হোমফিচারকেন এত আত্মহনন?

কেন এত আত্মহনন?

কেন এত আত্মহনন?

বর্ণালী জানা বর্ণালী জানা

তথ্যটা চমকে দেওয়ার মতো। ২০১৯ সালে জাপানে আত্মহত্যা করেছেন ১৯,৯৫৯ জন। আঁতকে উঠলেন? এ তো টিপ অফ দ্য আইসবার্জ। আরো শুনুন। জাপান সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী এই অংকটা তো বিগত চল্লিশ বছরের মধ্যে নেহাতই কম। ১৯৭৮ সাল থেকে জাপানে আত্মহত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে। দেখা গেছে, ২০০৩ সালে জাপানে আত্মঘাতী হয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৪২৭ জন। এখানে পুরুষদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। যাঁরা আত্মঘাতী হচ্ছেন তাদের ৭১ শতাংশই পুরুষ। ১৩ কোটি মানুষের দেশে এই সংখ্যাটা আমাদের রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে।

কিন্তু কেন এই নির্বিচার আত্মহনন? বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি; অটোমোবাইল ও যন্ত্রাংশ শিল্পের পীঠস্থানে মানব সম্পদের কেন এই অনর্থক অপচয়? ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের অর্থনীতির শিক্ষক সুগত সেনগুপ্ত সম্পূর্ণ বিপরীত একটা চিত্র তুলে ধরলেন ‘ জাপানের অর্থনীতিতে সংকট ঘনিয়ে আসছে। ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে চরম আর্থিক মন্দার শিকার হয়েছিল জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেশের অর্থনীতিতে এরকম গভীর সংকট আর আসেনি’। এর ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ছাঁটাই, বেকারত্ব, অতিরিক্ত সময় কাজের চাপ, প্রতি মুহূর্তে কাজ হারানোর ভয়…
দেখা গেছে, চাকরি হারানোর কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। ২০০৭ সালে চাকরি জনিত কারণে ২,২০৭ জন আত্মঘাতী হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী কাজের অতিরিক্ত চাপ। তারপর রয়েছে যন্ত্র নির্ভর সভ্যতার অবসাদ, হতাশা।
ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যুক্ত মনোবিদ পম্পা রায়চৌধুরী মৈত্র জানালেন –‘জাপানে জন্মহার কমছে। ফলে সেদেশে এখন তরুণ-তরুণীর তুলনায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যা বেশি। তাঁরা ভীষণ ভাবে একাকিত্বে ভুগছেন। প্রতি বছর বহু বয়স্ক মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন’।

শুধু বয়স্করা নয়, কিশোরকিশোরীদের মধ্যেও আত্মহননের প্রবণতা বাড়ছে। স্কুলে সহপাঠীদের টিটকিরি বা শিক্ষকদের বকুনিও আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠছে।
শুধুই কি হতাশা? অবসাদ? কাজের চাপ? মনের কোনও গোপন অসুখ কি নেই? কিংবা কোনও বিপন্ন বিস্ময় যা শুধু আমাদের ক্লান্ত করে। ‘মিথ অফ সিসিফাস’-এ বড় চমৎকার কথা বলেছেন আলবেয়ার কামু…বেঁচে থাকাটা একটা অভ্যেস। সেই অভ্যেসের অসারতা বুঝে গেলে বাঁচার ইচ্ছেও চলে যায়। … এই দুনিয়ার ওপর থেকে মায়ার পর্দাটা সরে গেলে…সব আলো নিভে গেলে মানুষ নিজকে বড় বিচ্ছিন্ন মনে করে। এই বিচ্ছিন্নতাই তাদের ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে।
পম্পাদেবীর মতে… ‘ জাপানিদের মধ্যে আত্মহত্যার একটা ট্র্যাডিশন রয়েছে। অসম্মানের চেয়ে তাদের কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। প্রাচীন সামুরাইদের হারাকিরি সংস্কৃতির হয়তো কোনও বীজ রয়ে গেছে এদের মধ্যে। অন্তত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আত্মহত্যাকে এখানে খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করা হয় না। মনে যে প্রবণতা সুপ্ত থাকে বাইরের কোনও অনুঘটক তাকে জাগিয়ে দেয়’।

কারণ যাই হোক না কেন…অবসাদ, বা কাজের চাপ কিংবা মনের কোনও বিকার…জাপানে আত্মঘাতী মানুষের এই সংখ্যাটা আমাদের সভ্যতাকে এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img