপুর জেলেই বন্দি । তিন মাস পরে ওই জেলে একজন নতুন জেলার বদলি হয়ে আসেন। ‌এর আগে আলিপুর জেলে ছিলেন। জেলারের কাজ জেলের ভিতর বন্দিদের ব্যাপারে সব কিছু জানা এবং তাদের সাথে আলাপ পরিচয় রাখা। তাদের সুযোগ সুবিধা দেখা।  এই নতুন জেলার এই ভাবেই বন্দিদের  সঙ্গে পরিচয় করতে গিয়ে হঠাৎ তার শেখ রাজুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। শেখ রাজুকে দেখেই উনি চমকে ওঠেন। ‌ নাম জিজ্ঞেস করেন। সে বলে, আমার নাম শেখ রাজু। ‌ কিন্তু তাতেও নতুন জেলারের কেন জানি একটা সন্দেহ হয়। ‌ তিনি ওকে তার অফিসে নিয়ে যান। ‌ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। ‌ শেখ রাজু সম্পর্কে সমস্ত কাগজপত্র বের করেন। কোন অপরাধে তাকে মেদিনীপুর জেলে পাঠানো হয়েছে সেটা দেখার জন্য শেখ রাজুর ফাইল পড়তে থাকেন। ‌ফাইলে  দেখেন তখন সেখানেও শেখ রাজুরই নাম লেখা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওনার যেন কোথায় একটা খটকা লাগে। তিনি আলিপুর জেলে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। শেখ রাজুর ছবি চেয়ে পাঠান। এবং তিনি ফের শেখ রাজুকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠান।  তখন জানা যায় মেদিনীপুরের জেলে বন্দি এই ব্যক্তি শেখ রাজুই নয়।  তার আসল নাম সজল বারুই। 

সেই-ই সজল বারুই। এই ঘটনার ঠিক ১০ বছর আগে ১৯৯৩-তে ফিরে যেতে হবে। শুধু কলকাতা নয়, ভারতের বিভিন্ন শহরে তার কুখ্যাত হিসাবে পরিচিতি ঘটেছিল। দুটো কারণ ছিল। প্রথমত তার অপরাধের চরিত্র। দ্বিতীয়তঃ সে যে বয়সে, যে কারণে অপরাধ করেছিল।

মেদিনীপুর জেলের নতুন জেলার বুঝতে পারলেন,  এ শেখ রাজু নয়, আদপে সজল বারুই। এ সেই ব্যক্তি, যে জেল থেকে ফেরার। ‌কিন্তু যে কারণে সে জেল থেকে পালিয়েছিল, সেই কারণে সে গ্রেফতার না হয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্য আরেকটি ডাকাতির মামলায়। সে নিজের আসল পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করেছে।  এরপর সমস্ত প্রমাণপত্র তার সামনে রাখলে জানা যায় সে সজল বারুই। ‌এবং সজল বারুই নিজেও সেটা স্বীকার করে নেয়।

সজল বারুইকে মেদিনীপুর জেল থেকে বের করে আনা হয়। ‌এবং ফের কলকাতার আলিপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ‌আর এখান থেকেই আরেক কাহিনীর শুরু। কেন সে জেল ভেঙে পালিয়ে ছিল এই হল সেই কাহিনী। আবার পিছিয়ে যেতে হবে তিরানব্বইতে ।

দমদম থানা এলাকায় শুভম অ্যাপার্টমেন্টের চার তলায় ফ্ল্যাট নাম্বার 4A-তে বারুই পরিবারের বাস। পরিবারের কর্তা ছিলেন সুবল বারুই। ‌ তার স্ত্রী নিয়তি বারুই।‌ ওদের বড় ছেলে কাজল বারুই এবং ছোট ছেলে সজল  বারুইকে নিয়ে ছোট পরিবার। ‌ সুবল বারুই তার প্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন।  সজলের বাবা সুবল বারুই তাঁর প্রথম স্ত্রী নিয়তি আর ছেলেকে ছেড়ে ঘর বাঁধেন মিনতি নামে এক মহিলার সঙ্গে। তাঁর এই দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্ম হয় সজলের। রঙিন স্বপ্ন কেটে যাওয়ার পর শুরু হয় সজলের মায়ের ওপর নিদারুণ অত্যাচার। মারধর, দিনের পর দিন না খেতে দেওয়ার ঘটনা চলতে থাকে ছোট্ট সজলের চোখের সামনে। একসময় সজলকে নিজের কাছে রেখে মিনতিদেবীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফের প্রথম স্ত্রী নিয়তির কাছে ফিরে আসেন সুবল বারুই। সঙ্গে নিয়ে আসেন সজলকে। তার পর থেকে আর নিজের মাকে দেখেনি সজল। সৎমা ও সৎদাদার অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে তার ওপর।

মায়ের সঙ্গে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় সজল একটা ধাক্কা খায়। এরপর কিছু দিন চলে যায়।  সুবল সজলকে নিজের কাছেই রেখে দেন। ‌সজল তার বাবা সৎ মা এবং সৎ ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। দমদমের শুভম অ্যাপার্টমেন্টের ওই চার তলার ফ্ল্যাটে। ছোটবেলা থেকেই তার মাথায় ঢুকে যায় যে বাবা ওর সঙ্গে সৎ ছেলের মতো আচরণ করছেন। ওর নিজের মায়ের  যা পাওনা ছিল তা তিনি পাননি। ফলে বাবা, সৎ মা, সৎ ভাইয়ের প্রতি একদম শুরু থেকেই সজলের মনটা বিষিয়ে ছিল। যে সময়ে স্কুলে পড়ে সেই সময় তাঁর মনে হয় সৎ মা তার সঙ্গে অত্যাচার করছে। এর বদলা নেওয়ার দরকার।

স্কুলে সজলের পাঁচ বন্ধু ছিল। তাদের সজল প্রতিদিন তার সৎ মায়ের অত্যাচার এর কাহিনী শোনাতো। ফলে ৫ বন্ধুই জানত সজলের বাড়ির কী পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বন্ধু এবং সজল মিলে সিদ্ধান্ত নেয় তার মা মিনতির অধিকার যেভাবে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তার বদলা নিতেই হবে। যদিও তখন তাদের বয়স ১৭ বছরও হয়নি।  বদলা নেবার জন্য তাদের পুরো পরিকল্পনা শুরু হয়।

২২ নভেম্বর, ১৯৯৩। তখন সজলের বয়স ১৬ বছর, ১১ মাস ৭ দিন। পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে সজল একটি দোকানে গিয়ে হাতের গ্লাভস, মোটা দড়ি, ভোজালি কিনে ফেলে। ‌ সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ সবার আগে সজল নিজের বাড়িতে যায়।  ঘরের মধ্যে তখন ওর সৎমা নিয়তি একলা বসে টেলিভিশন দেখছিলেন।  কিছুক্ষণ পরেই একের একের পর এক সজলের পাঁচ বন্ধু সেখানে এসে উপস্থিত হয়। যাদের সঙ্গে কোনো না কোনো ধারালো অস্ত্র ছিল।  সবার আগে সজল এবং তার বন্ধুরা মাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। সৎ ভাই কাজল এসে পৌঁছায়। ‌ সে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ বন্ধু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে চেয়ার এর সঙ্গে দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে দেয়। সময় পেরিয়ে যায়। ঘড়িতে পেন্ডুলামের কাটা বলে দেয় রাত বারোটা বাজে। 

ঠিক সেই সময় সজলের বাবা সুবল বারুই বাড়িতে এসে পৌঁছান। তিনি তখনও জানতেন না তার ছেলে এবং স্ত্রীর সঙ্গে ইতিমধ্যে কী ঘটে গেছে । তিনি বাড়িতে ঢুকতেই সজল দরজা খুলে দেয়। ‌ পাঁচ বন্ধু তাকে পাকড়াও করে একটা ঘরে নিয়ে যায়। যথারীতি একটা চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে দেয়।  এই মধ্যে ঘরে সোনা ঘড়ি অলংকার টাকা-পয়সা অন্য সব সামগ্রী যা ছিল তারা এক জায়গায় জড়ো করে। এবং তা নিয়ে এক বন্ধু ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। তখন ফ্ল্যাটে সজল সমেত ছিল মোট পাঁচজন।  সজল প্রথমে তার সৎ মাকে শ্বাসরোধ করে খুন করার চেষ্টা করে। গলা গলা টিপে ধরার কিছুক্ষণের মধ্যেই মা শ্বাসরোধ হয়ে মারা যান। ‌ এরপর পাশের ঘরে গিয়ে সৎভাই কাজলকে গলা টিপে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মৃত্যু হয় না। তখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাজের উপর হামলা করে। যখন বোঝে সে মারা গেছে তখন তাকে ছেড়ে দেয়। ‌ একইভাবে বাবা সুবলের ঘরে যায়। শ্বাসরোধ করে খুন করার চেষ্টা করে। ‌ শেষ পর্যন্ত গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করে। ‌ ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা।

রাত্রি দুটো  নাগাদ তারা সঙ্গে করে চাকু, ভোজালি যেসব অস্ত্র এনেছিল সেগুলো ওই ফ্ল্যাটেই ধুয়ে ফেলে। ‌ ঘরে রান্না করার জন্য যে সরষের তেল রাখা ছিল সেই তেল দিয়ে ধারালো অস্ত্র গুলো পরিষ্কার করে।  ঘরের মেঝে ভাল করে জল দিয়ে ধুয়ে দেয়। রাত হয়ে গেছিল। ওদের খিদেও পায়।  সব শেষ করতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। কাজ মিটে যাওয়ার পর সজলের নির্দেশে তার বন্ধুরা সরষের তেল দিয়ে অস্ত্রগুলি পরিষ্কার করে সেগুলোকে  টেবিলে সাজিয়ে রাখে। ওই ফ্ল্যাটের ফ্রিজ থেকে কয়েকটি মিষ্টি, বিস্কুট  বের করে সবাই মিলে খায়। মিষ্টির ‘দাম’ হিসেবে কিছু খুচরো পয়সা টেবিলের ওপর রেখে দেয় তারা। সজলের বন্ধুরা যাওয়ার আগে তাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে তার মুখও বেঁধে দেয়। এই পুরো ঘটনাটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘‌দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’‌ দেখে সাজিয়েছিল সজল। রাত প্রচুর হয়ে গেছিল। সজল সারারাত ওই ফ্ল্যাটে ওই চেয়ারে দড়ি বাঁধা অবস্খাতেই থাকে। ‌ তখন তার চারপাশে নিজের বাবা, সৎ মা, সৎ ভাইয়ের মৃতদেহ। কিন্তু সে কোন চিৎকার করে কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করে নি। সে অপেক্ষা করতে থাকে। সারা রাত কাটিয়ে পরের দিন প্রায় দুপুর বারোটা বেজে যায়। তিনটি মৃতদেহর সঙ্গে প্রায় 12 ঘন্টা কাটাবার পর সে চিৎকার করতে থাকে, আমাকে একটু সাহায্য করুন, আমাকে কেউ সাহায্য করুন। তার গলার আওয়াজ প্রতিবেশীরা শুনতে পান। ‌ প্রতিবেশীরাই পুলিশকে খবর দেন।

পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখে, তিনটে মৃতদেহ পড়ে আছে। আর সজল খোদ বাঁধা অবস্থায় চেয়ার বন্দি। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে সজল বলে, সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় সে ঘরে ছিল। ‌ মায়ের সঙ্গে টিভি দেখছিল।  সাতজন ডাকাত আসে । তার মধ্যে দুজন পাঞ্জাবি ছিল। কেননা তারা পাঞ্জাবিতে কথা বলছিল। সঙ্গে বন্দুক ছিল। ‌ সবাইকে বেঁধে দেয়। প্রচণ্ড মারধোর করে। লুটপাট করে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়।‌ যাবার আগে মা বাবা ভাই লুটপাটে বাধা দিলে তাদের খুন করে চলে যায়।

তখন ভবনী ভবনে সিআইডির ডিআইজি ছিলেন উপেন বিশ্বাস। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছন। সে সময় মিডিয়া বলে সেরকম কোনও বস্তু ছিল না। ছিল খবরের কাগজ। আমরা খবরের কাগজের কয়েকজন প্রতিনিধি ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছয়। সজলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় পুলিশের মনে হয় যে সজলের বাবা-মা ভাই ছুরির আঘাতে মারা গেল। কিন্তু সজল একটু আহত পর্যন্ত হলো না। ‌ কেন ? যেভাবে বাকিদের মারা হয়েছে তাতে সজলকে কেন ছেড়ে দেওয়া হল ? তখন থেকেই পুলিশের সন্দেহের শুরু।

ওদিকে সজলের পাঁচ বন্ধু পরের দিন সকালে যথারীতি নিজের নিজের স্কুলে যায়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ‌ কিন্তু পুলিশের তদন্ত ওই ফ্ল্যাটে এসে আটকে যায়। সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা দেয় সজলই। সজলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সজল ভেঙে পড়ে। সজল সমস্ত ঘটনার স্বীকার করে নেয়। বলে, হ্যাঁ, আমি ওদের মেরেছি। এর জন্য আমার কোন আফসোস নেই। পুলিশ সজলের কথাবার্তা আচার আচরণ দেখে হয়রান হয়ে যায়। ওর কথার ভিত্তিতে ওর ৫ বন্ধুকে ধরা হয়। তারাও বলে, এই খুনের ঘটনায় তাদের কোনো আফসোস নেই। এদের সবাইকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে সিআইডি। ডি আই জি,সি আই ডি উপেন বিশ্বাস প্রথম সেখানে ভিডিওগ্রাফি ব্যবহার করেন। কোনও ঘটনার তদন্তে ভিডিওগ্রাফির ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রথম।

এরপর ব্যারাকপুর কোর্টে মামলা শুরু হয়। সজলকে ফাঁসির সাজা শোনান বিচারক। কিন্তু একসঙ্গে তিনটি খুনের ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সেদিন সজলের বয়স ছিল ১৬ বছর, ১১ মাস, ৭ দিন। ওই সময়,৯৩-তে যে জুভেনাইল আইন  ছিল তাতে ১৬ বছরের কম বয়সী হলে জুভেনাইল অ্যাক্টের আওতায় আসত। ১৬ বছরের বেশি বয়স হলে জুভেনাইল অ্যাক্টের আওতার বাইরে চলে যেত। তাই  তাকে নাবালক নয়, সাবালক হিসেবেই ধরা হয় । ২০০০  সালে এই জুভেনাইল অ্যাক্টের মাপকাঠি ষোল থেকে বাড়িয়ে ১৮ বছর করা হয়। সজল যখন এই কান্ডটি করেছিল তখন জুভেনাইল অ্যাক্টের মাপকাটি ছিল ১৬ বছর।  এর ৭বছর পর অ্যাক্টের সংশোধন করে ১৮ বছর করা হয়। তাই ওর ওপর সাবালক হিসেবেই মামলা চলে। ‌ এবং নিম্ন আদালত ফাঁসির আদেশ শোনায়।‌

এক পুত্রের হাতে তার বাবা-মা ভাইয়ের হত্যা সেই সময় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল। সবার কাছে একটা প্রশ্ন ছিল,16 বছর বয়সী একটা কিশোর কিভাবে তার নিজের বাবা-মাকে খুন করতে পারে ? তাই কিশোর কিশোরীদের ওপর কি ধরনের মানসিক চাপ পড়ে, আর তার থেকে কি ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট চাপে ছিলেন সেই সময়ের বাবা-মায়েরা।

সেই সময় তাকে আলিপুর জেলে পাঠানো হয়। ‌২০০১-এ হঠাৎ সজল জেলারকে জানায় তার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিডনির সমস্যা। তার শরীরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সজলকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত ওই হাসপাতালেই তাকে ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসা চলতে থাকে। একদিন রাতে আচমকা সজল “বিয়ার’ চায়। হাসপাতালে তাকে পাহারার জন্য দুজন কনস্টেবল ছিল। তাদেরকে সে বিয়ার আনতে বলে। বলে বিয়ার পার্টি করব। এর আগেও হসপিটালে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সজলের সঙ্গে তার প্রহরারত পুলিশ কর্মীরাও বিয়ার পান করেছেন। তাই এবার আর পুলিশ কনস্টেবলদের কোনো সন্দেহ হয়নি। তারাও বুঝতে পারেননি, এটা সজলের একটা পরিকল্পনার অঙ্গ। হাসপাতালের এক কর্মচারীকে দিয়ে বিয়ার আনানো হয়।‌ সবাই মিলে জোরদার পার্টি করে। ওই দুই কনস্টেবলের গ্লাসে কায়দা করে সজল ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। ফলে গভীর ঘুমের অতলে চলে যায় ওই দুই কনস্টেবল। আর সজল খুব সহজেই খাট থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসে। কলকাতা থেকে বেরিয়ে সে সোজা মুম্বই পৌঁছে যায়। মুম্বইয়ে সে কিছুদিন থাকে। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। যার নাম, সিল্কি। তাদের বন্ধুত্ব একসময় প্রেমে পরিণত হয়। শেষমেষ সজল এই মেয়েটিকে বিয়েও করে ফেলে। বছর খানেক পরে মুম্বইয়ে আর তার মন টিকছিলো না। তাই সে মুম্বই থেকে কলকাতায় চলে আসে। আসার পথে তার স্ত্রীকে আসানসোলের এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে যায়। ‌ তখন তার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। ‌ পরে তার একটি পুত্র সন্তান হয়। নাম দেয়, নাহা ।

ফের সে কলকাতার অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। ডাকাতি, চুরি, এসব করতে থাকে। তখন সে তার নাম রাখে কমল। কেননা, সজল বারুই নামটা সবাই জানতো। বাবা-মাকে খুন করে সে ইতিমধ্যেই কুখ্যাত। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তার চেহারারও বদল ঘটেছিল। সে তখন আর ১৭ বছরের ছিল না। তখন তার বয়স ২৫। সে অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিল। পুরোপুরি যুবক ।

ডাকাতি রাহাজানি করতে করতেই সে দ্বিতীয় আরেকটি গ্যাং-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। শেখ রাজু নামে পশ্চিম মেদিনীপুরে বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াতে থাকে। তাই শেখ রাজুকে পুলিশ খুঁজছিল। এক সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। আদালতের নির্দেশে তাকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। আলিপুর জেলের জেলার মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি হয়ে গেলে জানা যায় যে, এই শেখ রাজু  আসলে কেউই নয়, সজল বারুই। হাইকোর্টে মামলা যায়। নিম্ন আদালতের ফাঁসির সাজা বদলে কলকাতা হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এর আগে তাকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আমেরিকান সেন্টার কান্ডের কুখ্যাত আফতাব আনসারি সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আনসারী সঙ্গে চক্রান্তে শামিল হলে তাকে আলিপুর জেলে পাঠানো হয়। ৯৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সে জেলেও ছিল। মাঝখানে দু’বছর সে জেল পালিয়ে ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৩ অবধি। সাত বছর পালানোর আগে এবং আট বছর জেল পাওয়ার পর মোট ১৫ বছর তার জেলখাটা হয়ে গেছিল।

এদিকে হাইকোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। ওই সময় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড খাটতে হতো মাত্র ১৪ বছর । ফলে সজলের ১৪ বছর জেল খাটা হয়ে গেছিল। তখন ১৫ বছর চলছিল। তাই সে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেন যে, তার তো পনেরো  বছর জেল খাটা হয়ে যাচ্ছে । তাহলে এবার ছেড়ে দেয়া হোক। ২০১০ -এ হাইকোর্ট তাকে জামিনে ছেড়ে দেয়। হাইকোর্ট  বলে যদি তুমি ভালো নাগরিক হয়ে দেখাও তাহলে তোমাকে পুরোপুরি রেহাই করে দেওয়া হবে।‌ কারণ ইতিমধ্যে জেলে ছবি এঁকে সজল খ্যাতি অর্জন করেছিল। তার কয়েকটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। প্রদর্শনী হয়েছিল বিড়লা অ্যাকাডেমি,  এমনকি কলকাতা বইমেলাতেও।

কিন্তু, ২০১১ সালে আবার সে একটা ডাকাতির মামলায় গ্রেফতার হয়। এবং স্বাভাবিকভাবেই জেলে চলে যায়। কয়েক দিন জেল খেটে সে জেলের বাইরেও চলে আসে। বাবা মা সৎ ভাইকে খুন করার পর সজল ধরা পড়লে, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তুমি এমন কাণ্ড ঘটালে কেন ? সজলের  জবাব ছিল, আমি ওই সময় আমার মায়ের সামনে বসে টিভি দেখতাম। তখন দূরদর্শনে দেখাতো “ওয়াল্ড দিস উইক”।

এই খুনের ঘটনার কয়েকমাস আগে ওয়াল দিস উইক-এ মাইকেল ডগলাসের ফিল্ম “ফলিং ডাউন”-এর কিছু ঝলক দেখানো হয়েছিল। যার মধ্যে একটা সিন ছিল, মাইকেল ডগলাস খুন করার পর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে খায়। সজল জানায়, খুনের পর পয়সা দিয়ে ডগলাস কোল্ডড্রিঙ্কস কিনে খেয়ে ছিল বলে সজল তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়। বলে, আমরা তো ফোন করেছিলাম, কিন্তু ফ্রিজ থেকে বার করে বন্ধুরা মিলে ঘরের খাবারও খেয়েছিলাম। তাই ডাইনিং টেবিলের ওপর টাকা রেখে ওই খাবারের দাম মিটিয়ে দি।

ওই সময় সজল বারুইয়ের কাহিনী নিয়ে প্রচুর হইচই হয়। অনেক বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাদের মত পেশ করেন। পুলিশ এবং জেল কর্তৃপক্ষ সজলকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করান। সাধারণ মানুষ ভাবছিল, একটা নাবালক ছেলে কীভাবে ঠান্ডা মাথায় নিজের বাবা-মাকে খুন করতে পারে। শুধুমাত্র খুন করতে পারে না ,খুনের পর তার কোন আফসোস ছিল না। কোন দুঃখ ছিল না। একবারের জন্যও সে কান্নায় ভেঙে পড়েনি। তার এটাই মনে হয়েছিল বাবা, মা মিনতির সঙ্গে অন্যায় কাজ করেছেন। মিনতির অধিকার তিনি সৎ মা নিয়তিকে দিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই না, তার থেকে তার সৎ ভাই কাজল বাড়িতে অনেক বেশি সম্মান ভালোবাসা পায়। যে বয়সে বাচ্চাদের অপরাধ সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান থাকে না, সেই বয়সেই সজল হয়তো এইসব চিন্তা ভাবনা থেকেই  জবরদস্ত খুনি অপরাধী তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

দীর্ঘদিন জেল খাটার পর সজলের ৫ বন্ধু ধীরে ধীরে মুক্তি পেলেও সজল আরও বেশ কিছু অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। কখনও দমদম সেন্ট্রাল জেল, কখনও প্রেসিডেন্সি, আবার কখনও আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এমনকি রাজ্যের অন্য জেলেও তাকে বন্দি থাকতে হয়েছে। 

এই হল সজল বারুইয়ের গল্প। একটাই মানুষ যে তিন তিনটি নামে পৃথক পৃথক ঘটনায় আলাদা আলাদা ভাবে জেল খেটে ছিল। কখনও সে সজল বারুই, কখনও কমল, আবার কখনও শেখ রাজু। সজল পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিল। ভাল আঁকত সে। তার হাতের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অনেকেই। জেলের মধ্যেও সজল অন্য বন্দিদের আঁকা শেখাত।

সম্প্রতি সজল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে এসেছে। কাজকর্মও করছে। সে বিয়েও করেছে। সুখে সংসারও করছে। তার স্ত্রীও তাকে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য সব রকমের সাহায্য করছে। জানা গেছে, সজল তার শ্বশুরবাড়ির কাছেই একটা ভাড়া বাড়িতে থাকছে। অবশেষে, অপরাধ দুনিয়ার নাগপাশ থেকে ‘‌মুক্তধারা’‌ এসেছে সজলের জীবনে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img